গোটা দুনিয়ারই এখন গুলিয়ে যেতে চলেছে যে, সত্যিকারের আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কে— ডোনাল্ড ট্রাম্প, না কি বকলমে ইলন মাস্ক? দুনিয়াখ্যাত এক ম্যাগাজ়িনের ফেব্রুয়ারি সংখ্যার প্রচ্ছদে রয়েছে ধনকুবের ইলন মাস্কের ছবি— ওভাল অফিসে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের জন্য নির্দিষ্ট রেজ়োলিউট ডেস্কে বসে রয়েছেন দুনিয়ার ধনীতম মানুষটি। ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সিতে অমিত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছেন মাস্ক; নতুন গড়ে তোলা ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি’ বা ‘ডজ’-এর অধিকর্তা হয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন গোটা আমেরিকার উপরে।
এই বিপুল ক্ষমতা রীতিমতো চড়া দামে কিনেছেন মাস্ক। ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের প্রচারকালে প্রায় আড়াইশো মিলিয়ন ডলার জুগিয়েছিলেন তিনি— টাকার অঙ্কে প্রায় বাইশশো কোটি— যা হয়তো পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সুচতুর বিনিয়োগগুলির অন্যতম। এতটাই তার প্রভাব যে, গত ৬ নভেম্বরের বিজয়-ভাষণে ট্রাম্প বললেন, এক নতুন তারার জন্ম হয়েছে, যাঁর নাম ইলন। তারকাটির গুণকীর্তন করলেন চার মিনিট ধরে। সেই তারকাই কিন্তু ক্রমে রাহুগ্রাসে আচ্ছন্ন করে ফেলছেন ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিকে। এতটাই যে, স্বয়ং ট্রাম্পকেও বলতে হয়েছে, আমেরিকার আইন অনুসারে প্রথম প্রজন্মের নাগরিক মাস্কের পক্ষে প্রেসিডেন্ট হওয়া অসম্ভব।
ইতিহাসের অন্যান্য অতি-ধনীদের তুলনায় মাস্ক স্বতন্ত্র। আচরণে, জনসংযোগে, সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিতিতে। রাজনীতির অন্দরে সরাসরি উপস্থিতির নিরিখেও। প্রায় এক শতাব্দী আগে ফ্রাঙ্কলিন রুজ়ভেল্টের উত্থানের অনুঘটক, সংবাদপত্র প্রকাশক উইলিয়াম র্যান্ডলফ হার্স্ট-এর পর সংস্কৃতি, মিডিয়া, অর্থনীতি এবং রাজনীতি— আমেরিকান জীবনের এতগুলি দিকে একযোগে এমন সর্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি আর কোনও নাগরিক।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে জেতাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন মাস্ক। ঢুকে যান ওয়াশিংটনের ক্ষমতার অলিন্দে। আমেরিকান বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ কাটছাঁট করতে চান তিনি। ব্যবসায়ী জীবনের শুরুতে ‘পেপ্যাল’ থেকে বিপুল উপার্জন করেছেন। আজ তিনি মূল্যবান বৈদ্যুতিক গাড়ি কোম্পানির মালিক। কিনেছেন ‘টুইটার’-এর মতো প্রবল ক্ষমতাশালী সমাজমাধ্যম সংস্থা। টুইটার অধিগ্রহণের পর যে নির্মমতার সঙ্গে তিনি ছাঁটাই করেছেন তার প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মী, তা-ই যেন নবতর রূপ পরিগ্রহ করছে ডজ-এর অধিকর্তা হিসাবে আমেরিকান সরকারি কর্মী ছাঁটাইয়ের চেষ্টার মধ্য দিয়ে। ভেবে দেখলে বোঝা যাবে যে, তাঁর টুইটার দখল একটি পুনর্বার ব্র্যান্ডিং-এর প্রচেষ্টামাত্র ছিল না, বরং ছিল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধের নির্ঘোষ। এটাই বোধ হয় ইলন মাস্কের স্বাতন্ত্র্য।
মাস্ক ক্রিপ্টো-সম্পদের বাজারকেও নাচান হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো। এতটাই সেই প্রভাব যে, মানুষ বারংবার ভাবতে চায়, তিনিই বিটকয়েনের অজানা স্রষ্টা সাতোশি নাকামোতো কি না। আবার ‘নিউরালিঙ্ক’ নামক সংস্থার মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কে চিপ বসিয়ে তাদের কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান তিনি। ‘স্পেসএক্স’ নামের সংস্থার মাধ্যমে মহাকাশযান পাঠানোয় নাসা-র সঙ্গে টক্কর দেন তিনি। মঙ্গলগ্রহে কলোনি গড়ে তুলতেও উদ্গ্রীব মাস্ক। সব মিলিয়ে ইলন মাস্ক এক তুখোড় ব্যবসায়ী। কিন্তু এক আশ্চর্য চরিত্র। এক সঙ্গে তিনি যেন বহু গ্রহের অধিবাসী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হোক বা কোয়ান্টাম কম্পিউটার, সর্বত্রই তাঁর অবাধ পদচারণা। ২০১৫ সালে স্যাম অল্টম্যানের সঙ্গে একযোগে ‘ওপেনএআই’-এর যৌথ প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ২০১৮-তে ওপেনএআই ছেড়ে বেরিয়ে এলেও এখন সংস্থাটির রমরমার যুগে তাকে কিনে ফেলতে উদ্গ্রীব তিনি। আবার রবার্ট ডাউনি জুনিয়র যখন ‘আয়রনম্যান’-এর চরিত্রে অভিনয় করতে যান, চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি পরামর্শ নেন মাস্কেরই।
আমেরিকার গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে চলেছেন মাস্ক। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মারের সমালোচনা, নাইজেল ফ্যারাজের রিফর্ম ইউকে পার্টিকে সমর্থন, জার্মান নির্বাচনের প্রেক্ষিতে অতি-দক্ষিণপন্থী এএফডি পার্টিই ‘আশার শেষ স্ফুলিঙ্গ’ বলে ঘোষণা, তাদের নেত্রীর সঙ্গে মিটিং, কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জাস্টিন ট্রুডো বেশি দিন ক্ষমতাসীন থাকবেন না বলে ঘোষণা— আন্তর্জাতিক রাজনীতির বেণুবনে তাঁর পদচারণার চেষ্টার কয়েকটি উদাহরণমাত্র। চিন বা রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে আলোচনা করেন মাস্ক, মিটিং করেন রাষ্ট্রপুঞ্জে ইরানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, এমনকি নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক আমেরিকা সফরে তাঁর সঙ্গেও। ইউরোপ তাঁকে নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগে। তবু নোতরদাম ব্যাসিলিকার পুনঃ উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে মাস্ককে নিমন্ত্রণ করতে ভোলেন না ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ। স্পষ্টতই আমেরিকার শক্তির ভরকেন্দ্র শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্পেই আটকে থাকে না। তা চেহারা নেয় উপবৃত্তের। ক্ষমতার সেই উপবৃত্তের দুটো নাভি— ট্রাম্প আর মাস্ক।
এ বারে ট্রাম্পের অভিষেকের দিন নাৎসি স্যালুট দিয়ে দুনিয়াময় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন মাস্ক। আপাতদৃষ্টিতে যেন আমেরিকায় এবং অন্যত্র অতি-দক্ষিণপন্থার প্রচারে নেমেছেন মাস্ক। তবে মাস্কের রাজনৈতিক বিশ্বাসের রূপরেখাও তো বেশ খানিকটা অধরা। এবং পরিবর্তনশীল। ২০০৮-এর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বারাক ওবামার প্রচারকালে তাঁর সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য ছ’ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলেন মাস্ক। ২০১৪ নাগাদই কিন্তু মাস্ক নিজেকে বর্ণনা করলেন ‘মধ্যপন্থী’ হিসাবে— যিনি সামাজিক ভাবে উদার এবং অর্থনৈতিক ভাবে রক্ষণশীল। ২০২২ নাগাদ তিনি ঝুঁকে পড়েন রিপাবলিকানদের দিকে।
জন রকফেলার থেকে হেনরি ফোর্ড বা বিল গেটস, সম্ভবত ইতিহাসের কোনও অতি-ধনীই সব মিলিয়ে ইলন মাস্কের মতো সরাসরি প্রভাব ফেলেননি আমেরিকান বা বৈশ্বিক রাজনীতিতে। এর রহস্যও বোধ হয় জড়িয়ে রয়েছে মাস্কের অসাধারণ জীবনের গল্পে। দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর জন্ম, স্কুলজীবন। পড়েছেন কানাডার কলেজে। আমেরিকায় তাঁর আগমন এইচ১বি ভিসায়। ওয়াল্টার আইজ়্যাকসনের ২০২৩ সালের জীবনী অনুসারে, মাস্কের উপর গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়েছিল তাঁর বাবার, যিনি এক জন প্রকৌশলী এবং ‘ক্যারিশম্যাটিক ফ্যান্টাসিস্ট’। শৈশবের নানা টানাপড়েনই হয়তো মাস্ককে পরিণত করে এক কঠিন কিন্তু ভঙ্গুর মানুষে— যাঁর মানসিকতার আকাশে ঘটে চলে ‘জেকিল অ্যান্ড হাইড’সুলভ রোদবৃষ্টির খেলা। তিনি যেন প্রস্তুত নাটকীয়তার জন্য, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁর রয়েছে উচ্চ আকাঙ্ক্ষার প্রবণতা, আর এক তীব্র বাতিকগ্রস্ততা, যা মাঝে মাঝে হয়ে ওঠে শীতল এবং ধ্বংসাত্মক।
অতি-ধনীরা চিরকালই রাজনৈতিক ক্ষমতার গা ঘেঁষে থাকেন। কিন্তু মাস্ক কেন ঢুকে পড়লেন সেই বৃত্তে? কেন ডুব দিলেন প্রত্যক্ষ রাজনীতির মহাকুম্ভে? ট্রাম্পের সঙ্গে জুটি বাঁধা তাঁর নিজস্ব ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করছে নিশ্চয়ই। তাঁর পক্ষে পৃথিবীর প্রথম ডলার ট্রিলিয়নেয়ার হওয়াটাও হয়তো ত্বরান্বিত হবে এর ফলে। অনেকেই মনে করেন, মাস্কের রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলি আমেরিকায় এবং তার বাইরেও তাঁর ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। কিন্তু মাস্কের এই রাজনৈতিক ক্ষমতার অনেকটাই তো আরোপিত। কত দিন অক্ষুণ্ণ থাকবে ট্রাম্প-মাস্কের সঘন রসায়ন? ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো কর্তৃত্ববাদী মানুষ কত দিন সহ্য করবেন তাঁর মহিমায় ইলন মাস্কের ভাগ বসানো? একটা সময়ের পরে কি মাস্ককে নিয়ে ক্লান্ত হবেন না ট্রাম্প? সে ক্ষেত্রেও অবশ্য মাস্কের থেকে যাবে কুবেরের ভান্ডার, অটুট। থাকবে তাঁর অমিত শক্তিশালী সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এবং অন্যান্য অতি-লাভজনক ব্যবসার মালিকানা।
মাস্ক কি নেহাতই এক ব্যতিক্রমী অতি-ধনী হয়েই থাকবেন? না কি প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে অতি-ধনীদের রূপরেখার এক আশ্চর্য নবনির্মাণ ঘটল প্রথম প্রজন্মের আমেরিকান ‘সিটিজ়েন মাস্ক’-এর মধ্য দিয়ে?
রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)