Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বেহিসাবি নহে

একা যোগী আদিত্যনাথকে দোষ দিলে অবিচার হইবে, গত কয়েক বছরে ভারতীয় জনতা পার্টি তথা সঙ্ঘ পরিবারের নেতা-মন্ত্রীরা অনেকেই প্রবল উদ্যমে সেনাবাহিনীকে রাজনীতির হাটে নামাইতে তৎপর।

যোগী আদিত্যনাথ।

যোগী আদিত্যনাথ।

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

যোগী আদিত্যনাথকে নির্বাচন কমিশন কৈফিয়ত চাহিয়া নোটিস পাঠাইয়াছে। কৈফিয়ত শব্দটিতে যোগীবরের আপত্তি হইতে পারে, তিনি হয়তো বলিবেন— কৈফিয়ত নহে, উত্তর চাহিয়াছে কমিশন। শব্দে কী বা আসে যায়, যে উপলক্ষে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীকে নির্বাচন পরিচালকদের পত্রাঘাত, তাহা এক কথায় ভয়ঙ্কর। তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি গত ১ এপ্রিল গাজ়িয়াবাদের এক ভোটসভার মঞ্চে দাঁড়াইয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ‘মোদী কি সেনা’ নামে অভিহিত করিয়াছেন। নির্বাচন কমিশনের সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে যে, সেনাবাহিনীর নাম বা কাজকে কোনও ভাবেই নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করা চলিবে না। সেই সূত্রেই এই নোটিস। অনুমান করা যায়, মুখ্যমন্ত্রীর পারিষদরা আপাতত কৈফিয়ত তথা উত্তর খাড়া করিতে ব্যস্ত। সেই উত্তর লইয়া নির্বাচন কমিশন কী করিবে, তাহারাই জানে। তবে এমন মন্তব্যের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর শাস্তি হইবে— কোনও বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক সেই আশা করেন না, তিনি অনেক দেখিয়াছেন, কিসে কিসে কী কী হয় না, তাহা জানিতে তাঁহার কিছু বাকি নাই।

একা যোগী আদিত্যনাথকে দোষ দিলে অবিচার হইবে, গত কয়েক বছরে ভারতীয় জনতা পার্টি তথা সঙ্ঘ পরিবারের নেতা-মন্ত্রীরা অনেকেই প্রবল উদ্যমে সেনাবাহিনীকে রাজনীতির হাটে নামাইতে তৎপর। বস্তুত, রাজনীতিতে অনাচারের সীমারেখা কত দূর প্রসারিত করা যায়, নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে তাহার অনেক নজির তৈয়ারি হইয়াছে বটে, কিন্তু এই জমানার মাপকাঠিতেও সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক (অপ)ব্যবহারের উদ্যোগটি অবিশ্বাস্য। ভোটের রাজনীতি কালক্রমে ভারতীয় গণতন্ত্রের অবয়বে বহু কলঙ্ক দাগিয়া দিয়াছে, কিন্তু এই একটি বিষয়ে এত দিন অবধি সংযম ও সভ্যতা প্রায় অক্ষত ছিল। অতি বড় সুযোগ থাকিলেও রাজনীতিকরা সামরিক বাহিনীকে ভোটের ময়দানে টানিয়া আনেন নাই। তাহার গুরুত্ব অপরিসীম। রাজনীতি এবং ফৌজের মধ্যবর্তী প্রাচীর ভাঙিলে, এমনকি সামান্য দুর্বল হইলেও, পরিণাম কী হইতে পারে তাহা জানিবার জন্য দূরে যাইবার প্রয়োজন নাই, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী ইতিহাসই যথেষ্ট। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভারতীয় গণতন্ত্রের শত ত্রুটি সত্ত্বেও তাহার অন্তর্নিহিত শক্তি এবং সম্ভাবনা বিশ্ব জুড়িয়া স্বীকৃত। কিন্তু যে ভাবে সেই ব্যবধান ঘুচাইয়া দেওয়া হইতেছে, বালাকোট হইতে অভিনন্দন বর্তমান হইয়া মোদী কি সেনা— সামরিক বাহিনীর নাম ও অনুষঙ্গ যে ভাবে রাজনৈতিক প্রচারে উচ্চনাদে ব্যবহৃত হইতেছে, তাহা গণতান্ত্রিক ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই বড় রকমের প্রশ্ন তুলিয়া দেয়।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

একটি মূল সত্য স্পষ্ট করিয়া বুঝিয়া লওয়া প্রয়োজন। মোদী কি সেনার জয়ধ্বনি কোনও ‘ফ্রিঞ্জ গ্রুপ’-এর বেহিসাবি উদ্গার নহে। এমন কথা ভাবিবার কোনও কারণ নাই যে, যোগী আদিত্যনাথেরা অসতর্কতা বা অজ্ঞতার কারণে বারংবার সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে মিশাইয়া ফেলিতেছেন। ঘটনা ইহাই যে, সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে এই মিশ্রণের কিছুমাত্র বিরোধ নাই, বরং সেই দর্শনে রাজনীতির সহিত সামরিক বাহিনীর সংযোগকে স্বাভাবিক ও আবশ্যক বলিয়াই গণ্য করা হয়। গুরু গোলওয়ালকরের শিষ্যদের রাজনীতিতে অন্য রূপ হইবার কথা নহে, এবং সেই সংযোগের আদর্শগত অনুপ্রেরণা কোথায়, তাহাও দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী জার্মানি ও ইটালির ইতিহাসই নির্ভুল ভাবে জানাইয়া দেয়। এই চিন্তাধারা গণতন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে, বিশেষত নির্বাচনকে কী ভাবে আপন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে, তাহাও সেই ইতিহাসে লিখিত আছে। যথার্থ গণতন্ত্র বলিতে যাহা বুঝায়, তাহার সহিত এই চিন্তাধারার ব্যবধান অসেতুসম্ভব। নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নের উত্তরে যোগী আদিত্যনাথ যাহাই লিখুন না কেন, এই সত্যগুলি নিশ্চয়ই লিখিবেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE