Advertisement
E-Paper

নির্বাচনী রং লাগিয়াছে গোমাতার শরীরেও

সংবাদে প্রকাশিত, সেখানে নির্বাচনী রং লাগিয়াছে গোমাতার শরীরে। গৈরিক আর সবুজ। তাহারই মধ্যে প্রস্ফুটিত পদ্ম। গৃহপালিত, মতান্তরে খাটালপালিত এই জন্তুটির একটি একান্ত সাক্ষাৎকার লইতে সার্থক হইয়াছেন মহৎ সাংবাদিক ঘোষাল মহায়।

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৪৭
—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

অধুনা ভারত নামক দেশটিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য হইল মধ্যপ্রদেশ। বিজেপি শাসিত সেই রাজ্যে মুখ্য চৌকিদার শিবরাজ সিংহ চহ্বান। সংবাদে প্রকাশিত, সেখানে নির্বাচনী রং লাগিয়াছে গোমাতার শরীরে। গৈরিক আর সবুজ। তাহারই মধ্যে প্রস্ফুটিত পদ্ম। গৃহপালিত, মতান্তরে খাটালপালিত এই জন্তুটির একটি একান্ত সাক্ষাৎকার লইতে সার্থক হইয়াছেন মহৎ সাংবাদিক ঘোষাল মহায়।

প্রথম প্রশ্ন, হে গোমাতা আপনি কাহার? পদ্মের দল আপনার খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতা? সে বিক্রেতার কোনও শাখা নাই? প্রসন্ন গোয়ালিনীকে কমলাকান্ত বিচারালয়ে দণ্ডবৎ আস্থার সহিত বলিয়াছিলেন, গরুর দুগ্ধ যে পান করে, গরু তাহারই। দুধে জলের মিশ্রণ লইয়া কমলাকান্ত বোঝাপড়ায় প্রস্তুত, কিন্তু তাহা বলিয়া বিজেপি?

— প্রেসের লোক, আপনি কি দেখিতে পাইতেছেন না আমার কণ্ঠে ক্ষুদ্র একটি ঘণ্টা। এটি সরকারি ঘণ্টা। আমি এ রাজ্যের সরকারি গাভি। মহায়, কাটিয়া পড়ুন। আপনার সঙ্গে কথা কহিবার পারমিশান নাই। আমি গেজেটেড গাভি। আমার নামে যদি দেশের সরকার জাতীয়তাবাদের শিঙা ফুঁকেন তবে তাহাতে আপনার সমস্যা কোথায়? মনে রাখিবেন, আমি প্রলেতারিয়াত গরু নহি।

ভাগবৎ পুরাণের কাহিনি। ভেনা নামে এক রাজা ছিলেন এ পৃথিবীতে, তিনি শাসন করিতে গিয়া এতটাই অত্যাচার করিয়াছিলেন যে পৃথ্বী বিরক্ত হইয়া গরু-রূপ ধারণ করিয়া পলায়ন করেন। তখন পৃথিবীতে নৈরাজ্য। দুর্ভিক্ষ। সাধুদের অনুরোধে তখন বিষ্ণু আর এক ভাল রাজার জন্ম দেন, তাঁহার নাম পৃথু। পৃথু বিষ্ণুরই রূপ। পৃথু গোমাতাকে ফিরিয়া আসিতে অনুরোধ করেন। গোমাতা বলেন, তোমরা পৃথিবীকে এতটাই বদলাইয়া দিয়াছ যে অরণ্য থাকিতেছে না, নদী থাকিতেছে না, পর্বত নাই। রাজা বলিলেন, উন্নয়নের জন্য কিছু তো করিতেই হইবে। গোমাতা তদ্যপি বলিলেন, ‘‘‘সব দিক বিবেচনা করিয়ো’। সেই গোমাতাই তো আমাদের পৃথিবী।’’ আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, এই আখ্যানে হিন্দু ধর্মকে চাপাইয়া দিবার প্রয়োজনটা কী?

আরও পড়ুন: ডাকের বাক্স খালিই, আর আসে না চিঠি

— গো-রু গো মানে তুমি কি জানো? গো মানে ভূ, পৃথিবী, গো মানে স্বর্গ, রু মানে শব্দ। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অব্যক্ত মর্মর শব্দ, বিশ্বের সমস্ত সুখ, দুঃখ, ক্রন্দন সব ঘুরিতে ঘুরিতে ছন্দে ছন্দে বাজিয়া উঠিতেছে। মিউজ়িক অব দ্য স্ফিয়ার্স। সত্যজিতের পিতা বলিতেছেন, ইহাই গরুর সূত্র।

শ্রীমদ্ভাগবতে আছে ধর্মের, ধর্মবৃষের চার পদ। মিতব্যয়িতা, স্বচ্ছতা, দয়া ও সত্য। আপনার চতুর্থ পদ কি সত্য সন্ধানে নাগপুরে?

— অবন্তীবাসী গোমাতা বলিলেন, খাকি কাপড়ের রঙের সহিত আমাদের গোবর মিশিয়া এক নব্য জাতীয়তাবাদ তৈরি হইতেছে। হে প্রেসের লোক, অবলোকন করুন, ওই যে অযোধ্যা নগরী, ও দেশেও যে জয় শ্রীরাম ধ্বনি শুনিতেছেন, উহা তো বিষ্ণু অবতারেরই জয়-যাত্রা।

খাঁটি ও ভেজাল গরু দুই প্রকার? সত্যকারের বেসরকারি গরু কোথায়? গো-সমাজেও এত আপস, এত ক্ষমতার মোহ? সুকুমার রায়ের শরণাপন্ন হইয়া গাহিতে লাগিলাম, “মৃত্যু ভয়াবহ হম্বা হম্বা/রৌরব তরণী তুহুঁ জগদম্বা/শ্যামল স্নিগ্ধ নন্দন বরনী/খণ্ডিত গোধন মণ্ডল ধরণী।’’ অকস্মাৎ রুগ্ণ এক গরুকে দেখিলাম, ম্যাজিকের মতো সম্মুখে হাজির।

আপনি কি বাঙালি গরু? হাড় বাহির করা মহেশ না কি! আপনিও কি জাতীয়তাবাদী গরু? আপনিও কি হিন্দু ব্রাহ্মণ গরু?

— এ হেন গরুটি স্মার্ট ও বৈজ্ঞানিক। বলিলেন, আমি তো ‘Bos taurus.’ স্তন্যপায়ী, নিরামিষাশী, অ্যানিমালিয়া। বস তাওরুস বলিলেন, শীঘ্র ইছামতী পার হইয়া আমি ও পারে চলিয়া যাইতেছি। আমার পালনকর্তা নাই। বুঝিতে পারিতেছি, আমাকে কিছু লোক চিবাইয়া খাইবেন। তবে তাহাই বোধ হয় আমার মোক্ষ। সুন্দরবনের বাঘ খাইবার চেয়ে মানুষ খাইলে খুশি হইব। ব্যঙ্গের হাসি হাসিয়া অতঃপর তিনি চারটি প্লাসটিকের থলি চিবাইয়া খাইলেন।

এ দিকে দেশ জুড়িয়া গোরক্ষার চিৎকার শুনিতেছি, বৈদিক আর্যরা নাকি গোমাতার চরণে চিরকাল সেবা করিয়াছে। হে বাঙালি দরিদ্র ‌‌‌‌র‌্যাডিকাল গোমাতা, জবাব দিন।

আরও পড়ুন: ক্ষমতা এবং কেচ্ছা, দারুণ দুই পদ যদি পড়ে এক প্লেটে

— বাঙালি গরুটি প্রতিবাদ করিল। ‘‘মিথ্যা কথা। আমাদের ইতিহাস আমাদের চাহিতে মানুষ বেশি জানে? আমাদের ঐতিহাসিক বংশীবাদক ভট্টাচার্য বলিয়াছেন, ঋগ্বেদের সময় হইতে বহিরাগত মানুষ সোমরসের সহিত গোভক্ষণ করিতেন মহানন্দে। বরং চিত্তাকর্ষক ঘটনা, বাবর, আকবর, জাহাঙ্গির, এমনকী আওরঙ্গজেব গোহত্যা বন্ধ করিবার নির্দেশ দিয়া দিলেন, যাহাতে জৈন আর কতিপয় ব্রাহ্মণ অসন্তুষ্ট না হন। ১৮৭০ সালে শিখ কুকা অথবা নামধারী সম্প্রদায় প্রথম গোরক্ষা আন্দোলন শুরু করিয়াছিলেন। ১৮৮২ সালে দয়ানন্দ সরস্বতী প্রথমে গোরক্ষিণী সভা গড়িয়া তোলেন। ১৮৮০ হইতে ১৮৯০ সালে গোহত্যা লইয়া সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষও হইয়াছিল। ১৮৮৮ সালে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের হাইকোর্ট বলিয়া দেয়, গরু কোনও পবিত্র বস্তু নহে। এই রায়ে সাম্প্রদায়িক চাঞ্চল্য দেখা দেয়। গোহত্যা লইয়া অযোধ্যায় দাঙ্গা হয় ১৯১২ সালে।’’

হে বাঙালি গরু, আপনি তো দেখিতেছি ইন্টেলেকচুয়াল। তবে আজ যে বিজেপি বলিতেছে গোমাতা হিন্দু ধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি!

— দেখো হে রিপোর্টার, গোমাতা সম্বোধন করিতেছ, তা নিজের মাকে গিয়া বলো দেখি মা তুমি একটি গরু। দেখো তোমার জন্মদায়িনী কী কহেন? তিনি চটিতং হইয়া তোমার কানটি মলিয়া দিবেন।

— পবিত্র গরুকে বিজেপির কিছু নেতাও অবশ্য ভক্ষণ করেন বিদেশে যাইয়া। তাঁহারা বলিয়া থাকেন, গরু পবিত্র ভারতে, ভারতের বাহিরে অন্য দেশে গরু পবিত্র নহে, তাই গরুকে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মের সঙ্গেই যুক্ত করা ঠিক নয়। শুধু হিন্দু নয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের আদি গ্রন্থেও মাংস ভক্ষণের ইতিহাস পাওয়া যাইতেছে।

হে বাঙালি গরু, আপনি কী সব তথ্য দিতেছেন। ভারতের জাতীয়তাবাদে গরুর গুরুত্ব আপনি গরু হইয়া স্বীকার করিতেছেন না! ইহা তো ঘোর কলি!

— জানি জানি! আপনাদের ওই লোকটি। খাটো ধুতি। আদুড় গা। গোল গোল চশমা। কী নাম যেন!

গাঁধী?

— উনি তো হরিজনে নিজেই লিখিয়াছেন, গোমাতা অনেক সময় স্তন্যদায়িনী মায়ের চাহিতেও ভাল। আমাদের মায়েরা কয়েক বছর দুধ খাওয়ায় আমাদের। আর গোমাতা? সারা জীবন। তবু আমাদের মায়ের প্রত্যাশা থাকে, সন্তান তাহাকে দেখিবে সারা জীবন। গোমাতা আমাদের কাছ থেকে কী চাহে? কিঞ্চিৎ ঘাসবিচুলি। তা আপনাদের গাঁধীজিই বা কম কী ছিলেন? তিনি তো আমাদের প্রভূত সম্মান দিয়াছেন!

সম্মান তো আমরা সকলেই দিতে প্রস্তুত। কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আপনাকে যুক্ত করিতে চাহি না। আর ঈশ্বর, হিন্দুধর্ম, এই সবের সহিত গোবর-গোমূত্রকে জড়াইবার প্রয়োজন কী?

— ইহা হইল পাটোয়ারি বুদ্ধি। গোরক্ষকের নামে পশ্চাদপসরণ। নির্বাচন অতি বিষম বস্তু।

বাঙালি গরুটিও অদৃশ্য। বিদায়ের আগে ভূমিতে দান করিয়া গেলেন বিস্তর পবিত্র গোবর। কোথায় পদ্ম! কোথায় হাত!

বলিলাম, রাষ্ট্রের হেড মাস্টারমশাই বড়ই কড়া, বড়ই নির্মম। হাতে বেত লইয়া নূতন ভাষা শিখাইতেছেন। কিন্তু আমরা মূর্খের দল ঘাড় নাড়িতেছি জোরে জোরে। বুঝিতেছি কি? ২০১৯’এ পরীক্ষায় পাশ করিতে পারিব তো? নির্বাচন নামক রসিকতায় স্লোগান কি তবে সেই গৌ-গাবৌ-গাবঃ? হলদে সবুজ ওরাংওটাং, ইত্যাদি?

Cow Election গরু নির্বাচন
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy