দেখলি? ক্রোয়েশিয়ার খেলাটা দেখলি?’’ মহা উত্তেজিত সূর্য। ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে মেসিরা বিদায় হওয়ার পর থেকেই তুমুল ক্রোয়েশিয়া-ভক্ত।
‘‘একদম গ্রুপ লিগের ম্যাচ থেকেই, বুঝলি তো, মনে হচ্ছিল ক্রোয়েশিয়া অনেক দূর যাবে।’’ বিশেষজ্ঞের মতামত দেয় তপেশ।
‘‘বলিস কী! আর্জেন্টিনা না, ব্রাজ়িল না, জার্মানি না, ক্রোয়েশিয়া অনেক দূর যাবে, তুই জানতিস?’’ শিশির আপত্তি করে।
‘‘তা গ্রুপ লিগে যখন আর্জেন্টিনা ক্রোয়েশিয়ার কাছে তিন গোল খেল, তখন বলেছিলি কেন, অঘটন?’’ শিবুদা মুখ খোলেন। অনেক কিছুতেই আগ্রহ নেই শিবুদার, সেই লিস্টে ফুটবল একেবারে ওপরের দিকে। বিশ্বকাপ শুরু হওয়া ইস্তক পাঁচন গেলা মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সূর্য-তপেশদের লম্বা আড্ডা চলছিল যখন, তখন দু’হাতের তর্জনী একটা ক্লকওয়াইজ় আর অন্যটা অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ় ঘোরাচ্ছিলেন। আড্ডার কথাগুলো যে তাঁর কান এড়াচ্ছে না, এত ক্ষণে বোঝা গেল।
‘‘সে তো ভালবাসা।’’ উত্তর দেয় তপেশ। ‘‘না হলে এই আর্জেন্টিনা যে বেশি দূর যাবে না, তা আমি গোড়া থেকেই জানতাম। এ কি বার্সেলোনার টিম? একা মেসি কী করত? এদের একটা ইনিয়েস্তা আছে, না একটা সুয়ারেজ় আছে? পাসটা বাড়াবে কে? অবশ্য, আপনাকে বলে লাভ নেই, হয়তো নামই শোনেননি এদের।’’
‘‘সেটা ভুল বলিসনি। কিন্তু, আসল কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছিস। ক্রোয়েশিয়া ফাইনালে যাবে, আর আর্জেন্টিনা সেকেন্ড রাউন্ডেই বিদায় হবে, আগে থেকেই যদি জানতিস, তা হলে আর্জেন্টিনার পক্ষে বাজি ধরে বেড়াচ্ছিলি কেন?’’ শিবুদা ছাড়ার পাত্র নন। এ বার তপেশ থমকায়। গেল সপ্তাহেই শিশিরের কাছে পাঁচ হাজার টাকা খেসারত দিতে হয়েছে, ফ্রান্সের কাছে হেরে।
‘‘এটা তপেশ কেন, কারও পক্ষেই কি জানা সম্ভব? নব্বই মিনিটের মোট ৫৪০০ সেকেন্ডে ঠিক কী কী ঘটতে পারে, কোন ঘটনার মোড় থেকে পাল্টে যেতে পারে পুরো ঘটনাক্রম, সেটা আগে থেকে আঁচ করবে কী করে? আর একটা নয়, পর পর তিন-চারটে ম্যাচের গল্প পুরোটা আগে থাকতেই জানতাম বললেই হল?’’ এই আড্ডায় সূর্যকে একটানা এতগুলো কথা বলতে কেউ শোনেনি।
‘‘সাবাশ, সূর্য! একদম মোক্ষম প্রশ্নটা করেছিস।’’ শিবুদা নড়ে বসলেন। ‘‘নাসিম তালেবের নাম শুনেছিস, তপেশ? বছর কয়েক আগে ‘দ্য ব্ল্যাক সোয়ান’ নামে একটা বই লিখে বিস্তর নামডাক হয়েছিল তালেবের। তালেব বলেছিলেন, যে ঘটনা আগে থেকে বোঝার কোনও সম্ভাবনামাত্র নেই, সেটা ঘটে যাওয়ার পরও মানুষ বিশ্বাস করে, আগে থেকেই পুরোটা বোঝা যাচ্ছিল। বস্তুত, ঘটনাটা এমনই অনিবার্য ছিল যে অন্য কিছু ঘটার কোনও উপায়ই ছিল না। সাইকোলজিতে প্রচুর গবেষণা এই বিশ্বাসটাকে— ঠিক করে বললে, ভ্রান্ত বিশ্বাস— নিয়ে। এর ভাল নাম হাইন্ডসাইট বায়াস। আর ডাকনাম কী জানিস? ‘আই-নিউ-ইট-অল-অ্যালং’ বায়াস। বাংলায়, ‘আমি-তখনই-জানতাম’ ভ্রান্তি।’’
‘‘জানতাম, ঠিক ফুটবলকে পাশ কাটিয়ে নিজের লাইনে ঢুকে পড়বেন।’’ মুচকি হাসে তপেশ।
‘‘এটাও জানতিস কি, যে গোপাল এখনও চা দিয়ে যাবে না?’’ প্রশ্নটা করেই ‘এই গোপাল’ বলে হাঁক পাড়েন শিবুদা। গোপাল এসে চায়ের কাপ নামিয়ে যায়। আয়েশ করে চুমুক দেন শিবুদা। একটা সিগারেট ধরিয়ে ধীরেসুস্থে ধোঁয়া ছাড়েন। তার পর প্রশ্ন করেন, ‘‘এই ‘আমি-তখনই-জানতাম’ ভ্রান্তিটা কেন হয়, জানিস? শুধু তো তপেশের মতো অপোগণ্ডরা নয়, দুনিয়া জুড়ে সর্ব ক্ষণ লোকে বলছে, এ আমি আগেই জানতাম। কেন বল দিকি?’’
এই প্রশ্ন হল ধরতাই। শিশিররা চুপ করে থাকে।
‘‘কারণটা হল, আমাদের মনগুলো আসলে গল্প বানানোর মেশিন। যত ক্ষণ অবধি না একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প তৈরি হচ্ছে, আমাদের মন ভয়ানক অস্বস্তির মধ্যে থাকে।’’ আরও একটা সিগারেট ধরান শিবুদা। তার পর, খানিক আপন মনেই বলতে থাকেন, ‘‘গল্প বানানোটা অবশ্য স্বাভাবিক। ভেবে দেখ, চার পাশে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, যুক্তি দিয়ে সেগুলোর একটাকে অন্যটার সঙ্গে জুড়তে পারি বলেই তো মানে তৈরি করতে পারি। ধর, একটা কড়াই উনুনে বসানো আছে, সেটা ধরলে হাত পুড়ে যাবে— এটা কিন্তু আমাদের মন অভিজ্ঞতা থেকে গল্প বানাতে জানে বলেই আমরা জানতে পারি। মনুষ্যজন্মের একেবারে বেসিক ট্রেনিং হল এই গল্প বানাতে পারা। মাস ছয়েকের বাচ্চাও কিন্তু শিখে যায়, খাট থেকে মেঝেতে পড়লে ব্যথা লাগবে। দেখবি, বহু বাচ্চাই আগে বালিশটাকে ঠেলে ঠেলে মাটিতে ফেলে, তার পর সেটার ওপর পড়ে। এটাই গল্প বানানোর ক্ষমতার মাহাত্ম্য।
‘‘মুশকিলটা কোথায় হয়, জানিস? চোখের সামনে যেটুকু আছে, যেটুকু দেখতে পাচ্ছি, অথবা যেটুকু আমাদের আগের অভিজ্ঞতায় মনে জমা হয়েছে, তার বাইরে আমাদের মন আর গল্প বানাতে পারে না। ফলে, যে জিনিসটা এখনও অজানা, তার সম্পর্কে ঠিকঠাক গল্প তৈরি করা মনের সাধ্যের বাইরে। কিন্তু, গল্প না বানিয়েও মন থাকতে পারে না। তখনই, যেটুকু জানে, তা দিয়েই না-জানা অংশগুলোর ফাঁক ভরাট করে গল্প তৈরি করে মন।’’
‘‘সে তো বুঝলাম।’’ তপেশ যথারীতি অধৈর্য, ‘‘এর সঙ্গে হাইন্ডসাইট বায়াস কোত্থেকে এল? ডায়মন্ড হারবার-রানাঘাট-তিব্বত?’’
‘‘এত বছরেও শিখলি না যে শিবু সেন অবান্তর কথা বলে না।’’ তপেশকে চুপ করিয়ে দেন শিবুদা। ‘‘সম্পর্ক আছে। ঘোরতর। ক্রোয়েশিয়া সেমিফাইনাল-ফাইনালে ওঠার পরই যে তোর মনে হল, তুই আগে থেকেই জানতিস ওরা এ বার ভাল খেলবে, সেটা কী করে হল? তোর মন গল্প বানাল বলেই। কী রকম গল্প, সেটা শোন। ক্রোয়েশিয়া ফাইনালে ওঠার পর— অথবা আগেই, সেমিফাইনাল খেলার সময়— তুই খুঁজে নিলি, কোন কোন কারণে ক্রোয়েশিয়া জিতছে। সেগুলোকে তোর মন পর পর জুড়ে নিল, যুক্তির সুতোয়। ব্যস, তুই একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প পেয়ে গেলি। তোর মন দেখারই চেষ্টা করল না যে কোথায় কোথায় ওদের হেরে যাওয়ার মতো জিনিসও ছিল। অথবা, কোনখানে নেহাত ঘটনাক্রম বা ভাগ্য এসে স্থির করে দিল খেলার ফলাফল। বলে রাখছি, শোন, যদি আর্জেন্টিনা জিতত, তোর মন তখনও গল্প তৈরি করে নিত। তখন তুই জানতিস যে আর্জেন্টিনা জিতবে, এটা তুই আগেই জানতিস। এই যেমন, ভোটের রেজ়াল্ট বেরোলে টেলিভিশনের স্টুডিয়োতে বসে যাঁরা ব্যাখ্যা করেন, তাঁরা একের পর এক ঘটনার কথা বলে বুঝিয়ে দেন, কেন এই ফলটাই হওয়ার ছিল। উল্টো ফল হলে তাঁদের মন উল্টো ব্যাখ্যা দিত।’’
‘‘মাথাটা গুলিয়ে দিলেন।’’ শিশির ভ্যাবাচ্যাকা।
‘‘মাথা গোলানোর এই তো শুরু, শিশিরবাবু।’’ উত্তর দেন শিবুদা। ‘‘হাইন্ডসাইট বায়াসের খপ্পরে পড়ে চাকরির দুনিয়ায় কত লোক লেজেগোবরে হচ্ছে, খোঁজ রাখিস? ধর, তপেশ নিজের বসকে একটা নতুন আইডিয়া দিল। নতুন ধরনের বিজ্ঞাপন করবে। বস বললেন, বেশ তো, করো। তপেশও করল, আর পুরো ব্যাপারটা মুখ থুবড়ে পড়ল। ঘোর সম্ভাবনা, তপেশের বসের তখন মনে হবে, তিনি আগেই জানতেন যে পুরো ব্যাপারটা ব্যর্থ হতে বাধ্য। কেন, সেটা একেবারে খাতায়-কলমে দেখিয়েও দেবেন— কোথায় কী কী গোলমাল ছিল, তার হদ্দমুদ্দ। তাঁর দোষ নয়। আইডিয়াটা ফ্লপ করার পরই তাঁর মন খুঁজে বার করবে ব্যর্থতার সম্ভাব্য কারণগুলো, আর সাজিয়ে ফেলবে একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প। ইয়ার্কি নয়, পৃথিবী জুড়ে কর্পোরেট দুনিয়ায় হাইন্ডসাইট বায়াস একটা জ্বলজ্যান্ত সমস্যা।
‘‘কর্পোরেট অশান্তি তো তুচ্ছ, ২০০৭ সালে আমেরিকার সাবপ্রাইম ক্রাইসিসের পরও যে কত লোক ‘আগেই জানতুম’ বলে প্রবন্ধ লিখল, কাগজে বিবৃতি দিল, সে কথা মনে আছে? আমেরিকার ব্যাঙ্কগুলো যে ভাবে বন্ধকের চেয়ে ঢের বেশি অঙ্কের ঋণ বিলোচ্ছিল, তাতে এমন সঙ্কট অবধারিত, এ কথা তো রামা-শ্যামাও জানত— এই ছিল মোদ্দা বক্তব্য। ভেবে দেখ, তালেব যে ঘটনাকে ‘ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্ট’ বলেছেন, মানে, যার ঘটার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ, এবং অতীতে যার কোনও অভিজ্ঞতা নেই— তেমন একটা ঘটনাও ঘটে যাওয়ার পর তার যুক্তিগ্রাহ্য গল্প বানাতে, এই সেই গল্পটা আগেই জানতাম বলে বিশ্বাস করতেও মানুষের সমস্যা হয়নি।’’
‘‘এটা যে আগে জানা সম্ভব নয়, যারা জানতাম বলছিল, তারা কথাটা বুঝল না?’’ শিশিরের প্রশ্ন।
‘‘বুঝল না, কারণ না বোঝারই কথা।’’ উত্তর দেন শিবুদা। ‘‘বিবর্তন আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। নিজের জানার ওপর ভরসা রাখতেও। আমাদের মন বিশ্বাস করতেই রাজি নয় যে আমাদের ‘আগে থেকে জানা’টা আসলে ঘটনার পর কিছু বাছাই করা মুহূর্তের সঙ্গে অতীতের অভিজ্ঞতার সুবিধাবাদী মিশেল মাত্র। ‘আমি জানতাম না’ বা ‘আমি বুঝতে পারিনি’, এটা মানতে আমাদের মন নিতান্ত নারাজ। তপেশের মন কি মানবে, সেকেন্ড রাউন্ডেই আর্জেন্টিনা ছিটকে যাবে, সেটা ও একেবারেই জানত না?’’
‘‘বুঝলাম।’’ তপেশ উঠে পড়ে। ‘‘আজ রাত্রে কে জিতবে, শিবুদা?’’
‘‘এখন কেন, কাল ম্যাচের পর বলব তো আমি আগেই জানতাম।’’ শিবুদা মুচকি হাসেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy