শতং বদ, মা লিখ। এমন একখানা প্রজ্ঞা তো আকাশ থেকে পড়েনি, জ্ঞানীগুণীরা অনেক ঘাটের জল খেয়ে শিখেছিলেন— মুখে যা খুশি বলো, একশো বার বলো, কিন্তু লিখতে যেয়ো না, তা হলেই বিপাকে পড়বে। যা দিনকাল পড়েছে, মুখের কথাও এখন আর নিরাপদ নয়। কেউ রেকর্ড করে ফেললে তার মারণক্ষমতা লিখিত অক্ষরের সহস্রগুণ হয়ে উঠতে পারে। আর, ডিজিটাল বক্তৃতা তো বুমেরাং হওয়ার জন্য বলিপ্রদত্ত, একটু অসাবধান হলেই চিত্তির। কাণ্ডজ্ঞানের এই প্রথম ভাগটি ভুলে গিয়ে নীতি আয়োগের বড়কর্তা অমিতাভ কান্ত সম্প্রতি শুকনো ডাঙায় আছাড় খেলেন। একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে কথায় কথায় কেবল বলেছিলেন, ‘উই আর টু মাচ অব আ ডেমোক্র্যাসি’। শুনেই লোকজন মাৎ-মাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল: ‘গণতন্ত্রের বাড়াবাড়ি? এ কী অন্যায় কথা? অ্যাঁ?’ বড়কর্তা তড়িঘড়ি জানালেন, ‘আমি মোটেই এ-রকম কিছু বলিনি’— তিনি নাকি রফতানি নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। কাকটা অমনি দুলে দুলে মাথা নেড়ে বলল, “হয় নি, হয় নি, ফেল্।”
বেকুব বনে যাওয়ার পরে নিজের ওপর রাগ হয়, আবার একটু অবাকও লাগে। বেচারা বড়কর্তাও হয়তো ভাবছেন, কী আশ্চর্য! রোজ নিজেদের মধ্যে যে-কথা বলাবলি করি, জনসমক্ষে সেটা উচ্চারণ করে ফেলেছি বলে এত হট্টগোল! ঠিকই। যাঁরা ক্ষমতার চেয়ারে বসেন, কেবল বড় চেয়ার নয়, মেজো সেজো ছোট যে কোনও মাপের চেয়ারে বসলেই হল, তাঁরা অনেকেই নানা উপলক্ষে বলে থাকেন— এত গণতন্ত্র চলে না, সকলের সব কথা শুনতে গেলে আর কাজ করে ওঠা যাবে না। নীতি আয়োগের সেনাপতিও তেমনটাই মনে করবেন, এ অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। এবং, ভুললে চলবে না, তিনি মন্তব্যটি করেছেন এক বিশেষ পরিস্থিতিতে, যখন কৃষকদের বিক্ষোভে কৃষি আইন বানচাল হতে বসেছে, মাস দুয়েক আগে যে কৃষি আইন পাশ হওয়ার পরে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, নব্বইয়ের আর্থিক সংস্কার এত দিনে কৃষিতেও এসে পৌঁছল। এমন যুগান্তকারী পদক্ষেপ চাষিদের বাধায় থমকে যাবে? এবং তার পরেও সত্যি কথাটা মুখ ফুটে বলা যাবে না? এ-রকম হলে বিশ্বসংসারের ওপরেও রাগ ধরে যায় বইকি, মনে হতেই পারে, নিকুচি করেছে এই ভণ্ডামির। যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না, ব্যস। সারাক্ষণ পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকতে হবে কেন?
উত্তরে বলতেই হয়: সত্য, সে যে সুকঠিন। সত্য এই যে, ক্ষমতার অধীশ্বররা সংস্কারের নামে অর্থনীতিকে যে পথে নিয়ে যেতে চান, গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তটুকু মানলেও তাঁরা সে পথে এগোতে পারবেন না। তার সহজ কারণ— সেই পথে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের লোকসান, লাভ কেবল তাঁদের, যাঁরা অর্থনীতির সিংহভাগ নিজেদের দখলে রেখেছেন এবং সিংহতর ভাগ দখল করাই যাঁদের একমাত্র সাধনা। অতএব গণতন্ত্রকে পদতলে রেখে অথবা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েই তাঁদের পছন্দসই সংস্কার সম্ভব। এ বিষয়ে যদি কোনও সংশয় থেকেও থাকে, সংসদের গত অধিবেশনটির পরে তা নির্মূল হয়েছে। কৃষি আইন এবং শ্রম আইন, এই দু’টিই বদলানোর চেষ্টা চলছিল বহু দিন ধরে, মোদী জমানার অনেক আগে থেকেই। সেই চেষ্টার পিছনে কর্পোরেট দুনিয়ার নিরন্তর চাপ ছিল: কৃষিপণ্যের বাজার খুলে দেওয়ার চাপ, সংগঠিত শ্রমিকদের যেটুকু রক্ষাকবচ আছে সেটুকুও সরিয়ে নেওয়ার চাপ। একের পর এক সরকার সেই ফরমায়েশ মেটানোর চেষ্টা চালিয়েছে, সংসদীয় গণতন্ত্রের গাঁট পেরিয়ে কাজটা হাসিল করতে পারেনি। অতিমারির আতঙ্ক এবং শাসক দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, দুইয়ের মিলিত আশীর্বাদে সেই গ্রন্থিটি এ-বার ছিন্ন করা গেল, আইন পাশ হয়ে গেল, রাষ্ট্রনায়করা বললেন: ‘ঐতিহাসিক’, অমিতাভ কান্তরা বৃন্দগান গাইলেন: ‘ঐতিহাসিক’। ঐতিহাসিক তো বটেই— ভারতীয় অর্থনীতিতে কর্পোরেট শাসনের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় শুরু হল। গণতন্ত্রের দাবি মেনে, সব প্রতিবাদ এবং সমালোচনার সদুত্তর দিয়ে বা নিজেদের নীতি শুধরে নিয়ে, কৃষিজীবী এবং শ্রমজীবী-সহ বৃহত্তর সমাজের সম্মতি উৎপাদন করে এই অগ্রগতি সম্ভব নয়, রথের চাকা গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের জমিতে বসে যাবে।