Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
নানা মুনির নানা মতের জেরে মশারা বাড়ছে হুহু করে

এ রাজ্য এখন ডেঙ্গিমুক্ত?

হু-র সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করা এক পরজীবী বিশেষজ্ঞের দাওয়াই, কোনও পতঙ্গ সংক্রামক রোগজীবাণুর বাহক হলে প্রথমে সেই বাহক (ভেক্টর)-কে নির্মূল করাই লক্ষ্য হওয়া উচিত।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৪৭
Share: Save:

এ রাজ্যে ডেঙ্গির জীবাণুদের এখন মহা আনন্দ।

পুজোর আগে রীতিমতো উৎসবের পরিবেশ। তাদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাটাই যে খুঁড়িয়ে চলছে রাজ্যে!

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, এনসেফ্যালাইটিসের মতো পতঙ্গবাহিত সংক্রামক রোগগুলিকে ঠেকাতে নির্দিষ্ট নির্দেশিকা তৈরি করে দিয়েছে। সেই নির্দেশিকা অনুসরণ করে অনেক দেশকেই ‘ডেঙ্গিমুক্ত’ কিংবা ‘এনসেফ্যালাইটিস মুক্ত’ বলে ঘোষণা করেছে হু। ওই সব এলাকায় হু-র গাইডলাইন কিংবা নির্দেশিকা অক্ষরে অক্ষরে মানা হচ্ছে কি না, সংশ্লিষ্ট রোগটা পর পর তিন বছর প্রায় শূন্যের কাছাকাছি থেকেছে কি না, সে সব দেখেই ওই রোগমুক্তির তকমা দিয়ে থাকে হু।

হু-র সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করা এক পরজীবী বিশেষজ্ঞের দাওয়াই, কোনও পতঙ্গ সংক্রামক রোগজীবাণুর বাহক হলে প্রথমে সেই বাহক (ভেক্টর)-কে নির্মূল করাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। তার জন্য বছরভর অভিযান চালিয়ে যেতে হয়। আর যেখানে এক বার সংক্রমণ ছড়ায়, জায়গাগুলিকে চিহ্নিত করে একেবারে তৃণমূল স্তরে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। তার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে জানাতে হবে যে, সেখানে রোগটি ছড়াল কী ভাবে। সংক্রমণ কতটা ছড়াল সেটা চেপে রাখাই যদি দাওয়াই হয়, এলাকার মানুষের যদি রোগ সম্পর্কে সম্যক ধারণাই না-থাকে, তবে সচেতনতা অভিযানের অর্থই থাকে না, বলে জানাচ্ছেন ওই পরজীবী বিশেষজ্ঞ।

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কয়েক বছর ধরে তাই সচেতনতা অভিযান কোনও রকম সুফল দিতে ব্যর্থ। তথ্য গোপনের রোগ এমন ভাবে সংক্রমিত হয়েছে যে, অনেক ক্ষেত্রে রোগটা কী, সেটাই ধরা পড়ছে না। বলা ভাল, ধরা পড়লেও, তা নথিভুক্ত হচ্ছে না। আর নথিভুক্ত না হওয়ায় রাজ্যের তরফে যে তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে, তাতে নামই থাকছে না আক্রান্তদের এলাকার। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের চিহ্নিতকরণ এলাকার মানচিত্রের বাইরে থেকেই যাচ্ছে ওই সব এলাকা। আসলে নবান্ন, স্বাস্থ্যভবন আর পুরসভায় এত বেশি ‘বিশেষজ্ঞ’ যে আসল কাজটাই শিকেয় উঠেছে।!

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হাত ঘুরে হু-র কাছে রাজ্যের ডেঙ্গি পরিস্থিতির ঠিকঠাক রিপোর্টই গেল না, রাজ্যের এক মন্ত্রী নবান্নে ঘোষণা করে ফেললেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ ডেঙ্গিমুক্ত’ হতে চলেছে! কিসের ভিত্তিতে এমন মন্তব্য, তার কোনও ব্যাখ্যা কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী দেননি। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তা সব দেখেশুনে বিরক্ত। তাঁর কথায়, ‘‘গত বছর থেকে আমাদের ডেঙ্গি-তথ্য পাঠাতে গড়িমসি করছে পশ্চিমবঙ্গ। কোনও রাজ্য কোনও রোগ থেকে মুক্ত হতে চলেছে কি না, তা তো হু-র সঙ্গে কথা বলে আমরা ঠিক করব।’’ এ সব কথায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। গোটা রোগ নিরাময় পদ্ধতিটাই এর ফলে বাধাপ্রাপ্ত হয় বলে মন্তব্য ওই স্বাস্থ্যকর্তার।

রাজ্য যদি ডেঙ্গি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নিয়মিত তথ্য না পাঠায় তাতে ক্ষতি কার? স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। খোদ মুখ্যমন্ত্রী (যিনি স্বাস্থ্য দফতরেরও দায়িত্বে) তথ্য দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর সেই সিদ্ধান্ত ঠিক বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীও। এর পরে সঙ্গত কারণেই সরকারি চিকিৎসকেরা মুখ খুলতে পারছেন না। তবে কলকাতা পুরসভার প্রবীণ অফিসারেরা কেউ কেউ ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় প্রশ্ন তুলেছেন, এই ধরনের একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্য সরকার ‘কালিদাস’-এর ভূমিকা নিচ্ছে না তো!

আসলে রাজ্যের মশা মারতে যে তেল ব্যবহার করা হয়, তা সরবরাহ করে কেন্দ্রীয় সরকার। কতটা কীটনাশক রাজ্যকে দেওয়া হবে, তা ঠিক হয় রাজ্য থেকে পাঠানো তথ্যের নিরিখে। তথ্যে যদি আক্রান্ত, মৃতের সংখ্যা কম থাকে, তা হলে পরবর্তী বছরের জন্য সেই রাজ্যের বরাদ্দ কমে যাবে। কলকাতা পুরসভার ওই কর্তার মন্তব্য, মশা নিয়ন্ত্রণে কাউন্সিলরদের যতটা সক্রিয় হওয়া উচিত, তাঁরা ততটা হচ্ছেন না। তার উপরে কীটনাশকের পরিমাণ কমে গেলে ক্ষতিটা কিন্তু কলকাতাবাসীদেরই।

হু বলছে, জ্বর হলে কিংবা ডেঙ্গির অন্য উপসর্গ ধরা পড়লে, যত তাড়াতাড়ি রক্ত পরীক্ষা করানো যায়, ততই ভাল। কিন্তু চিকিৎসকদের জন্য নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসাবিধি রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসকদের অনেকে রক্ত পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে গড়িমসি করছেন।

সমস্যা আরও রয়েছে। নবান্ন থেকে ঘোষণা করা হল, বেসরকারি ক্লিনিকের দেওয়া রিপোর্ট কলকাতা পুরসভা এবং রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর পরীক্ষা করে দেখবে। তার পরেই বলা যাবে, রোগটা আসলে কী। কলকাতা পুরসভা আর স্বাস্থ্য দফতরের ল্যাবরেটরি যত দিন না আসল রোগটা জানাবে, তত দিন রোগীর চিকিৎসা কী হবে, সেই ব্যাপারে কিন্তু কোনও সরকারি নির্দেশিকাই নেই। বরং পুরসভার ক্লিনিক এবং সরকারি হাসপাতালগুলি রিপোর্ট দিতেই বেশি সময় নিচ্ছে।

শহরের একটি নামী বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত এক সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, ডেঙ্গি, ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া কিংবা এনসেফ্যালাইটিসের মতো পতঙ্গবাহিত সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি রিপোর্ট পাওয়া যাবে ততই রোগীর পক্ষে মঙ্গল। রাজ্যের হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র পুরসভার ক্লিনিকে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। রিপোর্ট পেতে যত সময় লাগবে, ততই রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ে শরীরে। স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তার যুক্তি, যে যন্ত্রের সাহায্যে ডেঙ্গি জীবাণু শনাক্ত করা হয়, তাতে এক সঙ্গে অনেক নমুনা লাগে। তাই ওই সংখ্যক নমুনা না-পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হয়।

এ হেন যুক্তি শুনে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তা তো অবাক। তিনি বলছেন, কলকাতা শহরে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি বিশ্বমানের চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে সংক্রামক রোগজীবাণু নির্ণয়ের পরিকাঠামো রয়েছে। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর সেই পরিকাঠামোর সাহায্য নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ তুলেছেন ওই স্বাস্থ্যকর্তা। নবান্নের নির্দেশ না-আসা পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্যে নারাজ স্বাস্থ্য ভবন। রাজ্য সরকারের অবসরপ্রাপ্ত এক স্বাস্থ্যকর্তার আবার সন্দেহ, কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থায় রক্তের নমুনা পাঠালে আসল তথ্যটা ফাঁস হয়ে যেতে পারে। তাই হয়তো এই নিষেধাজ্ঞা!

আর এই নানা মুনির নানা মতের জেরে মশারা বাড়ছে হুহু করে। আর মশার পেটে সওয়ার হয়ে ডেঙ্গির জীবাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি, বাসন্তী থেকে বনগাঁ। মাল্টি অর্গ্যান ফেলিয়োর, হেমারেজিক শক ফ্রম ফিভার কিংবা অ্যাকিউট ডিহাইড্রেশনের ছদ্মনামে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে রাখার চেষ্টা চলায় আসল রোগটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। তাদের উৎস খোঁজারও প্রয়োজন হচ্ছে না। জনপ্রতিনিধিরা মশা নিধনের কাজ থেকে মুক্তি পেয়ে অনেকেই পুজো কিংবা পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠন অথবা সিন্ডিকেট প্রতিপালনের মতো ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন।

আর এই অবস্থার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে আণুবীক্ষণিক প্রাণী ডেঙ্গি-জীবাণু। এ রাজ্যে ডেং-২ প্রজাতির যদি রমরমা হয়, তা হলে অনুকূল পরিস্থিতি পেয়ে ওই জীবাণু অন্য রাজ্য থেকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসছে তাদের জাতভাই ডেং-১, ডেং-৩ বা ডেং-৪’কে। পুজোর মুখে তারা জাঁকিয়ে বসছে এ রাজ্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

WHO West Bengal Health Department Dengue
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE