Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

রবীন্দ্রনাথের ‘যুক্তি’ নিয়েও প্রশ্ন থাকে

১৯৩৪ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পকে গাঁধীজি বলেছিলেন ‘পাপের ফল’। ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ বললেন, প্রাকৃতিক ঘটনার মূলে জাগতিক কারণ ভিন্ন আর কিছু থাকতে পারে না। গাঁধী ভুল হতে পারেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথও কি ঠিক?গাঁধীজির সঙ্গে নিজের তুলনা করে রবীন্দ্রনাথ মহাত্মাকে বলেছিলেন তপস্বী। আর তিনি? প্রেমিক। তো সেই তপস্বী আর প্রেমিক একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও বহু বিষয়ে ছিলেন ভিন্ন মতের শরিক। অসহযোগ আন্দোলন, বিদেশি কাপড় পোড়ানো, চরকা কাটা ইত্যাদি বিষয়ে যে তাঁর সায় নেই, তা জোর গলায় বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৫ ০০:১৫
Share: Save:

গাঁধীজির সঙ্গে নিজের তুলনা করে রবীন্দ্রনাথ মহাত্মাকে বলেছিলেন তপস্বী। আর তিনি? প্রেমিক। তো সেই তপস্বী আর প্রেমিক একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও বহু বিষয়ে ছিলেন ভিন্ন মতের শরিক। অসহযোগ আন্দোলন, বিদেশি কাপড় পোড়ানো, চরকা কাটা ইত্যাদি বিষয়ে যে তাঁর সায় নেই, তা জোর গলায় বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ও-সব তো রাজনৈতিক ইস্যু। ও-সব ছাপিয়ে সূক্ষ্ম একটা প্রশ্নেও বাদানুবাদে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিলেন তপস্বী এবং প্রেমিক। কোন প্রশ্নে? ভূমিকম্প। উপলক্ষ ওই প্রাকৃতিক দুর্বিপাক হলেও, বিরোধিতা ভাল করে চেনায় ওই দুই মনীষীকে। ধরা পড়ে দু’জনের বিশ্ববীক্ষা, যা অবশ্যই ছিল ভিন্ন।

১৫ জানুয়ারি, ১৯৩৪। দুপুর ২টো নাগাদ বিরাট এক ভূমিকম্পের শিকার হয়েছিল নেপাল এবং বিহার-সংলগ্ন ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা। ভূমিকম্পের এপিসেন্টার (ভূ-ত্বকে যে জায়গার নীচে তার উৎস) ছিল এভারেস্টের ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে। পুর্ণিয়া থেকে চম্পারণ আর কাঠমান্ডু থেকে মুঙ্গের— এতখানি এলাকা জুড়ে ক্ষয়ক্ষতি। প্রাণহানি ১০ হাজারেরও বেশি। শুধু বিহারেই ৭ হাজার।

ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা দেখে বাপুজি বিচলিত। তা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিক্রিয়া? তা যে বিচিত্র। মহাত্মা বললেন, ভূমিকম্প নাকি ঈশ্বরের শাস্তিবিধান। অস্পৃশ্যতার মতো পাপাচারের দণ্ড। মন্তব্য শুনে রবীন্দ্রনাথ হতচকিত, ক্ষুব্ধ। তাঁর প্রতিক্রিয়া বিজ্ঞানমনস্ক ঘোরতর একজন যুক্তিবাদীর। বললেন, প্রাকৃতিক ঘটনার মূলে জাগতিক কারণ ভিন্ন আর কিছু থাকতে পারে না। গাঁধীজির বিরুদ্ধাচরণ শুধু ওটুকুতে সীমাবদ্ধ রাখলেন না রবীন্দ্রনাথ, বাড়তি সমালোচনাও জুড়লেন তাঁর মন্তব্যে। বললেন, দেশবাসীর মনে ভয় আর দুর্বলতা থেকে মুক্তির অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্য যাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার সীমা নেই, তাঁর মুখের কোনও কথায় যদি সেই জনগণের মনে অযুক্তির বীজ প্রোথিত হয়, তবে আমরা ভীষণ আহত হই। অযুক্তি যার মূল উৎস, সেই অন্ধ ক্ষমতা আমাদের স্বাধীনতা এবং আত্মসন্ধান থেকে দূরে ঠেলে রাখে। রবীন্দ্রনাথের এ হেন সমালোচনার পরেও কিন্তু গাঁধীজি নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল। রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যে তাঁর প্রতিক্রিয়া: ভূমিকম্প ঈশ্বরের খামখেয়াল কিংবা নানা প্রাকৃতিক কারণের সমাহার নয়। ঈশ্বর-প্রবর্তিত সব বিধান মানুষ জানে না।

রবীন্দ্রনাথের তরফে নাস্তিকের বিশ্ববীক্ষা-প্রসূত মতামতে আমাদের মনে জাগে কিঞ্চিৎ কৌতূহল। এই কবির সঙ্গে এর আগে সাক্ষাৎ হয়েছে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের। আলাপচারিতায় উঠে এসেছে এক কূট প্রশ্ন। সত্য কী? বিতর্কে আইনস্টাইন তুলে ধরছেন ধ্রুপদী বিজ্ঞানের ধ্বজা। বলছেন, সত্য আপনা-আপনি বিরাজমান, তা কেউ দেখুক বা না-দেখুক। রবীন্দ্রনাথ মানেন না সে-কথা। বলেন, সত্য নাকি দর্শকের রচনা। দৃষ্টিপাত তৈরি করে দৃশ্য। সত্যের নিজস্ব অস্তিত্ব নেই। এ হেন দাবি কবির পক্ষে স্বাভাবিক। তিনি যে নতুন নতুন সত্য রচনা করেন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে।

ভূমিকম্প ঘোর বাস্তব এক সত্য। তার পিছনে কারণ অন্বেষণে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তার আগের মতো নন, এ বার তিনি রীতিমত বাস্তববাদী। এবং বিজ্ঞানমনস্ক। বস্তুত, সাবেক বিজ্ঞানের যা মূলমন্ত্র, সেই নির্ধারণবাদের সমর্থক তিনি। এ ব্যাপারে তাঁর মনোভাবে ছায়াপাত ফরাসি দার্শনিক পিয়ের সিমো লাপ্লা-র। নির্ধারণবাদের ধ্বজা তুলে ধরায় যিনি বিখ্যাত। আইজাক নিউটনের মহাকর্ষতত্ত্বে জয়গান লেখা ছিল নির্ধারণবাদের। গ্রহ-তারার চলন নিয়মে বাঁধা। ফলে ব্রহ্মাণ্ডে আজ তাদের অবস্থান গত কালের অবস্থানের পরিণাম। অথবা, আগামিকাল কে কোথায় থাকবে, তার হদিশ আজকের পরিস্থিতির মধ্যে লুকানো। এ ব্যবস্থা অভ্রান্ত বলেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নির্ভুল বলে দিতে পারেন আজ থেকে একশো বছর পরে সূর্যগ্রহণ কিংবা চন্দ্রগ্রহণের দিনক্ষণ। নিউটন-আবিষ্কৃত নীতি কাজে লাগিয়ে লাপ্লা লিখলেন বিশ্বতত্ত্বের বই। পাঁচ ভল্যুমের বিশাল হাদিশ। পড়তে দিলেন ফরাসি সম্রাট নেপোলীয় বোনাপা-কে। তিনি পড়ে বিরক্ত। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে কেতাব। তাতে কোথাও ঈশ্বরের উল্লেখ নেই! সম্রাট এ হেন স্পর্ধার কারণ জানতে চাইলেন লাপ্লা-র কাছে। তাঁর সটান জবাব, ‘তেমন কোনও অনুমানের দরকার হয়নি।’ ভূমিকম্প প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের দাবি যেন লাপ্লা-র। আর গাঁধীজির সুর ফরাসি সম্রাটের। কিংবা ‘ওহ্ মাই গড’ ফিল্মে সেই বিমা কোম্পানির। যারা ভূমিকম্পজনিত ধ্বংসের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে অরাজি। কারণ তাদের মতে ভূমিকম্প হল ‘অ্যাক্ট অব গড’।

কেন ভূমিকম্প হয়, সে প্রশ্নে আজ শতকরা কত জন গাঁধীজির দলে, আর কত জন রবীন্দ্রনাথের, তা আর বলে দিতে হবে না। সমস্যা অন্যত্র। ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয়ের পূর্বাভাসদানে। গাঁধীজির দাবি মানলে কাজটা সোজা। যখনই কোথাও হবে পাপাচার, কেড়ে নেওয়া হবে ক্ষুধার্তদের মুখের গ্রাস, কিংবা হামলাকারীর আক্রমণে প্রাণ হারাবে নিরপরাধ মানুষ, তখন অত্যাচারীর দেশে নামবে বিপর্যয়। বাস্তবে যা দেখা যায় না।

আর রবীন্দ্রনাথ? ভূমিকম্পের উৎস সম্পর্কে তাঁর বিশ্বাস বিজ্ঞানসম্মত বটে, কিন্তু সেই বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত বিপর্যয়ের আভাস আগাম দিতে পারে না। আসলে ভবিষ্যৎবক্তা হিসেবে বিজ্ঞান তার গ্ল্যামার হারিয়েছে গত শতাব্দীর গোড়া থেকেই। যখন জানা গেছে, গ্রহ-তারার ক্ষেত্রে দুয়ে-দুয়ে চার হলেও, পরমাণুর ভেতরে সেটা তিন বা পাঁচ অনেক কিছুই হতে পারে। এ জন্যই বিজ্ঞানী নীলস বোর বলতেন, ‘আগাম কোনও কিছু বলা মুশকিল, ভবিষ্যতের ব্যাপার হলে তো কথাই নেই।’ ভূমিকম্প যদিও অণু-পরমাণুর ঘটনা নয়, তবু তার পেছনে ফ্যাক্টর এত বেশি যে, পূর্বাভাসের অঙ্ক কষা অসাধ্য। সাম্প্রতিক এক ঘটনা এ ব্যাপারে এক বড় নিদর্শন।

২০০৯ সাল। বছরের গোড়া থেকে মধ্য ইতালির লা’কুইলা শহরে ছোটখাটো ভূকম্প অনুভূত হচ্ছিল। পদার্থবিজ্ঞানী চার্লস রিখটার-উদ্ভাবিত স্কেলে যাদের মান ২-এর আশেপাশে। মানে, তেমন বড় কিছু নয়। কিন্তু শৌখিন বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিলেন, বড় আঘাত আসছে। ৩০ মার্চ। কিছুটা বড় ভূমিকম্প। মান ৪.২। সরকারের তরফে কমিটি বসানো হল। ছ’জন বিজ্ঞানী, এক জন আমলা। বলতে হবে বড় ভূমিকম্প সত্যিই আসছে কি-না। কমিটি পর্যালোচনায় বসল। সিদ্ধান্ত: না, বড় আঘাত আসছে না। ছোট ছোট আঘাতে বরং বড় কিছু ঘটার সম্ভাবনা কমেছে। কমিটির তরফে প্রেস কন্ফারেন্স। উপস্থিত এক টিভি সাংবাদিকের প্রশ্ন: আপনারা তা হলে বলছেন শহরবাসীরা ভাল মদের বোতল নিয়ে আয়েস করতে পারেন? আমলার জবাব: হ্যাঁ।

৬ এপ্রিল। ভোরবেলায় বড় ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে মান ৬.৩। মারা গেল ৩০৯ জন মানুষ। আহত ১৬০০। বাড়ি ভেঙে পড়ল কয়েকশো। এ বার কোর্টে মামলা। ২৯ জন মৃত মানুষের আত্মীয়দের তরফে। তারা কারা? এমন সব মানুষ, যারা শৌখিন বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণীতে ভয় পেয়ে শহর ছেড়ে যাবেন মনস্থ করেও পরে কমিটি সদস্যদের অভয়বাণীতে মত বদলান। এবং ভূমিকম্পে মারা যান। তাদের আত্মীয়দের দাবি বিশেষজ্ঞরা সঠিক পূর্বাভাস দেননি বলেই ওদের প্রাণ গেছে। সুতরাং, বিজ্ঞানীরা হত্যাকারী। শাস্তি হোক। হল। ২২ অক্টোবর, ২০১২। বিচারক রায় দিলেন, কমিটির সাত সদস্যের ছ’বছর কারাদণ্ড।

বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানীরা বিক্ষোভে উত্তাল। ভূমিকম্পের সঠিক পূর্বাভাস সম্ভব নয়। তবে ওই বিশেষজ্ঞরা কেন হবে হত্যাকারী? শ’য়ে-শ’য়ে বিজ্ঞানীর চিঠি গেল ইতালির প্রেসিডেন্টের ঠিকানায়। বিশেষজ্ঞদের শাস্তি রদ করুন। বিশেষজ্ঞরা নিজেরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেন। ১০ নভেম্বর, ২০১৪। আপিল কোর্টের রায় বেরোল। ছ’জন বিশেষজ্ঞ মানুষ হত্যার দায় থেকে মুক্ত। তবে আমলার শাস্তি দু’বছর জেল। মৃত মানুষের আত্মীয়রা রায়ে অসন্তুষ্ট। তারা এ বার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ। মামলা জারি।

ফের কাঠগড়ায় বিজ্ঞানী। অনেকের চোখে নাকি বিজ্ঞান শাস্ত্রটাই। যদিও, এই সরলীকরণ ঠিক নয়। গুটিকয় চর্চাকারীর জন্য কেন অপবাদের ভাগী হবে গোটা শাস্ত্রটা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE