Advertisement
০৭ মে ২০২৪
coronavirus

অসহায়তার দিবারাত্রি

চাষির নিকট সহজ শর্তে ও সুলভে ঋণ না পৌঁছাইলে কৃষি লাভজনক হইবে না, চাষির রোজগার বাড়িবে না। কৃষির উন্নয়নে যথেষ্ট বিনিয়োগও হইবে না। কৃষিঋণের বিস্তার প্রয়োজন।

শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

আরও কুড়ি লক্ষ চাষিকে কৃষিঋণের সুবিধা দিবার সিদ্ধান্ত করিয়াছে রাজ্য সরকার। অতিমারি ও ঝঞ্ঝার প্রকোপে বিপর্যস্ত চাষির হাতে আগামী খরিফ চাষের পূর্বে টাকা তুলিয়া দিবার জন্য এই উদ্যোগ। সিদ্ধান্তটিতে সুবিবেচনার ছাপ অনস্বীকার্য। ইহা কেবল বাংলার চাষির দুঃসময়ের সহায়তা নহে, তাহার প্রতি একটি সুদীর্ঘ অন্যায়ের অবসানের সম্ভাবনাও ইহাতে রহিয়াছে। ব্যাঙ্কের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ অধিকাংশ চাষির নিকট পৌঁছায় না। অবশ্য, তাহা শুধু পশ্চিমবঙ্গে নহে— গোটা দেশেই। এবং, গোটা দেশেই ব্যাঙ্কের কর্তারা ও সরকারি আধিকারিকরা এই সত্যটি জানিয়াও স্বীকার করিতে চাহেন না। কিসান ক্রেডিট কার্ড কবে কত বিতরণ করা হইয়াছে, ঋণের মোট অঙ্ক কত এবং কত বকেয়া, তাহার হিসাব ব্যাঙ্কগুলি বরাবর দাখিল করিয়াছে। কিন্তু বাস্তবিক কত চাষি খরিফ বা রবি মরশুমে ব্যাঙ্ক ঋণের সুবিধা পাইতেছেন, তাহার প্রকৃত হিসাব ব্যাঙ্কের নিকট হইতে কালেভদ্রেও মিলে না। আশ্চর্য নহে। রাজ্য সরকারের হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে কৃষিজীবী মানুষের সংখ্যা একাত্তর লক্ষ, কিন্তু কিসান ক্রেডিট কার্ডে ঋণ লইতেছেন মাত্র পনেরো লক্ষ। অর্থাৎ, মোট কৃষিজীবীর কুড়ি শতাংশ। স্মর্তব্য, রাজ্য সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্তে আরও কুড়ি লক্ষ কৃষিজীবী ঋণের সুযোগ পাইবার পরও রাজ্যের অর্ধেক চাষি প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের বাহিরে থাকিয়া যাইবেন। এই চিত্র আশ্বস্ত করে না, চাষির বিপন্নতাই প্রকাশ করে। এবং বলিয়া দেয়, যুগল বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত চাষিদের জন্য সরকারি ঋণের ব্যবস্থা করা কতখানি জরুরি। চাষির নিকট সহজ শর্তে ও সুলভে ঋণ না পৌঁছাইলে কৃষি লাভজনক হইবে না, চাষির রোজগার বাড়িবে না। কৃষির উন্নয়নে যথেষ্ট বিনিয়োগও হইবে না। কৃষিঋণের বিস্তার প্রয়োজন।

ঋণ দিবার ক্ষেত্রে কৃষিকে প্রাধান্য দিবার কথা ব্যাঙ্কেরও। মোট ঋণের আঠারো শতাংশ কৃষিকে দিবার নির্দেশ দিয়াছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। কিন্তু চাষিকে অধিক ঋণ দিবার জন্য সওয়াল করিলেই ব্যাঙ্ক আশঙ্কা প্রকাশ করে, ঋণ অনাদায়ী রহিয়া যাইবে। বকেয়া কৃষি ঋণের মস্ত তালিকা বাহির করেন কর্তারা। অনাদায়ী ঋণের সমস্যাটি তাৎপর্যপূর্ণ বটে, কিন্তু কৃষিঋণের ক্ষেত্রে সেই প্রসঙ্গ আসিলে তাহার বিচার করিতে হইবে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলি ২০১৭-১৮ সালে মোট ৭৭ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দিয়াছিল বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিকে। তাহার মধ্যে সামগ্রিক ভাবে কৃষি ক্ষেত্রের জুটিয়াছিল ১০ লক্ষ কোটি টাকা, যেখানে কেবল শীর্ষ দশটি কর্পোরেট সংস্থাই সাত লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়াছিল। মোট অনাদায়ী ঋণের সত্তর শতাংশের জন্যও দায়ী শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্র। কৃষিঋণ মোট অনাদায়ী ঋণের দশ শতাংশের অধিক নহে। অপর দিকে, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের মাত্র পনেরো শতাংশ ব্যাঙ্ক ঋণ পাইয়া থাকেন। বাকিরা আজও মহাজনি ঋণের উপর নির্ভর করিয়া চাষ করিতেছেন।

আরও একটি কথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন— প্রকৃত কৃষিজীবীদের একটি বড় অংশ অপরের জমি মৌখিক চুক্তিতে চাষ করেন। ঠিকাচাষ বৈধ নয় বলিয়া তাঁহারা চাষির প্রাপ্য সরকারি সহায়তা কিছুই পান না। ইহার ফলে চাষিদের মধ্যেও শ্রেণিবিভাগ দেখা দিয়াছে। জমিহীন চাষিদের নিকট সহজ শর্তে ঋণ, ভর্তুকি ও প্রশিক্ষণ পৌঁছাইবার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বস্তুত, কৃষিক্ষেত্রে যে সংস্কারের প্রস্তাবগুলি অধ্যাদেশের মাধ্যমে পাশ করাইল সরকার, এই ঠিকাচাষিদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ব্যবস্থা না করিতে পারিলে তাহা বহুলাংশে অর্থহীন হইয়া যাইবে। কৃষক হিসাবে তাঁহারা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের নাগাল না পাইলে বাজারে দাম বাড়িবার অপেক্ষায় ফসল ধরিয়া রাখা তাঁহাদের পক্ষে অসম্ভব। যত দিন না সেই ব্যবস্থা হয়, তত দিন কৃষকের অসহায়তাই ভারতের বাস্তব হইবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Agriculture Covid 19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE