Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

এ ক’দিনেই বাতাসে ধুলিকণা কমে গিয়েছে

এত দিন ধরে কম অত্যাচার করিনি আমরা, করোনা কি তাই এল ফিরে, সে উত্তরই খুঁজছেন পুষ্পক পাল অন্য ভাবে বললে বলা যায় যে, স্থান ও কালের কোনও প্রদত্ত বিন্দুতে যে সব অবস্থা মানুষকে পরিবেষ্টন করে রাখে তাদের সামগ্রিক অবস্থাই হল পরিবেশ।

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২০ ০৫:৪১
Share: Save:

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসজনিত রোগ কোভিড ১৯ অতিমারি ঘোষিত হয়েছে। দেশ জুড়ে লকডাউন সে কারণেই। অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্র ছাড়া সব কিছু বন্ধ। এ অবস্থায় একটু নজর দেওয়া যাক আমাদের পরিবেশের উপর। আমরা জানি যে জীব (উদ্ভিদ বা প্রাণী) তাদের জীবনচক্রের যে কোনও সময়ে যে সব জৈব ও অজৈব কারণের দ্বারা প্রভাবিত হয় সেই কারণগুলিকেই পরিবেশ বলে। অন্য ভাবে বললে বলা যায় যে, স্থান ও কালের কোনও প্রদত্ত বিন্দুতে যে সব অবস্থা মানুষকে পরিবেষ্টন করে রাখে তাদের সামগ্রিক অবস্থাই হল পরিবেশ। এই পরিবেশকে আমরা দুটো ভাগে ভাগ করতে পারি, প্রাকৃতিক পরিবেশ বা মানুষের তৈরি পরিবেশ। প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে মাটি, জল, বায়ু, আলো, পাহাড়, বন-পাহাড়। প্রাণিকুল ও অণুজীব সকলেই এর অন্তর্গত। আর মানুষের তৈরি পরিবেশ বলতে আমরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে বুঝি। প্রাকৃতিক পরিবেশ সর্বদা পরিবর্তনশীল। পৃথিবী সৃষ্টির সময় থেকে আজ পর্যন্ত নানা পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তন কখনও ধীরে, কখনও দ্রুত গতিতে, কখনও আকস্মি কভাবে কখনও বা মানুষের দ্বারা পরিবর্তিত হয়েছে। মানুষ তার জীবন ধারণের জন্যে প্রকৃতি থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে। মানুষের চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা পরিবেশের আছে। যেটাকে আমরা পরিবেশের বহন ক্ষমতা বলে থাকি। কিন্তু মানুষের লোভ মেটানোর জন্য সে আদৌ তৈরি নয়। আর অতিরিক্ত লোভের কারণেই তৈরি হয় মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে সংঘাত। পরিবেশ হতে থাকে রিক্ত, নিঃস্ব এবং দূষিত। দূষিত, অসুস্থ পরিবেশ তার সব বিষ বাস্প অভিশাপ ফিরিয়ে দেয় মানুষকেই। পরিবেশের প্রত্যেকটি উপাদান পরস্পর আন্তঃসম্পর্ক যুক্ত ও কতকগুলি নিয়মের মাধ্যমে চলে। আর তার প্রবণতা হল সর্বদা ভারসাম্য বজায় রেখে চলা।

পরিবেশ থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করার কথা ছিল আমাদের। কিন্তু আমরা পরিবেশকে লুট করেছি। অতি দ্রুত গতিতে পরিবেশ পরিবর্তিত হয়েছে। দূষিত হয়েছে। পরিবেশ হয়েছে জরাক্রান্ত। ধবংস হয়েছে জীব বৈচিত্র্য। ফলে দৌরাত্ম্য বেড়েছে রোগ জীবাণুদের। তাই আজ আমরা ঘরবন্দি হয়েছি। চলছে না যানবাহন। বন্ধ শিক্ষালয়, কলকারখানা। হচ্ছে না শব্দ দূষণও। এখন গাছের পাতা পড়ার শব্দ যার প্রাবল্য ১০ থেকে ১৫ ডেসিবেল সেটাও শুনতে পাচ্ছি খুব পরিষ্কার ভাবে। দিনের শেষে বিকেল বেলা এ ছাদের মানুষ দূরের ওই ছাদের বাচ্চার আবৃত্তি শুনছে। যার প্রাবল্য মাত্র ৫৫ ডেসিবেল। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা নানা জাতের নানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। সন্ধ্যা হতে না হতে আকাশে কত তারা-রোহিণী, স্বাতী, চিত্রা, লুব্ধক, ধ্রুবতারা আরও কতশত। কিন্তু এ দৃশ্য আগে শহর থেকে তো দেখা যেত না। তা হলে দৃশ্যমানতা বেড়েছে নিশ্চয়। তার মানে বাতাসের ধুলিকণা কমেছে। বাতাসে ভাসমাণ ধুলিকণার সহনমাত্রা হল প্রতি ঘন মিটারে একশ মাইক্রোগ্রাম। এখন বর্তমানে আশা করছি বাতাসের ধুলিকণার পরিমাণটা সহনমাত্রার নীচেই হবে।

জীবের অস্তিত্ব বজায় রাখতে বায়ূমণ্ডলের বিশুদ্ধতাও খুব জরুরি। এই বায়ুমণ্ডলের উপাদানগুলো হল নাইট্রজেন, অক্সিজেন, আর্গন, কার্বনডাই অক্সাইড, বিভিন্ন নিষ্ক্রিয় গ্যাস এবং জলীয় বাস্পের নির্দিষ্ট অনুপাত। কিন্তু ক্রমাগত বায়ুদূষণের ফলে জীবের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হয়ে যাচ্ছিল। দূষক গ্যাস যেমন কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড, বিভিন্ন হাইড্রোকার্বন প্রভৃতি ক্রমাগত বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করে গিয়েছে। এই মুহূর্তে কোভিড ১৯ এর কারণে লকডাউনের জন্য আমাদের আশপাশে কোথাও জলাভূমি বন্ধ হচ্ছে না, কোথাও বৃক্ষচ্ছেদন হচ্ছে না, যানবাহন কলকারখানার ধোঁয়া বাতাসে মিশছে না। ধানের খেতে বগারি পাখির নিধন চলছে না। এই ক’দিনেই মানুষ প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারছেন। চোখ জ্বালা করছে না। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় বায়ুদূষণ কমেছে। প্রকৃতি তার ভারসাম্যে ফিরছে। জলাভূমি, জলাশয়গুলো হল প্রকৃতির কিডনি। লকডাউনের সময় এই কিডনিগুলো নিজস্ব ছন্দে কাজ করতে শুরু করেছে। সাধারণ ভাবে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে জলদূষণের মাত্রাও কমেছে। পুকুর জলাশয়ের জলের ওপর আর তেমন আঠালো কালো আস্তরণ নজরে আসছে না। জলে এই আস্তরণের ফলে মাছেদের শ্বাসকার্যের সমস্যা হত। মাছের ফুলকাতে ব্যকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়ে মাছের মড়ক দেখা যেত। শহরের কতকগুলো ভেড়ি সমীক্ষা করে দেখা গেল সেই প্রবণতা কমেছে। জলাশয়গুলি থেকে তেমন দুর্গন্ধও আসছে না। নজরে আসছে না জলের বিশেষ বর্ণও। বিশুদ্ধ জলের পিএইচ প্রায় সাত। এর কম হলে জল হয় আম্লিক তার বেশি হলে হয় ক্ষারীয়। জলের অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব উভয়ই জীবের পক্ষে ক্ষতিকর। যদিও জলাশয়গুলির পিএইচ মাপা হয়নি তবুও মাছেদের খাদ্যগ্রহণ, চলাফেরা, বেড়ে ওঠা প্রভৃতি দেখে ও ভাগীরথীতে শুশুকের দৃশ্যমানতায় এটা বলতে পারি জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণে সাম্যতা আসছে এবং জলের পিএইচ মাত্রা নির্দিষ্ট জায়গায় ফিরছে। এক কথায় জলদূষণও অনেক কমেছে।

গৃহবন্দি মানুষেরা চাইছেন ধরা থাক প্রাকৃতিক এই সুখানুভূতি। মাটির তলার জল স্তরের কোনও বৃদ্ধি যদিও এখনও হয়নি। বা নতুন করে গাছপালা লাগিয়ে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়নি। কিন্তু যেটা হয়েছে সেটা হল অপ্রয়োজনীয় অক্সিজেনের দহন বা অক্সিজেনের অপচয় কিছুটা কমানো গিয়েছে আর তাতেই প্রকৃতি আবার জীব বৈচিত্র্যে সাজতে বসেছে। নির্মল পরিবেশ আর জীব বৈচিত্র্য অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। আমরা জানি যে যত বেশি বৈচিত্র্য তত বেশি প্রাণের স্পন্দন। জীব বৈচিত্র্যই হল প্রাণের জীয়ন কাঠি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তা হলে কি আমরা উন্নয়ন চাই না? নিশ্চয় চাই। প্রকৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করেই আমাদের বাঁচতে হবে। প্রকৃতির কাছ থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে আমাদের বাঁচতে হবে। তার মানে এই নয় ভোগের জন্য অতিলোভে প্রকৃতিকে লুঠ করা। উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করছি। দেশের এক শতাংশ মানুষের কাছে বাহাত্তর শতাংশ সম্পদ কেন থাকবে? আমাদের সকলের সমান উন্নয়ন হওয়া দরকার। পরিবেশ সকলের কাছে সমান। পরিবেশের দেখভাল সকলকে সমান ভাবে করতে হবে। সে কৃষক হোক, পাইলট হোক বা আমলা হোক। আমাদের চাই স্থিতীশীল উন্নয়ন যা আগামী প্রজন্মের চাহিদাগুলো মেটানোর ক্ষমতা নষ্ট না করে বর্তমানের প্রয়োজনের সুরাহা করবে। পরিবেশ তাতে সুরক্ষিত থাকবে।

শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE