Advertisement
E-Paper

শিক্ষক-পড়ুয়া সম্পর্ক এবং পরিবর্তিত সময়ের সমস্যা

আদিকাল থেকেই শিক্ষক-পড়ুয়ার সম্পর্কের রসায়ন আর-পাঁচটা সম্পর্কের চেয়ে আলাদা। সময়ের সঙ্গে বদলেছে তার গতিপ্রকৃতিও। লিখছেন রুদ্র সান্যালপ্রাক্‌-স্বাধীনতা যুগেও শিক্ষক আর পড়ুয়ার মধ্যে যেমন সুস্থ সম্পর্ক ছিল, স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে সেই সম্পর্কের মধ্যে একটা কৃত্রিমতা তৈরি শুরু হয়।

আপনার অভিমত

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৯ ০৬:২২

প্রাচীন কাল থেকেই পৃথিবীর সব জায়গায়, বিশেষ করে উন্নত সভ্যতায় গুরু-শিষ্য পরম্পরার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করত পড়ুয়ারা। ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে প্রাচীন গ্রিস থেকে শুরু করে ভারত পর্যন্ত এই পরম্পরা চলে এসেছে।

শিশুর শিক্ষাগ্রহণের প্রথম পদক্ষেপ শুরু হয় পরিবার থেকে। কিন্তু তারপর নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে শিক্ষাদানের দায়িত্ব পিতামাতার থেকে চলে আসে শিক্ষকের উপর। শিক্ষক সারাজীবনের অর্জিত শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান শিক্ষার্থীকে দান করেন। এই ভাবে জ্ঞানের আলোয় বিকশিত হয় শিক্ষার্থীর মন। গুরু-শিষ্য পরম্পরা এ ভাবেই গড়ে উঠেছিল সুপ্রাচীন কাল থেকে। সভ্যতার বিকাশ এই ভাবেই গড়ে উঠেছে। এই শিক্ষাদান এবং গ্রহণের মধ্যে দিয়ে শিক্ষক এবং পড়ুয়ার মধ্যে গড়ে ওঠে শ্রদ্ধা-ভালবাসার অটুট বন্ধন।

একজন শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষক গুরুর মতো সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। আর ঠিক তেমনই শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থী সন্তানতুল্য। শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিজীবন তথা শিক্ষাজীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষককে অনুসরণ করে। এটাই স্বাভাবিক আচরণ। শিক্ষক যেমন তাঁর ছাত্রের যাবতীয় সফলতাকে নিজদায়িত্বে পরিপূর্ণ করেন, ঠিক তেমনই তাঁর ব্যর্থতার দায়ভারও নিজের কাঁধে নিয়ে নেন। শিক্ষকের এটাই ধর্ম হওয়া উচিত। তাই পড়ুয়া-শিক্ষকের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িত।

যেহেতু সব সময় বলা হয় শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর, তাই শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক যত সহজ স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ হবে, ততই শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন। যাতে সে নিজের দেশ গঠনে উপযুক্ত করে নিজেকে তৈরি করতে পারে। যে ভাবে এই বাংলাদেশে ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে বাংলায় এক বিশাল নবজাগরণের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, তা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রাচীন পৃথিবীতে আমরা দেখেছি, কী ভাবে গ্রিসের গুরু-শিষ্য পরম্পরা সারা বিশ্বকে আলোড়িত করেছে। এক দিকে মহান দার্শনিক সক্রেটিস, তাঁর সুযোগ্য শিষ্য প্লেটো আর তাঁর সুযোগ্য ছাত্র অ্যারিস্টটল এবং সুযোগ্য ছাত্র আলেকজান্ডার। এ ভাবেই গুরু-শিষ্য পরম্পরা তৈরি করে এক একটা নতুন যুগ। মহাভারতেও এই পরম্পরার প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়। পঞ্চপাণ্ডবের গুরু ছিলেন দ্রোণাচার্য। যাঁকে পাণ্ডবেরা শেষ দিন পর্যন্ত পরম শ্রদ্ধার জায়গায় রেখেছিলেন। অর্জুন তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্র। সুতরাং, গুরুর শিক্ষা ভাল হলে যোগ্য শিক্ষার্থী অবশ্যই সাফল্য পেতে পারেন জ্ঞানার্জনে, এ কথা বলাই যায়।

তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের নতুন করে মূল্যায়ন তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে এই বাংলাদেশে ইংরেজ আমলে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। নবাবি আমলের পাঠশালা টোল বা মক্তবের পড়াশোনার বাইরেও ইংরেজি তথা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে ইংরেজরা। এর সঙ্গে সঙ্গেই প্রথাগত গুরুকুল শিক্ষাব্যবস্থার অনেকাংশ ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে থাকে। আধুনিক বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে।

প্রাক্‌-স্বাধীনতা যুগেও শিক্ষক আর পড়ুয়ার মধ্যে যেমন সুস্থ সম্পর্ক ছিল, স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে সেই সম্পর্কের মধ্যে একটা কৃত্রিমতা তৈরি শুরু হয়। যেটা বর্তমান সময়ে প্রকট রূপ ধারণ করেছে অনেক ক্ষেত্রেই। শিক্ষক-পড়ুয়া সম্পর্ক এখন কিছুটা ব্যবসায়িক হয়ে গিয়েছে। যেটা কখনওই কাম্য ছিল না।

শিক্ষাঙ্গনে অনেক জায়গায় রাজনৈতিক কলুষতা গ্রাস করেছে। শিক্ষক আগে যে ভাবে শিক্ষার্থীকে অনুশাসনের পথে চালিত করতে পারতেন, এখন সে ভাবে পারেন না। তবে এখনও বহু ক্ষেত্রেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অত্যন্ত মধুরই রয়েছে। যেটা একান্ত কাম্য।

একজন শিক্ষকের কাছে থেকে শিক্ষার্থীর প্রত্যাশা হল তাকে জীবনে বড় হওয়ার ক্ষেত্রে পথ দেখানো। যাতে সে নিজের জীবনকে নিজের মতো তৈরি করতে পারে। তবে এটাও ঠিক যে, শিক্ষক শুধু জ্ঞানদাতা হিসেবে কেবল জ্ঞান দিয়ে যাবেন, তা নয়, তাঁরও শিক্ষার্থীর কাছে কিছু প্রত্যাশা থাকে। যাতে তাঁর শিক্ষায় সে যেন প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত হয়। তবেই সে সুনাগরিক হয়ে উঠতে পারবে এবং শিক্ষক তথা নিজের বাবা-মা তথা গুরুজনদের সন্মান দেবে। বর্তমানে এই ভাবনাটা নানা ভাবে বদলে গিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে মনোযোগের বিষয়টাই সব চেয়ে বেশি অবহেলিত। নানা ধাঁচের প্রযুকিত এবং তার সুযোগ নানা ভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। তার ভাল দিকের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ দিকটাও রয়েছে। সেটাই পড়াশোনায় মনোযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। এই সমস্যা এক নতুন ধরনের মানসিক এবং সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

এই সমস্যার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সরকারি স্তরে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। যাতে এই সমস্যা মহামারীর রূপ না নেয়। একই সঙ্গে স্বীকার্য যে, সমস্ত শিক্ষা একজন শিক্ষক কখনওই দিতে পারেন না পড়ুয়াকে। এর জন্য অভিভাবকদেরও বিশেষ ভাবে সচেষ্ট হতে হবে। বিশেষত নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে।

শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক এই তিন পক্ষের মধ্যে সুষ্ঠু সামঞ্জস্য রেখে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারলেই আদর্শ সহাবস্থান তৈরি হতে পারে এ কালের শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর মধ্যে। লক্ষ্য একটাই— জ্ঞানার্জন। এবং তার সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের চিরকালীন মাধুর্য বজায় রাখা। পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালবাসার মধ্যে দিয়ে এই মহান সম্পর্ক যাতে বজায় থাকে, তা রক্ষা করা সকলেরই নৈতিক দায়িত্ব।

(লেখক শিলিগুড়ির বিধাননগর সন্তোষিণী বিদ্যাচক্র হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

Education Teacher Student
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy