Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Delhi Violence

লাভ কাহার

রাজধানীর হিংসায় তবে জিতিল কোন পক্ষ? জিত কাহারও হয় নাই— কথাটি কেতাবি বটে, কিন্তু অর্ধসত্য। জিতিয়াছে বইকি। জিতিয়াছে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘোর অবিশ্বাস আর ঘৃণা।

—ফাইল ছবি

—ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২০ ০১:০৮
Share: Save:

নাওয়ের মাঝি প্রশ্ন করিয়াছিল সুতাকলের মজুরকে, “...মারামারি কইরা হইব কী। তোমাগো দু’গা লোক মরব, আমাগো দু’গা মরব। তাতে দ্যাশের কী উপকারটা হইব?” সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পের সেই মহার্ঘ প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাইতেছে হিংসাবিধ্বস্ত উত্তর-পূর্ব দিল্লির অলি-গলিতে। গণহত্যার প্রক্রিয়া যেমন চারিদিক ছারখার করিয়া দেয়, তেমনই আবার এক সময় থামিয়াও যায়। মাঝে পড়িয়া সর্বস্বান্ত হন সাধারণ মানুষ। আগুন নিবিলে দেখা যায় জ্বলিয়া যাওয়া কারখানা, আর আধপোড়া রিকশার কঙ্কালের সম্মুখে পাশাপাশি বসিয়া আছেন হরি ওম এবং মহম্মদ সাবিরেরা। তাঁহাদের দৃষ্টি শূন্য, তাঁহাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ধর্ম তাঁহাদের বিচ্ছিন্ন করিয়াছে, আবার সেই ধর্মই তাঁহাদের একই পরিণতির সম্মুখে দাঁড় করাইয়াছে। পরিণতি, ভয়ঙ্কর। এই অসহ সন্ত্রাস তাঁহাদের কাহারও সন্তান কাড়িয়াছে, কাহারও স্বামী, কাহারও পিতা। কাহারও রুজিরুটির সমস্ত পথ বন্ধ করিয়া অভুক্ত দিনযাপনে বাধ্য করিয়াছে। হিংসা কাহাকেও ছাড়ে না। হিসাব করিতে বসিলে দেখা যায়, ধর্মের গণ্ডির তোয়াক্কা করে নাই সেই ক্ষয়ক্ষতি। যাঁহারা প্রথম অস্ত্র তুলিয়া লইয়াছিলেন, আর যাঁহারা মূলত মার খাইয়াছিলেন, উভয় সম্প্রদায়ের সাধারণ, গরিব মানুষই বহু ক্ষতির সম্মুখীন হইয়াছেন। দিল্লির বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলিতে এখন সর্বহারা মানুষের হাহাকার। সেই হাহাকারের ধর্মবিচার করিতে বসা মূর্খামি।

রাজধানীর হিংসায় তবে জিতিল কোন পক্ষ? জিত কাহারও হয় নাই— কথাটি কেতাবি বটে, কিন্তু অর্ধসত্য। জিতিয়াছে বইকি। জিতিয়াছে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘোর অবিশ্বাস আর ঘৃণা। অবস্থা এমনই যে ফেজ টুপি পরিহিতদের জটলা দেখিলেই দ্রুত পথ পরিবর্তন করিতেছেন জনৈক হিন্দু। অন্য দিকের চিত্রটিও অবিকল এক। পারস্পরিক ঘৃণা আর অবিশ্বাসের এমন জয় অবশ্য এক দিনে সম্ভব হয় নাই। বিদ্বেষের যে দেশব্যাপী চাষ গত কয়েক বৎসর যাবৎ চলিতেছে, এখন তাহারই বিষ-ফসলে দেশের ডালা ভরিয়া উঠিয়াছে। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোয় ঘৃণা আর বিদ্বেষকে যে ভাবে সযত্নে ভরিয়া দেওয়া হইয়াছে, দিল্লির দাঙ্গায় তাহারই এক স্ফুলিঙ্গের দেখা মিলিল মাত্র। সেমইয়ের বাটি আর দিওয়ালির লাড্ডুর আদানপ্রদান বন্ধ হইলে ক্ষমতাবানের লাভ। ইতিহাস সাক্ষী, ক্ষমতায় টিকিয়া থাকিতে শাসক বিভেদকে হাতিয়ার করিয়াই থাকে। এবং, বিভেদ সৃষ্টি করিতে ধর্ম অপেক্ষা শক্তিশালী অস্ত্র আর কী-ই বা হইতে পারে! হরি ওম এবং মহম্মদ সাবিরেরা বিচ্ছিন্ন থাকিলে ক্ষুদ্র স্বার্থের ব্যাপারীদের লাভ।

আশার কথা একটাই, ঘৃণার এই জয় সর্বাঙ্গীণ নহে। তাহার প্রমাণ শাহিন বাগ, তাহার প্রমাণ পার্ক সার্কাস। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে কড়া ঠান্ডায় একা মুসলিমেরাই রাত জাগেন নাই। তথাকথিত ‘নিরাপদ’ ধর্মের মানুষেরাও তাঁহাদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছাড়িয়া ‘অন্য’ ধর্মের মানুষদের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। নেহরু-যুগের কিছু তলানি হয়তো এখনও ভারতের সিংহভাগ মানুষের হৃদয়ে পড়িয়া আছে— এই সহাবস্থান তাহারই প্রমাণ। দাঙ্গাকারীদের হাত হইতে বাঁচাইতে এক ধর্মের মানুষ পালা করিয়া পাহারা দিয়াছেন অন্য ধর্মাবলম্বীদের পাড়া, আশ্রয় দিতে খুলিয়া দিয়াছেন ধর্মীয় স্থান। ঠিক যেমন আসন্ন বিপদের আশঙ্কা নাওয়ের মাঝি আর সুতাকলের মজুরকে পরস্পরের কাছে আনিয়াছিল। দুই বিবদমান ধর্মের পরিচিতি ভুলিয়া তাঁহারা পরস্পরের জন্য উদ্বিগ্ন হইয়াছিল। এই সহমর্মিতা যত দিন বাঁচিয়া থাকিবে, যত দিন এক জন হিন্দুও রাত জাগিবে এক জন মুসলমানকে ন্যায়বিচার দিতে, এক জন নাওয়ের মাঝি প্রার্থনা করিবে তাঁর সদ্যপরিচিত মুসলমান বন্ধুটি যেন নিরাপদে পরিবারের কাছে ফিরিয়া যাইতে পারে, তত দিনই লাভ, ‘দ্যাশের’ লাভ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE