Advertisement
E-Paper

আর্সেনিক-যুদ্ধের সেনাপতি

মাটির তলা থেকে ওঠা জলে আর্সেনিক কী ভাবে এক জন কর্মঠ মানুষকে ক্রমশ কর্মহীন করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মেডিক্যাল জার্নাল এবং সরকারি নথিপত্রের বাইরে সেই তথ্যটি কোনও দিনও প্রকাশিত হয়নি।

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০

কলকাতার একটি সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরিতে সলতে পাকানোর কাজটি শুরু করেছিলেন এক জন। আর সলতে থেকে মশাল তৈরি করে পরিবেশ বার্তাটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন অন্য জন। সেই মশালের আলোয় ধরা পড়েছিল ভূগর্ভে লুকিয়ে থাকা একটি বিষের ভয়াবহতা। সতর্ক হয়েছিল প্রতিবেশী বাংলাদেশ এবং নেপালও।

প্রথম জনের গবেষণা দেখিয়েছিল, মাটির তলা থেকে ওঠা জলে আর্সেনিক কী ভাবে এক জন কর্মঠ মানুষকে ক্রমশ কর্মহীন করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মেডিক্যাল জার্নাল এবং সরকারি নথিপত্রের বাইরে সেই তথ্যটি কোনও দিনও প্রকাশিত হয়নি। প্রথম জনের গবেষণালব্ধ ফলকে সর্ব জনের কাছে প্রকাশ করে দ্বিতীয় জন দেখিয়েছিলেন ওই দূষণের ব্যাপ্তি কতটা। গঙ্গা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় মানুষ যে সঙ্কটে রয়েছেন, তা দ্বিতীয় জন না থাকলে জানতে পারতেন না আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত মানুষেরাই।

প্রথম জন স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ত্বক বিভাগের তৎকালীন প্রধান ক্ষিতীশচন্দ্র সাহা। প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দির বাইরে আর্সেনিক দূষণের গবেষণাকে নিয়ে যেতে পারেননি সরকারি নিষেধাজ্ঞায়। আর দ্বিতীয় জন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ়-এর ভূতপূর্ব অধিকর্তা (গবেষণা) দীপঙ্কর চক্রবর্তী (ছবিতে)। তিনি ঝুলি থেকে ইঁদুর বার করে রাজ্য সরকারের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছিলেন অল্প দিনেই। ‘দেশদ্রোহী’, ‘পাগল’ অ্যাখ্যা দিয়ে রাজ্য সরকার (কী বামফ্রন্ট, কী তৃণমূল সরকার) মুখ বন্ধ করতে চেয়েছে তাঁর। আর্সেনিক দূষণ সংক্রান্ত সব কমিটি থেকে বার বার বাদ রাখা হয়েছে ওই দু’জনকেই। এমনকি, কিছু দিন আগে জাতীয় পরিবেশ আদালত আর্সেনিক দূষণ নিয়ে একটি কমিটি গড়ার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে নাম চেয়েছিল। প্রথম জন তখন আর বেঁচে নেই। আর দ্বিতীয় জনের নাম রাজ্য সরকার কমিটিতে রাখেনি। তা নিয়ে পরিবেশবিদদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। রাজ্য সরকারের অবশ্য হেলদোল হয়নি তাতে। পশ্চিমবঙ্গে আর্সেনিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দুই প্রধান সেনাপতি এই দু’জন।

আর্সেনিক দূষণ মোকাবিলায় এই যে কেন্দ্রীয় সরকার কোটি কোটি টাকা অনুদান দিচ্ছে, বিশ্বব্যাঙ্ক, ইউনিসেফ সাহায্যের ঝুলি নিয়ে এগিয়ে এসেছে তা সম্ভবই হত না, যদি দ্বিতীয় জন ওই মারাত্মক দূষণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে না যেতেন। ১৯৯৬ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্সেনিক নিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পরেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এবং ইউনিসেফের নজর কেড়েছিল ভূগর্ভ থেকে নলকূপের জলে উঠে আসা বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক। আর তার জন্য দ্বিতীয় জনকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়েছিলেন তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের এক মন্ত্রী। আর কলকাতার জলে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিকের কথা বার বার তুলে ধরায় তাঁকে ‘পাগল’ বলতে ছাড়েননি দুই মেয়র। আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্প্রতি আর্সেনিক-দূষণের ওপর যে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশিত হল, তাতে স্পষ্ট, ক্ষিতীশবাবু বা দীপঙ্করবাবু কত বড় বিপদের কথা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন।

ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্গে উঠে আসা আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় যে ক্যানসার হয়, তা ১৯৮৩ সালে প্রথম জানান ক্ষিতীশচন্দ্র সাহা। আর আর্সেনিক দূষণের ব্যাপকতা পশ্চিমবঙ্গের আট জেলার বাইরে কতটা ছড়িয়েছে, কী ভাবে তা বাংলাদেশ, নেপাল, উত্তর পূর্বাঞ্চলের একাংশ, বিহার, ছত্তীসগঢ়, উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে তা নিজের গবেষণায় তুলে ধরেছেন দীপঙ্কর চক্রবর্তী। কী ভাবে এই দূষণ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, কী ভাবে সহজে জলে আর্সেনিকের পরিমাণ মাপা যায়, সেই প্রযুক্তি উদ্ভাবনেও দীপঙ্করবাবুর অবদান অনস্বীকার্য।

এত বড় একটা আবিষ্কারের পরে বাকি জীবনটা উপেক্ষিত থেকেই গত বছর প্রয়াত হয়েছেন ক্ষিতীশবাবু। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে চলে গেলেন দীপঙ্কর চক্রবর্তীও। সরকারি কর্মী ক্ষিতীশবাবু লাল ফিতের ফাঁস উপেক্ষা করতে পারেননি। কিন্তু দীপঙ্করবাবু সরকারি উপেক্ষাকে আমল না দিয়ে নিজের কাজটাই করে গিয়েছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত।

আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত মানুষদের ভোগান্তি নিয়ে বলতে গিয়ে প্রকাশ্য সভায় দীপঙ্করবাবুর গলা রুদ্ধ হয়ে এসেছে বার বার। আর্সেনিক দূষণের ব্যাপকতা প্রকাশ্যে আনার জন্য নানা ভাবে রাজ্য প্রশাসন হেনস্থা করেছে তাঁকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং সন্তানসম ছাত্রদের অনেকের ব্যবহারেই আঘাত পেয়েছেন মনে। কিন্তু ভেঙে পড়েননি কখনও। আর্সেনিক দূষণ আক্রান্তদের একটা তথ্যপঞ্জি তৈরি করছিলেন মৃত্যুর কিছু দিন আগে। রসায়ন নিয়ে একটা বই লিখছিলেন। আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে বাগান নিয়ে মেতেছিলেন।

পরিবেশ এবং রসায়নের এমন কোনও জার্নাল নেই যারা দীপঙ্করবাবুর গবেষণাপত্র না ছেপেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালের তিনি ছিলেন প্রধান রেফারি। এই পারিশ্রমিক এবং নিজের তৈরি রাসায়নিক প্রযুক্তি বিক্রি করে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে দিয়েছেন। এ ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছেন তিনি। নিজের তহবিলের দৈন্যদশা ফেরাননি।

আমাদের এই দেশে যে সব কাজ সরকারের করা উচিত, তা তারা করে না। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি মোকাবিলার জন্য লাগাতার চাপ সৃষ্টি করে যেতে হয় প্রশাসনের উপরে। শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, জল দূষণ থেকে মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু তার জন্য বাইরে থেকে সংবাদমাধ্যম কিংবা দীপঙ্কর চক্রবর্তী, ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের মতো কাউকে লাগাতার লেগে থাকতে হয়। সরকারের বিরাগভাজন হন তাঁরা। নানা ভাবে হেনস্থায় এক সময় তাঁদের অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। প্রশাসন বোধ হয় সেটাই চায়।

আর্সেনিক দূষণ নিয়ে দীপঙ্করবাবুর গবেষণায় উঠে আসা নিত্যনতুন তথ্যে রাজ্য সরকারের কোনও হেলদোল না হলেও, আর্সেনিক দমনে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যের পরিমাণ কিন্তু দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তাতে কাজের কাজ কতটা হচ্ছে, মৃত্যুর কিছু দিন আগে থেকে সেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন দীপঙ্করবাবু। তিনি চলে যাওয়ার পরে এই প্রশ্ন কি আর কেউ তুলবেন?

Arsenic Commander
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy