Advertisement
E-Paper

চুপ, সমালোচনা নয়

সম্প্রতি বিজেপি শাসনে যে ব্যাপক হারে নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত হইতেছে, এক দিকে পুলিশ নিজেই গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া সংখ্যালঘুদের শাসানি দিতেছে, আর এক দিকে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে গণপ্রহারে ভিন্নধর্মীয় ও ভিন্নগোত্রীয় নাগরিকের হত্যা সংঘটিত হইতেছে— এমন সময়ে আদালতও মুখ ফিরাইয়া লইলে নাগরিকের আর থাকে কী! বিচারবিভাগ, বিশেষত সুপ্রিম কোর্ট ও হাতে-গোনা কতকগুলি হাইকোর্টের বিচারবিবেচনা এখনও নিরপেক্ষতার দীপ্তিতে ঋদ্ধ, সেইটুকুই আশা।

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
বিচারপতি লোকুর।

বিচারপতি লোকুর।

প্রাচীন কালে রাজা-মহারাজারা সকলেই একটি বস্তু ব্যতিক্রমবিহীন ভাবে ভালবাসিতেন: তাহার নাম প্রশস্তি। নিজের প্রশংসা শুনিবার ও শুনাইবার বন্দোবস্ত তাঁহারা করিতেন বিপুল উৎসাহে, প্রচুর ব্যয়ে। হীরকরাজার সভাকবির কবিতাগুলির মতোই প্রতিটি পদ শেষ হইত রাজপ্রশস্তি দিয়া। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর শাসনপ্রণালী দেখিয়া মনে হয়, আধুনিক গণতন্ত্রের নেতা হিসাবে জিতিয়া আসিলেও আসলে তিনি পুরাতন রাজতন্ত্রের ঐতিহ্যবাহক। যে কোনও সুযোগে তাঁহার নিজের প্রশস্তি শুনিবার আকাঙ্ক্ষাটি ঠিক সেই প্রাচীন-অভ্যাসমাফিক। তাই ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে দাঁড়াইয়াও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি অকুতোভয়ে বলিতে পারেন, যেন সরকারি কাজকর্মের কোনও সমালোচনা না করা হয়। বাস্তবিক, কথাটি বলা হইয়াছে রীতিমতো ভর্ৎসনার সুরে। অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপালের ভাষা শুনিয়া যে কেহ মনে করিবেন, যেন মাননীয় বিচারপতিদের নয়, অধস্তন কোনও বিভাগকে কঠিন স্বরে নির্দেশ দেওয়া হইতেছে। অবশ্য, এ কথা ঠিক যে, ভারতীয় সংবিধানে তিনটি বিভাগের মধ্যে পার্থক্য ও দূরত্ব সযত্নে রক্ষা করা হইলেও সাম্প্রতিক কালে অনেক ক্ষেত্রেই বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা বিষয়ে গভীর সংশয়ের কারণ ঘটিয়াছে। এবং শাসনবিভাগের সহিত বিচারবিভাগের দূরত্ব সত্যই কতখানি, বিচারবিভাগের ভিতর হইতেই তাহা লইয়া আক্ষেপ ও অভিযোগ শোনা গিয়াছে। এমন পরিস্থিতিতে শাসনবিভাগের প্রতিনিধি যদি সার্বিক ভাবে বিচারবিভাগের প্রতি ভর্ৎসনা বর্ষণের দুঃসাহস দেখান, তবে বলিতে হয়, জাতির আকাশে দুর্দিনের ঘোরকৃষ্ণ মেঘ। দ্রুত এই মেঘ উড়াইয়া লইয়া যাক বিচারবিভাগের শুভবোধ, দেশের নাগরিক এমনই আশা করিবেন।

এ ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটিল। বিচারপতি লোকুর, দীপক গুপ্ত ও আবদুল নাজিরের বেঞ্চের সামনে সরকারি প্রতিনিধি ভর্ৎসনা শুনাইবার পর দৃঢ়স্বরে মাননীয় বিচারপতি লোকুর মনে করাইয়া দিলেন, জনস্বার্থ মামলাগুলির প্রেক্ষিতে সরকারের অকারণ সমালোচনা করা তাঁহাদের লক্ষ্য নয়— তাঁহাদের মূল উদ্দেশ্য, নাগরিকের অধিকার হরণ ও হননের প্রতিরোধ। বিচারবিভাগের প্রাথমিক কাজই নাগরিকের জীবন ও স্বাধীনতার রক্ষণাবেক্ষণ। সেখানে যদি সরকারের পদক্ষেপ কোনও সঙ্কট তৈরি করে, তবে তাঁহাদের রায় সরকারবিরোধী হইবে, গত্যন্তর নাই। তাঁহার যুক্তিকে আর একটু আগাইয়া লইয়া বলা যায় যে, নাগরিকের প্রতিপালনই যদি রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হয়, তবে তিনটি আপাত-বিচ্ছিন্ন বিভাগ মূলগত ভাবে বিচ্ছিন্ন নহে, তিনটির সামনেই প্রধান লক্ষ্য, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা। শাসনবিভাগ যদি তাহা করিতে অসমর্থ হয়, তবে বিচারবিভাগকেই পা বাড়াইয়া নাগরিক সুরক্ষার কাজটি করিতে হইবে!

এই ধরনের রাষ্ট্রিক বিবেচনা সর্বদাই পরিপার্শ্বের উপর নির্ভরশীল। যাহা সাধারণ অবস্থায় অতি-সক্রিয়তা, দুঃসময়ে তাহাই প্রয়োজনীয় সক্রিয়তা। সম্প্রতি বিজেপি শাসনে যে ব্যাপক হারে নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত হইতেছে, এক দিকে পুলিশ নিজেই গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া সংখ্যালঘুদের শাসানি দিতেছে, আর এক দিকে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে গণপ্রহারে ভিন্নধর্মীয় ও ভিন্নগোত্রীয় নাগরিকের হত্যা সংঘটিত হইতেছে— এমন সময়ে আদালতও মুখ ফিরাইয়া লইলে নাগরিকের আর থাকে কী! বিচারবিভাগ, বিশেষত সুপ্রিম কোর্ট ও হাতে-গোনা কতকগুলি হাইকোর্টের বিচারবিবেচনা এখনও নিরপেক্ষতার দীপ্তিতে ঋদ্ধ, সেইটুকুই আশা। এ সবই সাধারণ কথা, কিন্তু দুঃসময়ে সাধারণ কথাও অসাধারণ শোনায়, স্বাভাবিক কাজও সাহসিকতার স্বাক্ষর হইয়া ওঠে। ভারত এখন তেমনই এক সময় দেখিতেছে।

Narendra Modi M B Lokur Supreme court
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy