Advertisement
E-Paper

ভোটের মুখে নারীর নাম, আদতে সম্মান করেন তো?

মিমি বা নুসরত বলে নয়, এক জন মানুষ হিসাবে, এক জন রাজনৈতিক প্রার্থী হিসাবে তাঁদের সমালোচনা করুন। তাতে আপনাদেরও রাজনৈতিক বোধ বিকশিত হবে।

আবু তাহের

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৯ ০৫:৫৫

লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলের প্রার্থী ঘোষণার পর পরই মানুষের আলোচনার মোড় অন্য দিকে ঘুরে গিয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল থেকে শুরু হয়েছে এক কদর্য আলোচনা। রাজনীতি বুঝুক আর নাই বুঝুক সমস্ত মানুষের মধ্যে এই নিয়ে তুমুল উত্তেজনা। গণতান্ত্রিক দেশে মানুষ তার মতামত প্রকাশ করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এই নয় যে, কারও উপর ব্যক্তি আক্রমণ করে কথা বলা হবে।

ঘটনার সূত্রপাত মঙ্গলবার লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুর এবং বসিরহাট লোকসভায় প্রার্থী ঘোষণার পর পরেই। যাদবপুরে টলিউডের অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তীর নাম ঘোষণা করা হয়। আর বসিরহাটে নুসরত জাহান। তিনিও বিগত কয়েক বছর ধরে টলিউডের নামকরা অভিনেত্রী। এখন কথা হল তৃণমূলের দলীয় পরিষদ প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাঁদের কোনও দুরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে কি না, তা অবশ্যই আলোচনা সাপেক্ষ। আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে নুসরত জাহান কিংবা মিমি চক্রবর্তীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং তাঁদের যোগ্যতা নিয়েও। কিন্তু এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু যদি অন্য কিছুকে ঘিরে আবর্তিত হতে শুরু করে, তবে তা মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। দেখা যাচ্ছে চায়ের ঠেক থেকে শুরু করে ট্রেনের কামরা, অফিসের জানলা থেকে নিয়ে বাড়ির বারান্দা— ছোট বড় সকলের মুখে আলোচনার বিষয় মিমি এবং নুসরত। তা-ও যদি সবাই রাজনীতির মাপকাঠি আর আলোচনার গুরুত্ব বুঝত— সে না হয় ছিল এক কথা। চটকদার সব মিম বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া চলছে। আঠারো থেকে ও আটানব্বই সবাই গিলতে শুরু করেছে সেই চটুল মিমগুলো। আর হাসির ফোয়ারা বেরিয়ে পড়েছে। আজকাল কোনও বিষয়কে কেন্দ্র করে বিরোধিতা করতে হলে তো সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো খাপ পঞ্চায়েত বসে যায়! মিমি, নুসরতও এখন সেই খাপের অংশবিশেষ।

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবস গেল। নারীদিবসের অনুষ্ঠানের ফুলের গন্ধ এখনও দিনটির শরীর থেকে মুছে যায়নি। সেই মুহূর্তেই এমন দু’জন মহিলা প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হল লোকসভা নির্বাচনে তাতে আমাদের অনেকেরই চোয়া ঢেকুর উঠতে শুরু করেছে। যারা মিমি আর নুসরতকে নিয়ে নোংরা মিম বানিয়ে মজা নিচ্ছে, তাদের নিয়ে একটা জিনিস পরিষ্কার— কিছু মানুষ হয়ত মিমি এবং নুসরতের রাজনৈতিক যোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতার দিকে আলোকপাত করছে। কিন্তু বেশিরভাগই যেটা করছে সেটা মনের মধ্যে পুষে রাখা একটা বিকৃত কামনার বহিঃপ্রকাশ। নিজেদের মনের কোণে পুষে রাখা অভিনেত্রী নারীদের প্রতি কামনার লোলুপ দৃষ্টি তাদের মনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল এতদিন। এই ঘটনার পর তা যেন স্পষ্ট ভাবে সামনে এসেছে।

শুধু মাত্র এক জন নারী হিসেবে কাউকে অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শনের চেয়ে মানুষ হিসেবে প্রত্যেকটি মানুষকে অসম্মানের হাত থেকে রক্ষা করা উচিত। সেটুকুও কিন্তু মিমি বা নুসরতের ভাগ্যে জুটছে না।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মিমি বা নুসরত সবেমাত্র ভোটে দাঁড়িয়েছেন। এখনও আমরা জানি না, তাঁদের কাজের হিসাব নিকাশ। তাঁরা যদি সংশ্লিষ্ট লোকসভা কেন্দ্র থেকে ভোটে জেতেন‌, তার পরেও যদি জনগণ তাঁদের কাছ থেকে প্রাপ্য কাজ না পায়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই তা হবে তাঁদের রাজনীতিতে অযোগ্যতার প্রমাণ। কিন্তু তার আগেই এই আক্রমণের অর্থ কী?

আমাদের ভারতে বর্তমানে বিজেপি শাসিত এমন অনেক রাজ্য রয়েছে যেখানে এমন ঠুঁটো জগন্নাথ বসে আছে, যারা জনগণের জন্য কাজ না করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার ব্যাপারে সদাই তৎপর। সেখানে মিমি-নুসরতের কাজের খতিয়ান দেখার আগেই তাঁদেরকে নিয়ে কদর্য নোংরামি শুরু হয়ে গিয়েছে বাংলায়।

এক জন মানুষ অভিনয় করেন বলেই তিনি কোন‌ও দিন রাজনীতিতে আসবেন না, এমন ভাবনাটাই অবান্তর। কেউ এক জন জন্মেই ভাল এবং দক্ষ রাজনৈতিক নেতা হয়ে যান না। তাঁকে জনগণের ভালবাসা অর্জন করতে হয় জনহিতকর কাজের মধ্যে দিয়ে। এমন দক্ষ রাজনৈতিক নেতা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের কোনও কাজে আসবেন না, যদি তিনি জনগণের জন্য কাজ না করে নিজের আখের গোছাতেই ব্যস্ত থাকেন। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাই-ই হচ্ছে। দক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন জনবিরোধী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে। তাই রাজনীতিক হিসেবে কে কোন জায়গায় থাকবেন, সেটা আমজনতাই ঠিক করে দেবে। ভোটের ক্ষমতা প্রয়োগ করে।

রাজনৈতিক যুক্তি, বুদ্ধি, মেধা, আলোচনা সরিয়ে রেখে যে কথাটা আলোচ্য হয়ে উঠেছে, তা হল মিমি এবং নুসরতের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ কে কতটা করতে পারছে! মিমি আর নুসরতের বিভিন্ন সিনেমার ছবি পোস্ট করে তাতে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য লেখা চলছে। এক জন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের কবর খুঁড়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করার মধ্যে দিয়ে স্বচ্ছ রাজনীতির চর্চা করা সম্ভব নয়, এটাও মনে রাখা দরকার। এক জন নারীকে কী ভাবে প্রতি মুহূর্তে অপমানিত করা যায়, সামাজিক ভাবে ধর্ষিত হতে হয় তার জলজ্যান্ত প্রমাণ সমাজ মাধ্যমে শেয়ার হতে থাকা এই সব মিম।

তাই মনে হয়, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে নারীদিবস, মাতৃদিবস ইত্যাদি পালন না করে প্রতি দিন আমরা নিজেদের পরিবার থেকে যেন কিছু সামাজিক আচরণ শিখতে পারি। যা বাড়ি এবং বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই মেয়েদের সম্মান করতে শেখাবে।

মিমি বা নুসরত বলে নয়, এক জন মানুষ হিসাবে, এক জন রাজনৈতিক প্রার্থী হিসাবে তাঁদের সমালোচনা করুন। তাতে অন্তত আপনাদেরও রাজনৈতিক বোধ বিকশিত হবে। এবং মনুষ্যত্বের অপমান হবে না।

জেএনএম-এর চিকিৎসক

Lok Sabha Election 2019 Mimi Chakrabarty Nusrat Jahan TMC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy