Advertisement
E-Paper

ডাক্তারবাবু ও তাঁর রোগীরা

ছবিটা শুধু ওই একটি জনপদের নয়। অনেক ক্ষেত্রেই ডাক্তার এবং অন্য নানা জরুরি সুযোগসুবিধার অভাবে সরকারি ব্যবস্থাগুলো অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে।

তোয়া বাগচী

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৮ ০১:১৮

নাজমা খাতুন (নাম পরিবর্তিত)। বারাসত–২ ব্লকের এক গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে তাঁর চায়ের দোকান। চা খেতে খেতে কথা হয়। “পুজোর কয়েক মাস আগে অবধিও হাসপাতালের সামনে এই লম্বা লাইন পড়ত। চা বানিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারতাম না। এখন সেই ডাক্তারবাবুও নেই, মানুষও তেমন আর আসে না, দোকানে ভিড়ও কমে গিয়েছে। মাঝেমধ্যে দু’এক জন ডাক্তার শহর থেকে আসেন বটে, কিন্তু তাঁদের আসাযাওয়ার ঠিক থাকে না। অসুস্থ মানুষগুলো অনেক সময়ই অপেক্ষা করে করে চলে যায়।”

ছবিটা শুধু ওই একটি জনপদের নয়। অনেক ক্ষেত্রেই ডাক্তার এবং অন্য নানা জরুরি সুযোগসুবিধার অভাবে সরকারি ব্যবস্থাগুলো অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দফতরের তথ্য বিভাগ বলছে, ২০১৫ সালের হিসেবে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ৭২ শতাংশ অনুমোদিত ডাক্তারের পোস্ট খালি। বারাসত–২ ব্লকেই ২০১৮-য় দু’টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চারটি অনুমোদিত ডাক্তারের পোস্টের মধ্যে একটি কেন্দ্রে এক জন ডাক্তার আছেন। বস্তুত সেখানেও এখন কোনও নির্দিষ্ট ডাক্তার নেই, নিকটবর্তী গ্রামীণ হাসপাতাল বা জেলা হাসপাতাল থেকে সুবিধামতো ডাক্তার আসেন। স্বভাবতই, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে গ্রামের মানুষের যোগাযোগ ঠিকমতো গড়ে ওঠে না। যিনি আজ আসছেন, তিনি পরের দিন আসবেন কি না ঠিক নেই। মানুষ চেনার তাগিদটাও তাই কোনও পক্ষেই তৈরি হয় না। আগের ডাক্তারবাবু ওখানে থাকতেন, তাই গ্রামের মানুষগুলোর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন, যত্নবান ছিলেন। এলাকার মানুষও যে কোনও সমস্যায় সবার আগে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দৌড়ে যেতেন। প্রাথমিক সমীক্ষায় দেখেছি, গ্রামের ৫৫ শতাংশ মানুষই ছোটখাটো যে কোনও অসুবিধায় সরকারি এই ব্যবস্থাতেই ছুটে আসতেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখা গেল, যাঁরা এই সরকারি ব্যবস্থাপনায় গত ছ’সাত বছরে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, আগের ডাক্তারবাবু চলে যাওয়ায় তাঁদের এক অসহায় অবস্থায় পড়তে হয়েছে। নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্যান্য সুবিধা না থাকায় এঁদের মধ্যে অনেকেই প্রাইভেটে বেশি পয়সা দিয়ে বা সরাসরি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ভিড় করছেন। কারও কারও উপায়ান্তর না থাকায় হাতের কাছে থাকা হাতুড়ে ডাক্তারই ভরসা। আবার বেশি পয়সায় প্রাইভেট ডাক্তারের খরচও সামলাতে না পেরে অনেক মানুষ ফিরে আসছেন, চিকিৎসা না করিয়েই। কেউ যাচ্ছেন সরকারি হাসপাতালে।

ইদানীং আমরা যা কিছু প্রাইভেট, তাকেই ভাল বলে ভেবে নিচ্ছি। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় না। সরকারি ব্যবস্থার নানা গলদ আছে বটে, কিন্তু এ-ও সত্যি যে, সরকারি ব্যবস্থা থেকে ন্যূনতম পরিষেবাটুকু পেলেও মানুষ প্রথমে সেখানেই ভিড় করেন। বাস্তব উদাহরণ ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। গ্রামের বৌ নীলিমার কথায়, “আগে ডাক্তার দেখাতে হলে ভোরবেলায় গিয়ে লাইন দিয়ে টিকিট করতাম, টিকিট কেটে বাড়ি এসে কাজ সেরে আবার লাইনে দাঁড়াতাম। এ ভাবেই বাড়ির কাজ, ডাক্তার দেখানো, সব দিক সামলাতাম। এখন তো আর সেই ভিড় নেই, দরকার হলে যাই, ডাক্তার থাকলে ভাল, নয়তো ফার্মাসি থেকে যে ওষুধ দেয় তা-ই নিয়ে আসি।” নীলিমার কথায় ডাক্তার থাকাকালীন ফার্মাসির দেওয়া ওষুধে অসুখ সারত, ‘‘এখন আর সে ওষুধও কাজ করে না।’’ এ কি শুধুই ওষুধের মানের অবনয়ন, না কি মানুষের বিশ্বাসে চিড়!

পরিষেবাটা ঠিকঠাক চললে মানুষ যে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপরেই নির্ভরশীল হয়, তার নিদর্শন অনেক। কিন্তু এই পরিষেবা প্রদানের অন্যতম কান্ডারি ডাক্তারদের যদি ন্যূনতম পরিষেবাটুকুও না দেওয়া যায়, তাঁরাই বা কেন দিনের পর দিন গ্রামের এক প্রান্তে পড়ে থাকবেন? হ্যাঁ, এর মধ্যেও কিছু ডাক্তার কাজ করে চলেছেন। কিন্তু তাঁরা করছেন বলেই যে সবাই সেটা করবেন, এমনটা ধরে নেওয়ার কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। আমরা অনেকেই কারণে অকারণে ডাক্তারদের গালমন্দ করি, কিন্তু বাড়ি থেকে দূরে ন্যূনতম পরিষেবাহীন একটা পরিবেশে আমরা কত জনই বা এই রকম একটা মহাযজ্ঞ চালিয়ে যেতে পারতাম সেটাও ভেবে দেখা দরকার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা বাধ্য হয়ে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছেন যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও ঠিকঠাক মেলে না। এই অবস্থায় তাঁদের থেকে বিশাল কিছু আশা করাটা বাড়াবাড়ি নয় কি?

অথচ সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই অন্য রকম হতে পারত। ওই গ্রামেই দেখা যাচ্ছে সাব-সেন্টারের দিদিরা বা গ্রামের মেয়েরা, যাঁরা ওই অঞ্চলের আশাকর্মী, তাঁরা অনবদ্য কাজ করে চলেছেন। রাতবিরেতে ছোটখাটো দরকারে গ্রামের মানুষ আশাদিদিদের কাছেই দৌড়চ্ছেন। আশাকর্মী সুমনাদির কথায়, “হয়তো বিশেষ কিছু করতে পারি না, কিন্তু ওই যে সামনে গিয়ে দাঁড়াই— ওদের মনে হয় যে, সরকারি তরফে কেউ এক জন তো আছেন। ওরা মনে বল পায়, এইটুকুই।”

শুনতে খুব খারাপ লাগলেও অনেক ক্ষেত্রেই এ রকমও দেখা যায়, কিছু ডাক্তার গ্রাম থেকে আসা এই চাষাভুষো মানুষগুলোকে চিকিৎসা করার সময় ছুঁয়ে দেখা তো দূর, মুখ তুলেও তাকান না। বিভিন্ন গবেষণাতে দেখা গিয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের আর্থ–সামাজিক অবস্থার ওপর ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ কথা সত্যি যে, হাসপাতালে বসা ডাক্তারবাবুর পক্ষে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শ’খানেক লোককে হাসিমুখে দেখে যাওয়া কঠিন, কিন্তু অসুস্থ মানুষটিকে তাঁর প্রাপ্য সামান্য সম্মানটুকু দেখানো হয়তো অসম্ভব নয়।

সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা অসহায় মানুষরাই বেশি ব্যবহার করেন। সে কারণেই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সুযোগসাম্যের দাবিটা এত জোরালো। সবার স্বাস্থ্য সমান নয়, কিন্তু সবাই যাতে স্বাস্থ্যের সমান সুযোগ পান, সেটা দেখা তো একটা সভ্য-কর্তব্য। সুযোগসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অনেক বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। ডাক্তাররা হয়তো আশাকর্মী বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিদিদের মতো স্থানীয় সমাজের অংশ হতে পারবেন না, কিন্তু আমরা সকলেই একটা সামগ্রিক কমিউনিটির কথা ভাবতে পারি, যেখানে আশাকর্মী থেকে শুরু করে, ডাক্তার, নীতিনির্ধারক, সকলেই অংশ নিতে পারবেন। হয়তো এই চিন্তা থেকেই এক দিন সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা সচল হয়ে উঠবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে আবারও লাইন পড়বে— নাজমার চায়ের দোকানের সামনে লোকেরা জড়ো হবেন, পরস্পরের খোঁজ নেবেন। কেমন আছেন— এই বলাটুকুও হয়ে উঠবে অনেক বেশি প্রাণবন্ত, আন্তরিক।

ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেল্থ, কল্যাণী-তে গবেষক

Doctors rural areas
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy