Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

পড়ে থাকবে ক্ষতবিক্ষত সমাজ

কেন? কোভিড-১৯’এর মতো তীব্র সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচতে আমরা নিজেদের সমাজ থেকে যত দূর সম্ভব বিচ্ছিন্ন করি।

পুনরজিৎ রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২০ ০০:০২
Share: Save:

'কোভিড-১৯'এর দরুণ সৃষ্টি হওয়া ভয়াবহ আর্থিক মন্দার সঙ্গে, এই জনস্বাস্থ্য সঙ্কটের ফলে, আরও একটি ঘটনা প্রায় অনিবার্য— সোশ্যাল ক্যাপিটাল বা সামাজিক পুঁজির বিপুল ক্ষয়। সামাজিক পুঁজি হল সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি ও বর্গের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের নেটওয়ার্ক, যার যথাযথ কার্যকারিতা একটা গোটা সমাজের সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এই সামাজিক পুঁজি, শ্রম এবং মূলধনের মতোই, একটি দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মন্দার ফলে যদি সামাজিক পুঁজির ক্ষয় ঘটে, তা অর্থনীতির ওপর মন্দার কুপ্রভাবকে আরও প্রকট এবং সুদূরপ্রসারী করে তুলতে বাধ্য।

সামাজিক পুঁজির প্রধান স্তম্ভ দুটি— এক, মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস; এবং দুই, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি মানুষের আস্থা। যে সমাজে এই দুই ধরনের বিশ্বাসের মাত্রা যত বেশি, সামাজিক পুঁজির নিরিখে সেই সমাজের অবস্থা তত উন্নত। কোভিড-১৯’এর মতো মহামারি সামাজিক পুঁজির এই দুটি স্তম্ভকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে।

আরও পড়ুন: গুমোট ঘরবন্দির মধ্যে হালকা হাওয়ার ঝলক, কিন্তু সংশয় রইল কিছু

কেন? কোভিড-১৯’এর মতো তীব্র সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচতে আমরা নিজেদের সমাজ থেকে যত দূর সম্ভব বিচ্ছিন্ন করি। প্রায় সব রকম সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। অচেনা মানুষদের সঙ্গে মেলামেশার তো প্রশ্নই ওঠে না। এর ফলে সমাজে তৈরি হয় গভীর সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এর ওপর, আমরা যদি মনে করি যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি এই সঙ্কটের মোকাবিলায় যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে না— যেমন, সরকারের তরফ থেকে যথেষ্ট টেস্টিং হচ্ছে না বলে মনে করি— তবে সেই প্রতিষ্ঠানগুলির ওপরও তীব্র ক্ষোভ জমা হতে থাকে আমাদের মনে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কারণগুলির জন্যই ক্ষয় হতে শুরু করে সামাজিক পুঁজির।

১৯১৮-র যে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’-এর সঙ্গে কোভিড-১৯ অতিমারির সাদৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেই অতিমারিটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সামাজিক পুঁজির ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছিল, ইটালি থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। স্প্যানিশ ফ্লু শুরু হয়েছিল ১৯১৮-র জানুয়ারি মাসে ইউরোপে। প্রায় দু’বছর ধরে চলা এই মারণ ইনফ্লুয়েনজ়ায় সারা বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রায় ৫০ কোটি মানুষ। মৃতের সংখ্যা পাঁচ কোটি।

গোটা পৃথিবী এই মারণব্যাধিকে সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে গিয়েছিল, কারণ যে ভাইরাসটি স্প্যানিশ ফ্লু-এর জন্য দায়ী ছিল, সেই এইচ১এন১ ভাইরাসের কোনও প্রতিষেধক টিকা তখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। তা ছাড়া, এই রোগ প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন দেশে যা যা পদক্ষেপ করা হয়েছিল (যেমন কোয়রান্টিন, লকডাউন, মাস্কের ব্যবহার), সেগুলিও ব্যর্থ হয়েছিল মহামারির দাপট কমাতে। ভয়াবহ মৃত্যুর হার এবং অপেক্ষাকৃত কমবয়সিরা বেশি আক্রান্ত হওয়ার ফলে এই মহামারিতে বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আক্রান্ত দেশগুলির সামাজিক কাঠামো। জনস্বাস্থ্য বিধি, সরকার ও মিডিয়ার তরফ থেকে লাগাতার সামাজিক মেলামেশা বন্ধ রাখার অনুরোধের পাশাপাশি ছিল গুজব— এই ব্যাধি আসলে শত্রুপক্ষের ছড়ানো জৈবিক অস্ত্র। সব মিলিয়ে সমাজে তৈরি হয়েছিল অবিশ্বাস আর সন্দেহের বাতাবরণ।

এই মহামারির ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামাজিক পুঁজির কতটা ক্ষয় হয়েছিল? ইটালির যে গবেষণাপত্রটির কথা আগে উল্লেখ করলাম, তাতে ব্যবহার করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘জেনারেল সোশ্যাল সার্ভে’র তথ্য। সেই তথ্যভান্ডারে আছে এই সার্ভেতে অংশগ্রহণকারী মানুষদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক মনোভাব সম্পর্কিত তথ্য। যেমন, এই সমীক্ষাতে তাঁদের প্রশ্ন করা হয়, তাঁরা কি মনে করেন যে সমাজে অন্যান্য মানুষদের বিশ্বাস করা যায়? তাঁদের কি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি যথেষ্ট আস্থা আছে? তাঁদের পূর্বপুরুষরা কবে, কোন দেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হিসেবে এসেছিলেন, সেই তথ্যও এর পাশাপাশি আছে।

এই তথ্যের ভিত্তিতে গবেষকরা তৈরি করলেন মানুষের গড় সামাজিক পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি আস্থার সূচক— স্প্যানিশ ফ্লু-র আগে এবং পরে, দুই সময়কালের জন্যই। সেই সূচকে মার্কিন নাগরিকদের ভাগ করে নেওয়া হল তাঁদের অভিবাসনের দেশের নিরিখে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেকটি দেশের বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকদের ক্ষেত্রেই, ১৯১৮-র আগের তুলনায়, ১৯১৮-র পরে মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি আস্থা অনেকটা হ্রাস পেয়েছিল। স্প্যানিশ ফ্লু-তে আক্রান্ত হয়ে ইউরোপের যে দেশে যত বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, সেই দেশের মানুষদের পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি আস্থাতেও তত বেশি ফাটল ধরেছিল।

আরও পড়ুন: করোনাকে হারাতে সংকল্প হোক দৃঢ়, চেষ্টা হোক সামগ্রিক

যদি ধরে নেওয়া যায় যে একটি সময়কালে একটি দেশের মানুষের গড় সামাজিক মনোভাব সেই সময়কালে সেই দেশের সামাজিক পুঁজির যথাযথ প্রতিফলন ঘটায়, তা হলে বলতে হয়, স্প্যানিশ ফ্লু-র ফলে সামাজিক পুঁজির ভয়ানক ক্ষয় হয়েছিল। যে দেশে মৃত্যুর হার যত বেশি ছিল, সামাজিক পুজির নিরিখে সেই দেশ তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

কোভিড-১৯’এর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামাজিক পুঁজির কতটা ক্ষয় হবে, সেটা সময়ই বলবে। কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের প্রস্তুত থাকা উচিত এই অতিমারির পরে একটা ক্ষতবিক্ষত সমাজের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য। সত্যিই যদি কোভিড-১৯’এর ফলে সামাজিক পুঁজির বিপুল ক্ষয় হয়, তা হলে আসন্ন অর্থনৈতিক সঙ্কটের আসল গভীরতা, ব্যাপ্তি এবং মেয়াদ আমাদের এখনকার অনুমানের চেয়েও ঢের বেশি হতে পারে। আমাদের মতো দেশে এর ফলে নানা রকম সামাজিক বৈষম্য এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা মারাত্মক চেহারা নিতে পারে। কাজেই, তৈরি থাকতে হবে ।

অসময়ে দীপাবলি পালন করা বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থালা বাটি বাজানো ইত্যাদি সেই তৈরি থাকার মধ্যে পড়ে কি না, এই প্রশ্নের ঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য অবশ্য কোনও পুরস্কার নেই।

শিল্প-অর্থনীতি বিভাগ, নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ড

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE