Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
COVID-19

উপেক্ষিতা

শ্রেণি, বর্ণ ও লিঙ্গ, বঞ্চনার এই তিন অক্ষরেখার সংযোগে গৃহপরিচারিকারা চিরকালই বিশেষ ভাবে বঞ্চিত। কোভিড অতিমারি কাজের নিরাপত্তা ব্যাহত করিয়া তাঁহাদের অসহায়তা বাড়াইয়াছে।

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২০ ০০:২৩
Share: Save:

ফের পূজার পূর্বে এক গৃহপরিচারিকাকে থানায় যাইতে হইল। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হইবার পরেও গৃহকর্তা আদেশ করিয়াছিলেন, তাঁহাকে কাজে আসিতে হইবে। নচেৎ মিলিবে না বকেয়া বেতন, পূজার ‘বোনাস’। অর্থাৎ কোভিড-সম্পর্কিত সতর্কতা পরিচারিকার জন্য নহে। গত বৎসর অপর এক পরিচারিকা থানায় নালিশ করিয়াছিলেন, পূজার বাড়তি টাকা দিবার দায় এড়াইতে তাঁহাকে পূজার কিছু পূর্বে বরখাস্ত করিয়াছেন গৃহকর্তা। এই দুই মহিলা কর্মীই দুইটি গৃহপরিচারিকা সংগঠনের সহিত যুক্ত। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে তাঁহারা সচেতন, পুলিশে ভীত নহেন। সংগঠনগুলিও তাঁহাদের সমর্থন ও সহায়তা করিয়াছে। দরিদ্র মহিলাকর্মীর সক্ষমতার এমন নিদর্শন বিরল, কিন্তু সমস্যাটি বিরল নহে। প্রাপ্য বেতন হইতে কখনও বঞ্চিত হন নাই, এমন গৃহপরিচারিকা বহু সন্ধানেও মিলিবে না। নিয়োগকারীরা তাঁহাদের প্রতি কত অবিবেচক এবং অমানবিক হইতে পারেন, তাহার নিদর্শন মিলিয়াছে সাম্প্রতিক লকডাউনে। পরিবহণের অভাবে এবং আবাসনে প্রবেশ করিবার নিষেধাজ্ঞার কারণে বহু পরিচারিকা কাজে যোগ দিতে পারেন নাই। অনেকেরই বকেয়া বেতন মিটাইয়া দেন নাই নিয়োগকারী। লকডাউনের মাসগুলিতে তাঁহাদের বেতন অথবা কোনও প্রকার সহায়তাও দেন নাই। কর্মহীনতা বিপন্ন করিয়াছিল পরিচারিকাদের। অনেকেই কেবলমাত্র পুলিশ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অথবা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দ্বারা বিতরিত খাদ্যের উপর নির্ভর করিয়া বাঁচিয়াছেন। সামাজিক সুরক্ষার অভাব তাঁহাদের বিপন্নতা বাড়াইয়াছে।

প্রশ্নটি কেবল কিছু কর্মীর বিপন্নতার, এমন নহে। ইহা সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নও বটে, কারণ গৃহপরিচারিকার পেশাটি বর্তমানে এ রাজ্যে মহিলাদের সর্ববৃহৎ নিয়োগক্ষেত্র। এই কাজ করিয়াই বহু মহিলা সন্তানপালন ও সংসারের দায় মিটাইয়া থাকেন। অবশ্যই ইহা সম্পূর্ণ অংসগঠিত একটি কর্মক্ষেত্র। মহিলারা সাধারণত অনেকগুলি গৃহে একই সঙ্গে কাজ করিয়া থাকেন। তাই তাঁহাদের নির্দিষ্ট নিয়োগকারী নাই, ন্যূনতম বেতন কাঠামো নাই, ছুটির নির্দিষ্ট দিন নাই। অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিতির জন্য বেতন কাটা যাইতে পারে, বরখাস্তও করা হইতে পারে। কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নিরাপত্তার আশ্বাসটুকুও নাই। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রকাশ পাইয়াছে, তাঁহারা বহু ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁহারা প্রতিবাদের ঝুঁকি না লইয়া নীরবে সরিয়া যান। তাহার উপর তাঁহাদের সহ্য করিতে হয় নানা প্রকার সামাজিক অমর্যাদা। বহু গৃহস্থ পরিচারিকাদের তাঁহার বাড়ির শৌচাগার ব্যবহার করিবার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছেন। পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত আসবাব অথবা বাসনপত্র ব্যবহারের অধিকার পরিচারিকাদের নাই, এমনকি তাঁহাদের জন্য পৃথক আহারও বরাদ্দ। বলা বাহুল্য, তাহা নিম্নমানের খাদ্য। এ বিষয়ে বিত্তবানও কার্পণ্য করিতে দ্বিধা করেন না।

শ্রেণি, বর্ণ ও লিঙ্গ, বঞ্চনার এই তিন অক্ষরেখার সংযোগে গৃহপরিচারিকারা চিরকালই বিশেষ ভাবে বঞ্চিত। কোভিড অতিমারি কাজের নিরাপত্তা ব্যাহত করিয়া তাঁহাদের অসহায়তা বাড়াইয়াছে। অনেকে আরও কম বেতনে কাজে যোগ দিতে বাধ্য হইয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গে গৃহপরিচারিকাদের বেশ কয়েকটি সংগঠন গড়িয়া উঠিয়াছে। যথাযথ বেতন, কাজের শর্ত আরও মানবিক করিবার লক্ষ্যে সেগুলি কাজ করিতেছে। তবে এই আন্দোলনের লক্ষ্য কেবল নিয়োগকারী হইতে পারে না। শহরগুলিতে গৃহপরিচারিকারা যাহাতে সুলভ বাসস্থান পাইতে পারেন, বিবিধ নাগরিক পরিষেবা এবং সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প সহজে গ্রহণ করিতে পারেন, তাহার ব্যবস্থাও করিতে হইবে। তাহা সম্ভব করিতে পারে সরকার ও পুরসভা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

COVID-19 Pandemic Coronavirus Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE