Advertisement
E-Paper

তবু বলি, সাবধান

কংগ্রেস নেতারা আলিকে ধরে থাকুন, তাঁর দল বজরংবলীকেই ধরে থাকবে! কংগ্রেস টিপুকে ভালবাসে, হনুমানকে নয়! (আসাদউদ্দিন) ওয়াইসিকে এখনই ভারত ছাড়তে হবে! ইত্যাদি। দেখেশুনে এক সাংবাদিক তাঁর নাম দিলেন ‘দ্য গ্রেট ন্যাশনাল পোলারাইজ়ার’— মেরুকরণের জাতীয় মহানেতা!

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
বিদ্বেষবিষাক্ত: উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নির্বাচনী প্রচারসভায় বক্তৃতারত, অজমেঢ়, রাজস্থান, ২৮ নভেম্বর। পিটিআই

বিদ্বেষবিষাক্ত: উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নির্বাচনী প্রচারসভায় বক্তৃতারত, অজমেঢ়, রাজস্থান, ২৮ নভেম্বর। পিটিআই

এ বার ভোটের আগে বিজেপির নতুন তারকা-প্রচারক যোগী আদিত্যনাথ সমানে উড়ে বেড়াচ্ছিলেন রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানার এ ধার থেকে ও ধার। নরেন্দ্র মোদীর থেকেও এ বার গৈরিক প্রচারক হিসেবে তাঁর বেশি গুরুত্ব ছিল। তিনি একাই ৭৪টি সভা করলেন, মোদী বা অমিত শাহের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতি সভায় বিরাট ভিড় তাঁকে ছেঁকে ধরল, আকাশবাতাস ফালাফালা করে দিল তাঁর চটকদার হুঙ্কারের বিষ: যারা বিরিয়ানি খায়, তাদের শিক্ষা দিতে হবে! কংগ্রেস নেতারা আলিকে ধরে থাকুন, তাঁর দল বজরংবলীকেই ধরে থাকবে! কংগ্রেস টিপুকে ভালবাসে, হনুমানকে নয়! (আসাদউদ্দিন) ওয়াইসিকে এখনই ভারত ছাড়তে হবে! ইত্যাদি। দেখেশুনে এক সাংবাদিক তাঁর নাম দিলেন ‘দ্য গ্রেট ন্যাশনাল পোলারাইজ়ার’— মেরুকরণের জাতীয় মহানেতা! হিন্দুত্বের বুলি কপচানোর জন্য তো অনেক সঙ্ঘীই আছেন, কিন্তু নরেন্দ্র মোদী আর অমিত শাহের হিসেবে, যোগী আদিত্যনাথের গুরুত্ব এখানেই যে কেবল কথার ‘হিন্দুত্ব’ নয়, হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠার ‘কাজ’টাও তিনি ‘হাতে কলমে’ করে থাকেন। মুঘলসরাইকে যিনি দীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন করেন, তাঁকে দিয়ে ‘হবে’। তাঁর হাতে ছাড়লে হায়দরাবাদ এক দিন ভাগ্যনগর হবেই।

ভোটফল বলছে, এ হেন গৈরিক সুপারম্যান-এর বিরিয়ানি-বিরোধিতা কিংবা বজরংবলী-নামা শুনতে যাঁরা ভিড় জমিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আদৌ গেরুয়াকে ভোট দেননি। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোট ও ২০১৩ সালের বিধানসভা ভোটের সাপেক্ষে মধ্য ভারতের এই রাজ্যগুলিতে ২০১৮ সালে যত লোক নিজেদের ভোট পদ্মচিহ্ন থেকে সরিয়ে নিয়েছেন, খোঁজ করলে দেখা যাবে, তাঁদের অনেকেই হিন্দুত্বের গরমাগরম বুলি শুনতে গিয়েছিলেন, তবুও হিন্দুত্বের দলকে ভোট দেননি। এইখানেই ভারতীয় জনতার মজা— কখন যে তাঁরা সার্কাস দেখছেন, আর কখন যে নতুন নেতার খোঁজ করছেন, বোঝার সাধ্য কার।

এটুকু তবে বলাই যায় যে, হিন্দুত্ববাদের বিকৃত বয়ান ও ফাঁপা স্লোগান দিয়ে যে জনতাকে জিতে নেওয়া যাবে না, সেটা নেতারা বোঝেননি। রাজস্থানে একের পর এক মানবনিধন ঘটেছে গোহত্যার অভিযোগে, সেই নিধনবাদী হিন্দুত্বের জয়গাথা গাওয়া হয়েছে নির্বাচনী সভায়, কিন্তু শেষ অবধি ভোটের দান উল্টে গিয়েছে। ছত্তীসগঢ়ে নির্বাচনী প্রচারে বার বার উঠে এসেছে বিজেপির প্রিয় থিম ‘আরবান নকশাল’দের ‘দেশবিরোধিতা’। উত্তরে মানুষ কী রায় দিয়েছেন, দেখে নিশ্চয়ই আজ মোদী-যোগীদের রাতের ঘুম বন্ধ।

একটা ভুল বোঝার অবকাশ থেকে যেতে পারে। সেটা দূর করতে বলা দরকার— মুসলমানবিদ্বেষ দিয়ে মানুষের মন জেতা যায় না, এত বড় দাবি কিন্তু করছি না, অন্তত এখনও নয়। ঠিকই— ‘হিন্দুত্ব দিয়েই ভোট জেতা যায়’, এটা যেমন একটা সরলীকরণ, সে রকমই ‘হিন্দুত্ব দিয়ে কখনওই ভোট জেতা যায় না’, এটাও একটা অতিসরলীকৃত দাবি। ২০১৩ সালে মুজফ্ফরনগরের দাঙ্গার পর ২০১৪ সালে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির বাক্সে ভোটের ঢল কি এত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারি? আসলে যা বলতে চাইছি— সব পরিস্থিতিতে হিন্দুত্বের তাস সমান কাজ করে না। যে নেতারা ভাবেন, হিন্দুত্ব দিয়ে যে কোনও পরিস্থিতিতে ভোট জিতে নেওয়া যায়— তাঁরা রাজনীতির নাড়ি দেখতে জানেন না, মানুষের মেজাজের পারদ-অঙ্কও পড়তে জানেন না। হাতে টাকা নেই, বাজারে চাকরি নেই, ব্যবসাবাণিজ্য থেকে চাষবাস থেকে শিল্পকারখানা, সব জায়গায় মানুষ হাঁসফাঁস করছেন, এ দিকে মনে করা হচ্ছে যে, ‘রামরাজ্য এই এল বলে’ রব তুললেই, কিংবা সমর্থকদের হনুমান সাজিয়ে হাতে ইয়া বড় গদা ধরিয়ে দিলেই, মানুষ সব দুঃখযন্ত্রণা ভুলে রাম, হনুমান এবং গরুকে ভোট দিতে দলে দলে ছুটবেন— এর মধ্যে একটা অতিশয় রকমের বাড়াবাড়ি আছে। আর, কে না জানে, বাড়াবাড়ির লক্ষ্মণরেখাটা কোথায় পার হয়ে যাচ্ছে, সেটাই যে নেতা বোঝেন না, তিনি আসলে দেশের মানুষকে একফোঁটাও সম্মান করেন না, ‘হদ্দ নির্বোধ’ ভাবেন!

মোদীর ‘বিকাশ’ ম্যাজিক দূরস্থান, যোগীর ‘রাম-হনুমান’ ম্যাজিকও ফেল করার পর বিজেপির হেভিওয়েটরা কে জানে কী ভাবছেন। সাড়ে চার বছর ধরে মোদী-শাহ যুগলের ভাবটা ছিল এমন যে, তাঁরা যে কায়দায় এগোচ্ছেন, তাতে বিজেপির টিকিটে একটা ল্যাম্পপোস্টকে দাঁড় করিয়ে দিলেও সে জিতে যাবে। ফলে আইনশৃঙ্খলা, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিদেশনীতি, সব জলাঞ্জলি দিয়ে হিন্দুত্বেই সবটুকু আশা তাঁরা সমর্পণ করে বসেছিলেন। নয়তো যোগীকে এতটা আলো তাঁরা ছেড়ে দিতেন না।

একটা প্রশ্ন উঠতে পারে: হিন্দুত্ব দিয়ে যদি বর্তমান পরিস্থিতিতে তেমন কাজ না হয়, তা হলে রাহুল গাঁধীই বা নিজের গোত্র বা পৈতে নিয়ে এত ভাবিত কেন? তা হলে বিজেপি আর কংগ্রেসের তফাত রইল কোথায়। আর তফাত যদি অতই কম হয়, তা হলে তো বলতে হবে, বিজেপির পরাজয়ের পিছনে হিন্দুত্বের কোনওই ভূমিকা নেই!

বাস্তবিক, গুজরাত বিধানসভা ভোটের সময়েও এই প্রশ্ন উঠেছিল। ভোট এলেই কংগ্রেস নরম হিন্দুত্বের দিকে ঝুঁকে পড়ে, এই অভিযোগ তো বহু পুরনো, রাহুল গাঁধীর বাপ-ঠাকুমার কাল থেকে চলে আসছে। রসিকতারও শেষ নেই এ নিয়ে। পেপসি লাইট-এর মতো কংগ্রেস নাম পেয়েছে ‘বিজেপি লাইট’। কেবল রাহুল গাঁধীই বা কেন। দিগ্বিজয় সিংহ নিজের রাজ্যে গোমাংস নিষিদ্ধ করার গৌরবে আটখানা হয়েছেন। কমল নাথ মধ্যপ্রদেশের প্রতি জেলায় গোশালা তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কেরলে শবরীমালা মন্দিরে মহিলা ভক্ত প্রবেশে বাধাদানের আসরে কংগ্রেস সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। শশী তারুর বইও লিখেছেন, ‘হোয়াই আই অ্যাম আ হিন্দু’। কংগ্রেস যদি বিজেপি লাইট হওয়ার সাধনায় মাতে, কংগ্রেসের কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে কি? মনে পড়ে, ঠিক এই যুক্তিটাই দিয়েছিলাম আমিও (আবাপ, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭)।

ইতিমধ্যে অবশ্য, যুক্তিটা না পাল্টালেও যুক্তির প্রাসঙ্গিকতাটা খানিক পাল্টেছে। মানতেই হবে— গত কয়েক বছরের বিজেপি রাজত্বের ফল হয়েছে এই যে, এক ধরনের আগলছাড়া হিন্দুত্বে দেশটা ছেয়ে গিয়েছে। হিন্দুত্ব তাস খেলে ভোট আসুক না আসুক, হিন্দুত্বের সেই বৃহত্তর আবহাওয়াটাকে কিন্তু কোনও মতেই অস্বীকার করা যায় না। ভোটের জয়-পরাজয়ের চেয়ে সেটা অনেক বড় ব্যাপার, ব্যাপকতর ঘটনা। সাড়ে চার বছর ধরে যে দৈত্য একটু একটু করে গ্রাস করেছে দেশের আকাশবাতাস, তাকে তো আজ আর চট করে বোতলে পোরার আশা করা যায় না। সঙ্কীর্ণ বিদ্বেষবিষের এটাই ভয়াবহতা। ইচ্ছে করলেই তাকে কার্বলিক অ্যাসিডের মতো চার পাশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু এক বার ছড়ানো হয়ে গেলে ইচ্ছে করলেও তাকে আর তুলে ফেলা যায় না।

ছোটখাটো ঘটনায় প্রতি দিন এর প্রমাণ। এই যে ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ গোয়ায় গিয়ে বন্ধুপরিবৃত লাঞ্চে বিফ খেতে খেতে একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে ফেলে হুমকির বন্যায় পর দিন ক্ষমা চেয়ে সেটা তুলে ফেলতে বাধ্য হলেন, কিংবা মেঘালয় হাইকোর্টের বিচারপতি ঘোষণা করে দিলেন যে একা নরেন্দ্র মোদীই পারেন ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে— ২০১৯ সালে বিজেপি হারলেও কিন্তু এই ‘পরিবর্তিত’ ভারত চট করে পাল্টাবে না। তাই, আর সব ছেড়ে হিন্দুত্ব আঁকড়ে বসে থাকলে যেমন রাজনৈতিক সাফল্য পাওয়া কঠিন, ঠিক একই ভাবে হিন্দু ভারতকে একেবারে পাত্তা না দিয়েও রাজনীতিতে নম্বর তোলা আজ কঠিন। এই প্রেক্ষিতেই রাহুল গাঁধীদের বর্তমান কাজকর্মকে বুঝতে হবে। তাঁরা বলতেই পারেন, ব্যক্তিগত ভাবে তাঁদের সঙ্গে যে হিন্দু ধর্মের সম্পর্ক আছে, এইটুকুই তাঁরা প্রমাণ করতে চান, কিন্তু হিন্দু ধর্মের দোহাই দিয়ে বিদ্বেষ ও বিরোধিতার রাজনীতি করতে চান না। তারুরের একটি উদ্ধৃতি এই প্রসঙ্গে জরুরি ঠেকতে পারে: ‘হিন্দুইজ়ম রেসপেক্টেড বাই কংগ্রেস লিডার্স ইজ় ইনক্লুসিভ অ্যান্ড নন-জাজমেন্টাল, হোয়্যারঅ্যাজ় হিন্দুত্ব ইজ় আ পলিটিক্যাল ডকট্রিন বেসড অন এক্সক্লুশন।’ অর্থাৎ, ‘হিন্দু ধর্ম ও তার আদর্শ’ আর ‘রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ’ এই দু’টি জিনিস যে আলাদা, এবং পার্থক্যটা মাথায় রেখে প্রথমটাকে যে মর্যাদা দেওয়া দরকার, পরিবর্তিত ভারতে এটুকু না মেনে বোধ হয় আর রাজনীতি করা সম্ভব নয়। কংগ্রেস যদি আপাতত অহিন্দুদের সম্মান করার পাশাপাশি হিন্দু ধর্মকেও খানিক জায়গা দিয়ে চলে, তাকে তাই আজ গাল দেওয়া কঠিন। ভোটের ফল যা-ই হোক না কেন, দেশটা যে অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে।

বরং, সাবধানী আশা থাকুক, এই ভোটে হিন্দুত্বের প্রান্তিক গুরুত্ব থেকে বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসও একটা বার্তা পাবে। একটা প্রত্যয় পাবে। ‘বিজেপি লাইট’ হওয়ার দৌড়ে একটু লাগাম টানবে!

Hinduism Congress BJP Yogi Adityanath
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy