Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus Lockdown

করোনাকে হারাতে সংকল্প হোক দৃঢ়, চেষ্টা হোক সামগ্রিক

এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।

করোনা-প্রকোপের জেরে ও কড়া নিয়মকানুনের ফলে সব জায়গাতেই এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা।

করোনা-প্রকোপের জেরে ও কড়া নিয়মকানুনের ফলে সব জায়গাতেই এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা।

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২০ ১৭:৪৮
Share: Save:

‘‘ফাগুনের নবীন আনন্দে
গানখানি গাঁথিলাম ছন্দে।’’

আমাদের বাংলা যেমন ফাগুনেই রাঙা হয়, জার্মানিতে সেই পরশ আসতে প্রায় এপ্রিল। দৈনিক আলোর বরাদ্দ হঠাৎ বেড়ে যায়, তাপমাত্রার পারদ চড়ে, আর তার পিছু পিছুই মনোরম রৌদ্রজ্জ্বল নীল আকাশ জানান দেয়, বসন্ত এসে গিয়েছে এই পাহাড়ি উপত্যকায়। কিন্তু, বসন্তের ভাগ্যাকাশে এ বছর শ্রাবণের কুটিল মেঘ, অবশিষ্ট বিশ্বের মতন জার্মানিও ভয়াবহ ‘অতিমারি’র সম্মুখীন।

আমি যেখানে থাকি, মাইন নদীর তীরের ছোট্ট শহর উর্‌জবার্গ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আটপৌরে সাদামাটা এই ইউনিভার্সিটি-শহর, পাশ্চাত্যের আর পাঁচটি নিশিযাপনে অভ্যস্ত এবং আকাশচুম্বী অট্টালিকাময় নগরীগুলির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানকার বহমান জীবন যেন মাইনের মতোই নিঃশব্দ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া এ শহর পুনর্গঠনের পর, তা এখন নানা দামি ওয়াইন আর মূল্যবান ইতিহাসে ঠাসা। কাছের বড় শহর বলতে ফ্রাঙ্কফুর্ট, তা প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে। ছ’শো বছরের পুরনো ইউনিভার্সিটি অব উর্‌জবার্গে রসায়নে গবেষণার সূত্রে প্রায় দেড় বছর এ শহরের বাসিন্দা আমি। করোনা-প্রকোপের জেরে এবং কড়া নিয়মকানুনের ফলে সব জায়গাতেই এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। ঝলমলে ছোট্ট জনপদটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যেই তিনশো ছাড়িয়েছে। সুপারমার্কেট, ওষুধের দোকান বা কাজের জায়গা এখনও পর্যন্ত খোলা রয়েছে। মার্কেটের ভেতরে লাল দাগ দিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। শরীরচর্চা বা মুক্ত বাতাসের জন্য বাইরে বেরনোতে নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও দুইয়ের অধিক জমায়েতে জরিমানাও রয়েছে। আমার বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটির দূরত্ব প্রায় আড়াই কিলোমিটার। আগে বাসে যাতায়াত করলেও এখন পাহাড়ি চড়াই-উতরাই পথে সাইকেলই ভরসা। প্রত্যেক বাসই প্রায় যাত্রিহীন, এমনকি টিকিট চেক করার ব্যবস্থাও এখন বন্ধ। ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা (ব্যাচেলর ও মাস্টার্স কোর্স) বন্ধ থাকলেও গবেষণার ল্যাবরেটরিগুলো সরকারি ভাবে খোলা। তবে বেশির ভাগ ল্যাবই অনির্দিষ্ট কালের জন্য অঘোষিত ভাবে বন্ধ। আমি নিজে মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে দিন পনেরো ঘরে থেকেই কাজ সামলেছি। কিন্তু, আমাদের গবেষণার ক্ষেত্র পরীক্ষামূলক হওয়ার জন্য তা বাড়ি থেকে চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। পাশাপাশি অন্যান্য ল্যাব বন্ধ হলেও আমাদের ল্যাব এখনও নিয়মমাফিক খোলা। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও এপ্রিলের শুরু থেকে আবার ল্যাব যেতে হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে, কাজের সময়টুকু কাটে চরম ভীতি ও সন্ত্রস্ততায়। সারা ক্ষণ এক রকম টাচ-ফোবিয়া মানে সংস্পর্শ-ভীতি কাজ করে। দরজার হ্যান্ডেল, কফি মেশিন, চায়ের কাপ, ল্যাবের যন্ত্রপাতি হোক বা কম্পিউটার, যে কোনও কিছুই ছুঁয়ে দেখতে ভয় পাই। ল্যাবের সহকারীদেরও এড়িয়ে চলতে হচ্ছে। সর্বদা গ্লাভস্ আর মাস্ক পরে আছি। রসায়নে কাজ করার জন্য, ল্যাবের সরবরাহ থেকেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানিয়ে নিয়েছি। তার ক্ষুদ্র সংস্করণ সারা ক্ষণ পকেটে নিয়ে ঘুরি। নিজেকে নিয়ে এই দুশ্চিন্তার পরিধি সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছি প্রায় সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা আমার পরিবার পরিজনদের মধ্যেও। প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে দিনে একাধিক বার ভিডিয়ো কল করে মা-বাবার চিন্তার অবসান ঘটানোর চেষ্টা এখনও অব্যাহত।

আমি আত্মবিশ্বাসী যে প্রথম বিশ্বের দেশ হিসাবে তার নাগরিক সচেতনতা, মজবুত অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ও উন্নত চিকিত্সা ব্যবস্থা নিয়ে জার্মানি নিশ্চিত ভাবেই এই মারণ ভাইরাস প্রতিহত করতে সমর্থ হবে। তা ছাড়াও প্রত্যহ ভাইরাস পরীক্ষার সংখ্যা এখানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার, যেটা গোষ্ঠী সংক্রমণ ঠেকাতে বিশেষ ভাবে সহায়তা করেছে। তবে আমি অনেক বেশি চিন্তিত আমার দেশ নিয়ে, নিজের রাজ্য, আমার ফেলে আসা গ্রাম নিয়ে। সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি, নাগরিক সচেতনতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া এই বিপদ থেকে বেরনোর অন্য কোনও পথ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। এই লড়াই ব্যক্তিগত নয়, এ লড়াই সমষ্টির। আমার দেশের মানুষকে যাবতীয় মতান্তর পাশে সরিয়ে যুথবদ্ধতায় একত্রিত হতে হবে। এবং সে প্রক্রিয়া যত বিলম্বিত হবে তত বিপদ বাড়বে। আজ তাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইটা হোক ঘরে বসে। অভুক্তদের অন্নসংস্থান করে বা সকলকে পরিচ্ছন্নতার পাঠ দিয়ে। সংকল্প হোক দৃঢ়, চেষ্টা হোক সামগ্রিক। কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা আমাদের। বহু ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে আজও আমরা টিকে আছি। আশা করি, করোনার এই প্রতিকূল অন্ধকারময় দিনগুলোও পেরিয়ে এক নতুন সকালকে স্বাগত জানাতে পারব আমরা।

শুভেন্দু কারক, জার্মানি

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Lockdown Germany Letters To The Editor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE