Advertisement
E-Paper

রাজনীতি নীরব, বিদ্বজ্জনেরাও

মনে রাখতে হবে এ রাজ্যে শুধুমাত্র শব্দবাজির প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবন হারিয়েছেন দশের বেশি মানুষ, নিগৃহীত অসংখ্য; নিয়ম করে প্রায় প্রতি কালীপুজো ও দেওয়ালিতে।

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৫৭

শব্দদূষণের পক্ষে আইনভঙ্গকারীরা, পুলিশ প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা একযোগে কাজ করার অভিযোগ এই রাজ্যে সুপরিচিত। এ বিষয়ে আগের পর্বে (‘শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণে উলটপুরাণ’, ১৫-১১) লিখেছি। এই অভিযোগ কতটা প্রাসঙ্গিক, এ বছরের দক্ষিণ কলকাতার একটি ঘটনাই সেটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়। প্রায় মধ্যরাতে বাড়ির সামনে প্রচণ্ড শব্দে বাজি ফাটানো ও ডিজে বাজানোর প্রতিবাদ করেছিল এক মধ্যবিত্ত পরিবার, অনুরোধ করেছিল শুধুমাত্র একটু সরে বাজি ফাটানোর। এমন সাহসের জবাবে উচিত শিক্ষা দিতে বাড়িতে ঢুকে বেপরোয়া মারধর করল জনা পঞ্চাশের এক লুম্পেন বাহিনী, বাদ গেলেন না ক্যানসার আক্রান্ত এক মধ্যবয়সি, আশি-ঊর্ধ্ব তাঁর পিতা এবং বাড়ির মহিলা; এক প্রতিবেশী এসে না দাঁড়ালে সে দিন হয়তো খুনই হয়ে যেতেন পরিবারের কেউ। সারা রাজ্যের সব সংবাদমাধ্যমে সে খবর বেরোল, তাতে পুলিশ প্রশাসনের বিশেষ হেলদোল হল বলে মনে হল না। তারা আটচল্লিশ ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়ে অভিযোগে থাকা নামগুলির মধ্যে তিন জনকে গ্রেফতার করল, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই হাসতে হাসতে জামিন পেয়ে বেরিয়ে এল সবাই। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক বার অপরাধী বা তাদের দলবল শাসিয়ে গিয়েছে পরিবারটিকে, শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত পরিবারটিকে মাথা হেঁট করে অভিযোগ তুলে নিতে হল, যেমন ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার দিকে তাকিয়ে তুলে নিতে হয় আর কী। “কেন অভিযোগ তুললেন? জানেন না সুপ্রিম কোর্ট এমন অপরাধের জন্য শাস্তিবিধান করেছে?” প্রশ্নের উত্তরে পরিবারের এক জন চাপা স্বরে বললেন, “কী করব? দেখলাম পাড়ায় এই অপরাধীরাই সুপ্রিম কোর্ট... লড়ব কী ভাবে?”

এই ঘটনা কোনও ব্যতিক্রম নয়। মনে রাখতে হবে এ রাজ্যে শুধুমাত্র শব্দবাজির প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবন হারিয়েছেন দশের বেশি মানুষ, নিগৃহীত অসংখ্য; নিয়ম করে প্রায় প্রতি কালীপুজো ও দেওয়ালিতে। মনে রাখতে হবে জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায়ে অবৈধ বাজি কারখানা বন্ধের স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও আজ অবধি একটিও বন্ধ হয়নি। মনে রাখতে হবে, ইতিমধ্যেই অবৈধ বাজি কারখানায় কাজ করতে গিয়ে মারা গিয়েছেন একশোর ওপর মানুষ, যাদের অনেকেই শিশুশ্রমিক। প্রশাসন কী ভাবে শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণ (?) করতে চায়, তার একটা দিকনির্দেশ কি হচ্ছে না?

আসলে দক্ষিণ কলকাতার ঘটনাটিতে মাথা হেঁট ওই পরিবারের হল না, হল আমাদের সবার, গোটা সমাজের, প্রশাসনের, এবং প্রশাসনের মাথায় বসে থাকা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর যিনি তাঁর কবিতায় এই শব্দ-লুম্পেনদের ‘দানব’ আখ্যা দিয়েছিলেন এবং সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। মাথা হেঁট হল শাসক ও বিরোধী পক্ষে থাকা যাবতীয় রাজনৈতিক দলের, যারা কেউ আক্রান্ত পরিবারটির পাশে থাকা তো দূরস্থান, ঘটনার বিরোধিতা পর্যন্ত করল না, কেন না সময়বিশেষে এই আইনভঙ্গকারীদের হাতে তামাক খায় সব দলই। কখনও পকেট ভরে, কখনও ভোটবাক্স। এবং মাথা হেঁট হল সেই বিদ্বজ্জনদের যাঁরা রাজনৈতিক কোনও বিতর্ক উঠলেই মতামত বিলি করতে শুরু করেন (তা সে নেওয়ার লোক থাক বা না থাক), সাংবাদিক সম্মেলনে গলা ফাটান বা সময়বিশেষে মিছিলে লম্বা ফেস্টুন দু’দিক থেকে ধরে নেতৃত্ব দেন। অথচ বাজির দূষণে সমাজের প্রাণ ওষ্ঠাগত হলে বা শব্দ-লুম্পেনদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হলে তাঁদের বিশেষ হেলদোল দেখা যায় না। ঠিক যেমন দেখা যায় না স্কুলকলেজের বা হাসপাতালের দুরবস্থা নিয়ে তাঁদের সরব হতে। এটা সাম্প্রতিক প্রবণতা নয়। বামফ্রন্টের শেষ পর্বে যখন পরিবর্তন চেয়ে বিদ্বজ্জনদের আন্দোলন সত্যি সত্যি দানা বেঁধেছিল, তখনও কিন্তু তা আটকে গিয়েছিল রাজনৈতিক চোরাগলিতে; পরিবেশ বা শিক্ষার মতো বিষয় কোনও দিনই কল্কে পায়নি, যদিও এগুলি নিয়ে বলার বিরাট প্রয়োজন ছিল ও আছে।

আর তাই যেমন আগের জমানায়, তেমনই এখনও, এ রাজ্যে নাগরিক আন্দোলন দ্রুত গতি ও নিরপেক্ষতা হারিয়ে ‘আমরা, ওরা’র জাঁতাকলে আটকে পড়েছে। তাই দিল্লির মতো শহরে নাগরিক আন্দোলন বায়ুদূষণ নিয়ে অনেক এগিয়ে গেলেও এ রাজ্যে সে সব নিয়ে বিশেষ কথা হয় না, যদিও দূষণের মানচিত্রে কলকাতা দিল্লির চেয়ে বিশেষ পিছিয়ে নেই। এমন নয় যে পরিবেশের পক্ষে নাগরিক আন্দোলন একেবারেই নেই। আছে, বেশ কিছু পরিবেশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও ব্যক্তি প্রতিবাদ করেন, সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে আন্দোলনের পরিধি হয়তো কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু সংখ্যাকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক স্তরে চাপ সৃষ্টি করার পক্ষে তা কোনও মতেই যথেষ্ট নয়। তাই মনে হয়, যত ক্ষণ পরিবেশ আন্দোলন আরও বহু মানুষকে জড়াতে না পারবে, তা আরও প্রবল এবং তীব্র না হবে, আদালত প্রশাসনের ওপর আরও চাপ তৈরি করতে না পারবে, শব্দ-লুম্পেনদের তাণ্ডব চলছে, চলবে।

Festival DJ Sound Box Sound Pollution Sond Crackers
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy