Advertisement
E-Paper

সিপিএমের নোবেলপ্রাপ্তি

বৌদির হাতে সাদা থান ধরিয়ে বলত, রেখে দিন, দাদার কিছু হয়ে গেলে কাজে লাগবে! ওখানেই বারো আনা মনোনয়নের সলিলসমাধি।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৮ ০০:৪৭

বাবা, পঞ্চায়েত ভোটটা এ বার মিটলে বাঁচি। একটা ভোট নিয়ে এতখানি অশান্তি আর সহ্য হয় না।’’ খবরের কাগজটা টেবিলে ফেলে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল সূর্য।

‘‘কেন রে, তোদের বামফ্রন্টের সময় পঞ্চায়েত ভোটে কোনও ঝামেলা হত না?’’ প্রশ্ন করে শিশির। ‘‘তখন বিরোধীরা চাইলেই ভোটে দাঁড়াতে পারত, মানুষ যাকে ইচ্ছে ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরতে পারত? যা ইচ্ছে বললেই হল?’’

‘‘আমার তো মাথা খারাপ হয়নি’’, সূর্যের ঠোঁটের কোণে হাসি। ‘‘কিন্তু ভাব, সিপিএমের আমলে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা ইয়ে ছিল, একটা ছিমছাম ভাব। মনোনয়ন জমা করতে যাওয়ার পথে বিরোধীদের ধরে পিটলে সেটা তো খবর হবেই। সিপিএমের সময় আগের দিন সন্ধেতেই বাড়িতে লোক পৌঁছে যেত। বৌদির হাতে সাদা থান ধরিয়ে বলত, রেখে দিন, দাদার কিছু হয়ে গেলে কাজে লাগবে! ওখানেই বারো আনা মনোনয়নের সলিলসমাধি। ডান্ডা মেরে ভয় দেখানোর মধ্যে এই ব্যাপারটা আছে, বল?’’ মিটমিটিয়ে হাসে সূর্য।

‘‘চমৎকার!’’ উত্তেজিত শিশির সিগারেট ধরিয়ে ফেলে। ‘‘নোবেল দেওয়া উচিত ছিল সিপিএমকে।’’

‘‘কথাটা মন্দ বলিসনি, শিশির।’’ এত ক্ষণে মুখ খোলেন শিবুদা। ‘‘নোবেল দিয়েছে তো।’’

‘‘নোবেল? সিপিএমকে?’’ সমস্বরে প্রশ্ন সূর্যদের।

‘‘সিপিএমকে হবে কেন, রিচার্ড থেলারকে।’’ বলেই চুপ করে যান শিবুদা। গোপাল এসে চায়ের কাপ নামায়। শিবুদার প্রশ্ন, ‘‘ভোট দিতে বাড়ি যাবি না গোপাল?’’ গোপাল মুখ বাঁকায়, ‘‘আমাদের এ বার ভোট নেই। তৃণমূল জিতে গেছে।’’

‘‘যাক, দোকানটা খোলা রাখিস তবে।’’

‘‘রিচার্ড থেলারের কথা বলছিলেন না?’’ তপেশ স্মার্ট ফোন থেকে মুখ তোলে এত ক্ষণে। ‘‘এ বারের অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী, শিকাগো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক— জম্মে কমিউনিস্ট পার্টির ছায়া মাড়াননি, আর তাঁর নোবেলকে বেবাক আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন!’’

‘‘গুগ্‌ল ঠাকুরের ভরসায় শিবু সেনের কথা কাটতে যাস না তোপসে। থেলার কেন নোবেল পেয়েছিল, সেটা দেখলি? থাক, দেখতে হবে না, বলছি শোন। বিহেভিয়রাল ইকনমিক্‌স-এ থেলারের অবদানটির নাম হল নাজ। এন-ইউ-ডি-জি-ই। অর্থাৎ, হালকা খোঁচা, আলতো ঠেলা। কোনও গা-জোয়ারি নয়, কোনও বাধ্যবাধকতা নয়, কিন্তু সামান্য কিছু বদলের মাধ্যমে মানুষকে দিয়ে কোনও কাজ করিয়ে নেওয়া। সিপিএম কোত্থেকে এল, বুঝলি?’’ প্রশ্ন শিবুদার।

‘‘উঁহু।’’ ঘাড় নাড়ে তপেশ।

‘‘ভেজ বিরিয়ানি খাচ্ছিস নাকি?’’ খোঁচা দেন শিবুদা। ‘‘এই যে বিরোধীর বাড়িতে সাদা থান দিয়ে আসা, বা পাড়ার মোড়ে বলা যে ভোটের দিন বোমটোম পড়লে বেকার চোট লেগে যেতে পারে, এগুলোয় প্রত্যক্ষ গা-জোয়ারি নেই, খেয়াল কর। তৃণমূলের কেষ্টরা যেমন রাস্তায় উন্নয়ন দেখাচ্ছে, এটা সে রকম নয়। এটা শুধু মনে করিয়ে দেওয়া, বেচাল হলে বিপদ। এই মনে করিয়ে দেওয়াই নাজ। আলতো ঠেলা। এর নামই বাবাজীবন। থেলারের নোবেলে সিপিএমের ন্যায্য অধিকার আছে।’’

‘‘একটা আলতো ঠেলা দিয়েই নোবেল!’’ হাসতে হাসতে বলে শিশির।

‘‘একটা কনস্পিরেসি থিয়োরি মাথায় ঘুরছে, শুনবি? ভাগাড়ের মাংসের খবরটা ছাপা হওয়ার পর থেকে কত হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পেয়েছিস, বল দিকি। সেই মেসেজের বেশির ভাগই কলকাতার কয়েকটা নামকরা মোগলাই খাবারের রেস্তরাঁর নাম, যেগুলোর মালিক, কর্মী সব মুসলমান। ঘেন্নার মার নেই রে— মানুষের মনে যদি ঢুকে যায় যে এই দোকানগুলোয় ভাগাড়ের মাংস দেয়, শুধু ঘেন্নার চোটেই ব্যবসা চৌপাট হয়ে যাবে। ভেবে দেখ, গা-জোয়ারি নয়, বাংলায় নিরামিষ চাপানোর নির্বুদ্ধিতা নয়, শুধু ঘেন্নার আলতো ঠেলায় একটা চালু ব্যবসার— মুসলমান ব্যবসায়ীদের— ভিত নড়িয়ে দেওয়া যায়। এই তত্ত্ব যদি নোবেল না পায়, কে পাবে?’’ একটানা কথা বলে থামলেন শিবুদা।

বাকিরা চুপ। একটু দম নিয়ে ফের শুরু করলেন দাদা, ‘‘‌মানুষের মাথা নিয়ে এই খেলাটা আসলে অনেক পুরনো। লিক্যুইড ডিটারজেন্টের বোতলের ঢাকনাটা অত বড় কেন হয়, ভেবেছিস? কারণ, কোম্পানিগুলো জেনে গিয়েছিল, গিন্নিরা কাপড় কাচার সময় সেই ছিপির মাপে সাবান ঢালে। ছিপি বড় মানেই বেশি সাবান খরচ। এটা কিন্তু নাজ। থেলার নোবেল পাওয়ার পর কৌশিক বসুর একটা মন্তব্য পড়েছিলাম— কর্পোরেট দুনিয়া দীর্ঘ কাল ধরে নাজ ব্যবহার করে মানুষকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে চলেছে। এ বার যদি সরকার বা অসরকারি সংস্থাগুলো মানুষের মঙ্গলে নাজ ব্যবহার করে তো দুনিয়ার উন্নতি হয়। লাখ টাকার কথা।’’

শিবুদার কথায় বাধা পড়ে— শিশিরের ফোন বেজে উঠেছে। শিশির ফোন ধরে বলে, ‘‘আমার চাই না, থ্যাঙ্ক ইউ’’। সূর্য জিজ্ঞেস করে, ‘‘ক্রেডিট কার্ড, না নতুন পোস্ট পেড কানেকশন?’’ ‘‘পার্সোনাল লোন’’, ব্যাজার হাসে শিশির।

‘‘ডিএনডি চালু করিসনি?’’ তপেশের প্রশ্ন।

উত্তর দেন শিবুদা। ‘‘ডিএনডি চালু করতে সাকুল্যে পাঁচটা মিনিট সময় লাগে। তবুও আমরা বেশির ভাগ লোকই সেটা করে উঠতে পারি না। কিন্তু, ভেবে দেখ, ব্যবস্থাটা তো এ রকমও হতে পারত যে সব নম্বরই এমনিতে ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ তালিকায় থাকবে। কেউ যদি কল সেন্টারের ফোনে দিনে তেরোটা অফার পেতে আগ্রহী হয়, তবে সে ডিএনডি-র তালিকা থেকে নিজের নম্বরটা সরিয়ে নেবে। এই রকম ব্যবস্থা যে হয় না, এটাও এক ধরনের নাজ।’’

‘‘পেয়েছেন কী মশাই, যা বলছি সব কিছুকেই নাজ বলে চালাচ্ছেন!’’ শিবুদাকে খোঁচা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারে না তপেশ।

দাদা চটেন না। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বলেন, ‘‘এখন যে সব হাইপার স্টোরে মাসকাবারি মুদির বাজার করতে যাস, তার শেল্‌ফগুলো দেখেছিস কোনও দিন? দেখবি চকোলেট, চকোলেট বিস্কুট, চিপস-এর প্যাকেট, সব তোর কোমরের কাছাকাছি উচ্চতার তাকে থাকে। তোর কোমর যেখানে, একটা আট-ন’বছরের বাচ্চার চোখ ঠিক সেই উচ্চতায়। যাতে বাচ্চাগুলোর চোখে পড়ে ওই লোভনীয় জিনিসগুলো, আর তার বিক্রি বাড়ে। চেক আউট কাউন্টারের সামনে, তোর চোখের উচ্চতাতেও চকোলেট, চুয়িং গাম থাকে। ডাল-চিনি-আটা-তেল, যা-ই কিনতে যাস না কেন, দেখবি, দোকানের নিজস্ব ইন-হাউস ব্র্যান্ডের জিনিসগুলো আছে তোর চোখের লেভেলে, আর অন্য ব্র্যান্ডের জিনিস আছে হয় নীচে, নয় ওপরে। এই যে তাক সাজানো, এটা তো নাজ— একটাও কথা না বলে তোকে কোনও একটা বিশেষ পণ্যের দিকে ঠেলে দেওয়া।’’

‘‘বাপ রে!’’ তপেশ রীতিমতো অবাক।

‘‘আরে, এ তো তুশ্চু’’, শিবুদা কথা চালিয়ে যান। ‘‘মানুষ কী ভাবে হিসু করবে, সেটা অবধি নাজ দিয়ে স্থির করে দিচ্ছে। আমস্টারডাম এয়ারপোর্টে ফ্লাই ইউরিনাল, সার্চ করে দেখিস গুগ্‌লে।’’

শিশির শিবুদার দিকে সিগারেটের প্যাকেটটা ঠেলে দিল। শিবুদাও একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘‘নাজ প্র্যাকটিস করছিস বুঝি? লাভ নেই, বুঝলি তো। লোককে দিয়ে নিজের কাজটা হয়তো করিয়ে নিতে পারবি, কিন্তু নিজের প্যাঁচে পড়া ঠেকাতে পারবি না। আমাকেই দ্যাখ। বছর সাতেক আগে একটা মেয়ে ফোন করল আমার ব্যাঙ্ক থেকে— ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য। বললুম, শেয়ার বাজারে আমার জ্ঞানের দৌড় সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড অবধি, আমি ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট দিয়ে কী করব? তো, মেয়েটা বললে, প্রথম বছর অ্যাকাউন্ট ফ্রিতে পাওয়া যাচ্ছে। ব্যবহার না করলে পরের বছর বন্ধ করে দিলেই হবে। কী মনে হল, রাজি হয়ে গেলুম। তার পর থেকে বছর বছর গাঁটগচ্চা দিয়ে যাচ্ছি সাতশো না হাজার কত টাকা যেন। ব্যাঙ্কে গিয়ে অ্যাকাউন্টটা বন্ধ করিয়ে উঠতে পারলাম না।’’

‘‘আমিও, শিবুদা।’’ বলে উঠল সূর্য। ‘‘ক্রেডিট কার্ড থেকে অফার দিল, একটা ম্যাগাজিন এক বছর ফ্রি-তে পাওয়া যাবে। রাজি হয়ে গেলাম নিতে। তার পরের বছর থেকে টাকা গুনে যাচ্ছি, জন্মে পাতাও উল্টোই না ম্যাগাজিনটার।’’

‘‘এটাই নাজের খেলা, বুঝলি। কোম্পানিগুলো জানে, গোড়ায় বিনামূল্যে কিছু দিলে অনেকেই লোভে পড়ে সেটা নিয়ে নেবে— পরে এক দিন মনে করিয়ে দিস তো, ফ্রি-র মাহাত্ম্য শোনাব তোদের— আর, এক বার চালু করে দিতে পারলে বেশির ভাগ লোকই আর উদ্যোগী হয়ে বন্ধ করতে আসবে না। বিশেষত, টাকাটা যদি চুপচাপ কেটে নেওয়া যায়। কম্পিউটারের অ্যান্টি ভাইরাস কেন, দেখবি অটোমেটিক রিনিউয়ালের ব্যবস্থা রয়েছে। মোবাইলে ভিডিয়ো স্ট্রিমিং সাবস্ক্রাইব কর, সেখানেও এক গল্প। যেটা চলছে, সেটাই চলতে থাকে, এই গতিজা়ড্যের ভরসায় অর্ধেক ব্যবসা চলছে। মানুষকে শুধু গোড়ায় সে দিকে ঠেলে দিতে পারলেই হল। আলতো ঠেলা।’’ বললেন শিবুদা।

‘‘কিন্তু, তৃণমূলের কী হবে, সেটা বলুন।’’

‘‘কিচ্ছু না।’’ উত্তর দেন শিবুদা। ‘‘যেখানে কামারের এক ঘা বসালে পুলিশ ধরে না, সেখানে ঠুকঠাক করার দরকারটা কী? দিব্যি তো চলছে।’’

CPM Election Violence TMC Nobel
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy