E-Paper

অসাম্য নিখোঁজ রহস্য

বছরে দু’বার বিশ্ব ব্যাঙ্ক রুটিনমাফিক প্রকাশ করে ‘পভার্টি অ্যান্ড একুইটি ব্রিফস’। প্রতিটি দেশে দারিদ্র এবং অসাম্যের চিত্র বর্ণনা করা হয় দু’পাতার একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্টে।

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২৫ ০৫:২২

কয়েক দিন আগে কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ ঘোষণা করল, বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে মোটে তিনটে দেশে ভারতের চেয়ে অসাম্য কম— স্লোভাক রিপাবলিক, স্লোভেনিয়া আর বেলারুস। সংবাদমাধ্যমও অমনি সে খবর লুফে নিয়ে জিনি ইন্ডেক্স-টিন্ডেক্স লিখে শিরোনাম করে ফেলল। ‘গ্লোবাল র‌্যাঙ্কিং’ নিয়ে এই সরকারের কাঙালপনা সুবিদিত। আজকাল প্রায়ই অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন দেশকে নানা সূচকের নিরিখে লিগ সারণিতে সাজিয়ে রিপোর্ট বার করে। সেই টেবিলে এক ধাপ এগোলে এ দেশের সরকারকে পায় কে! ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে খবর করিয়ে তবে শান্তি। আর পিছোলে অমনি গোসা— সব ষড়যন্ত্র।

হালের এই সাম্যের বাড়বাড়ন্তের খবরে দেশের অর্থনীতিবিদদের চোখ কপালে উঠল। এ যে রীতিমতো গোয়েন্দা কাহিনি— অসাম্য নিখোঁজ রহস্য। বছরে দু’বার বিশ্ব ব্যাঙ্ক রুটিনমাফিক প্রকাশ করে ‘পভার্টি অ্যান্ড একুইটি ব্রিফস’। প্রতিটি দেশে দারিদ্র এবং অসাম্যের চিত্র বর্ণনা করা হয় দু’পাতার একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্টে। এ বছর এপ্রিল মাসে প্রকাশিত অণু-রিপোর্টটিতে বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানায় ভারতে দারিদ্র, বিশেষত চরম দারিদ্র শেষ দশ বছরে অনেকটাই কমেছে, এবং ১৭ কোটি ভারতবাসী দারিদ্রসীমার ঊর্ধ্বে উত্তীর্ণ হয়েছেন। কর্মসংস্থান, বিশেষ করে মেয়েদের কর্মসংস্থান ইদানীং কালে বেড়েছে। এ সবই মোটামুটি ‘ওয়াকিবহাল মহল’-এর জানা কথা। দারিদ্র সত্যিই কতখানি কমেছে, মেয়েদের কর্মসংস্থান শুধু অসংগঠিত ক্ষেত্রে বেতনহীন কাজে বেড়েছে কি না, সে সব নিয়ে বিতর্কে অর্থনীতিবিদেরা মসিক্ষয়ও কম করেননি। বস্তুত, বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টটিতেই আছে, ভারতে অ-কৃষিক্ষেত্রে শুধুমাত্র ২৩ শতাংশ কাজ সংগঠিত ক্ষেত্রের আওতায় আসে। শিক্ষিত যুবকদের বেকারত্ব আর কাজের বাজারে এখনও মেয়েদের শোচনীয় উপস্থিতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

দেশের অসাম্যের চিত্র নিয়ে বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টটির বক্তব্য হুবহু তুলে দেওয়া যাক: “ভারতের ভোগভিত্তিক জিনি সূচক ২০১১-১২ সালে ছিল ২৮.৮। সূচকটির উন্নতি হয়েছে এবং ২০২২-২৩’এ তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫.৫-এ। তবে মাথায় রাখতে হবে, যথাযথ তথ্যের অভাবের কারণে এখানে অসাম্য বাস্তবের তুলনায় কম দেখাতে পারে। ওয়ার্ল্ড ইনকাম ইনইকোয়ালিটি ডেটাবেস যেমন দেখাচ্ছে, ভারতে জিনি সূচক ২০০৪-এ ছিল ৫২। ২০২৩-এ তা বেড়ে হয়েছে ৬২। এ দেশে মজুরির অসাম্য এখনও লক্ষণীয়; ধনীতম ১০ শতাংশের গড় আয় দরিদ্রতম ১০ শতাংশের তুলনায় ১৩ গুণ বেশি।”

জিনি সূচক হল অসাম্যের মাপক, শূন্য থেকে ১০০-র মধ্যে থাকে এর মান। জিনি সূচকের মান যত বেশি, অসাম্যও তত বেশি। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট দেখাচ্ছে, কিসের অসাম্য মাপা হচ্ছে, ভোগব্যয়ের না আয়ের— তার উপরে নির্ভর করে বলা যাবে যে, জিনি সূচকের মান বেড়েছে না কমেছে। অতএব দেখাই যাচ্ছে, অসাম্য বিষয়ে বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টের একটি লাইন তুলে নিয়ে ঢক্কানিনাদ শুরু হয়ে গিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের একাংশ দীর্ঘসূত্রতার কারণে এই সব হিসাবনিকাশের জটিলতায় তো ঢোকেইনি, এক বার বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টটি খুলে দেখার প্রয়োজনও বোধ করেনি।

যে সব দেশে বেশির ভাগ মানুষ সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, সেখানে আয়-সমীক্ষা মোটামুটি ভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়। উন্নত দেশগুলির পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতেও নিয়মিত আয়-সমীক্ষা হয়। কিন্তু বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশে সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন অপেক্ষাকৃত ছোট একটা অংশ। আয়-সমীক্ষা এখানে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয় না। আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া বা পশ্চিম এশিয়ার কয়েকটি দেশে তাই আয়-সমীক্ষার চেয়ে ভোগ-সমীক্ষায় বেশি জোর দেওয়া হয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমীক্ষকেরা জেনে আসেন, খাবার, বাড়ি ভাড়া, এবং অন্যান্য দৈনন্দিন প্রয়োজনের খাতে কত খরচ হয়, নিজস্ব উৎপাদন থাকলে তার কতখানি পরিবার ভোগ করে। তাই এই সব দেশে সাধারণত অসাম্য মাপা হয় ভোগব্যয়ের উপরে জিনি সূচক হিসাব করে।

মনে রাখতে হবে, ধনীরা সঞ্চয় করেন বেশি, তাই ভোগব্যয়ের ফারাক কখনওই আয়ের ফারাকের মতো আকাশ ছুঁতে পারে না। বলা বাহুল্য, একটি দেশে যদি মাপা হয় আয়ের অসাম্য, এবং অন্য দেশে ভোগের অসাম্য, তা হলে দু’টি দেশের অসাম্য তুলনীয় হয় না। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টে কোনও কোনও দেশে অসাম্য মাপা হয়েছে আয়ের উপরে, আবার কোথাও ভোগের উপরে। তাই কোনও ভাবেই বলা চলে না যে, পৃথিবীতে স্লোভাক রিপাবলিক, স্লোভেনিয়া আর বেলারুস ছাড়া সমস্ত দেশেই ভারতের তুলনায় অসাম্য বেশি। সংবাদ সংস্থার খবর, চিনের জিনি সূচকের মান ৪৬.৭, ভারতের সেখানে ২৫.৫। বিশ্ব ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটটি খুললেই দেখা যাবে যে, চিনের সূচকটি আয়ের উপরে হিসাব করা হয়েছে, ভারতেরটি ভোগব্যয়ের উপরে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন, ভারতে ভোগব্যয়ের উপরে জিনি সূচকের মান বরাবরই অত্যন্ত কম। শেষ কয়েক বছরে এই সূচক সামান্য কমেছে, তার কারণ হতে পারে গরিব মানুষের হাতে টাকা বা সস্তায় চাল তুলে দেওয়ার মতো প্রকল্পগুলি।

বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টে দেশের অসাম্য সংক্রান্ত যে আলোচনা হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। জোর দেওয়া হয়নি সম্পদ বা আয়ের অসাম্যের উপরে। আয়করের তথ্য-সহ বিভিন্ন সূত্রের তথ্য ব্যবহার করে ভারতে আয় ও সম্পদের বণ্টনের অসাম্য নিয়ে সাড়া-জাগানো কাজ করেছেন টমাস পিকেটি ও তাঁর সহকর্মীরা। তাঁরা দেখিয়েছেন, স্বাধীনতার পরের তিনটি দশকে অসাম্য কমলেও, ২০০০ সালের পর থেকে তা মারাত্মক ভাবে বাড়তে শুরু করে। ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে বর্তমান ‘বিলিয়নেয়ার রাজ’-এর। সম্পদ ও আয়ের অসাম্যের নিরিখে ভারত পিছনে ফেলে দিয়েছে ব্রাজ়িল ও আমেরিকাকেও। পিকেটিদের মতে, দেশের অতি-ধনী (বা টপ বিলিয়নেয়ার)-দের উপরে ২% কর চাপালেই উঠে আসবে দেশের সামাজিক প্রকল্পের ব্যয় বহনের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা।

এত বছরের গবেষণালব্ধ জ্ঞান ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে এক নিমেষে ভুল শিরোনামে সেজে ওঠে দেশের নামকরা সব সংবাদপত্র; টেলিভিশনের সান্ধ্য বৈঠকে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি ওঠে। সে খবরের ভিত্তি কেবল অনৃতভাষণপটু সরকারের একটি বিবৃতি। লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুরভি কেশর হিসাব কষে দেখিয়েছেন, ২০১৯ সালে আয়ের অসাম্যের নিরিখে ২১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান (র‌্যাঙ্ক) ছিল ১৭৬তম; ২০০৯ সালে যা ছিল ১১৫তম। দেশে অসাম্যের চিত্রটি দিন দিন আরও ভয়ানক হয়ে উঠছে।

সরকারি বিবৃতি বলছে ভারত শুধু বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি নয়, সাম্যময়তার নিরিখেও চার নম্বরে তার স্থান। এই ‘সাফল্য’-এর পিছনে নাকি রয়েছে দারিদ্র কমানো, আর্থিক সুযোগ বাড়ানো এবং অনুদান দিয়ে অসাম্য কমানোর লক্ষ্যে সরকারের ধারাবাহিক চেষ্টা। আমরা জানি, কোনও দেশের অসাম্য কমানো আসলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন। রাজ্যে রাজ্যে, গ্রাম-শহরে, বিভিন্ন জাতি, শ্রেণি এবং লিঙ্গের মধ্যে বৈষম্য এ দেশে সুপ্রোথিত। শুধুমাত্র আয় বা সম্পদের নিরিখে নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অপুষ্টি— মানবোন্নয়নের সমস্ত সূচকের নিরিখে। এর উপরেও আছে প্রতিচ্ছেদগত অসাম্য বা ইন্টারসেকশনাল ইনইকোয়ালিটি। বঞ্চনার বিভিন্ন অক্ষের প্রতিচ্ছেদে অসাম্য কেমন তা বোঝা দরকার। গ্রামের এক জন দরিদ্র, নিম্নবর্ণ মহিলার প্রতি সমাজের যে বৈষম্য, তা শ্রেণিগত বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য আর লিঙ্গ বৈষম্যের যোগফল নয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন বঞ্চনা একে অপরের প্রতিচ্ছেদে অনেক গুণ বেড়ে যায়। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টে এ সমস্ত বিষয়ের কোনও উল্লেখ নেই। সরকারি বিবৃতিতে আছে কেবল আত্মপ্রবঞ্চনা। আন্তর্জাতিক রিপোর্টে যখন দেখা যায় দেশ একেবারে পিছনের সারিতে, যার কারণ হয়তো বিপুল শিশু-অপুষ্টি, তখন সেই রিপোর্টের গন্ডগোল আর ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব নিয়ে সরব হয় সরকার। অসাম্য কমানোয় নয়, কম দেখানোতেই সরকারের যাবতীয় প্রয়াস আর সদিচ্ছা।

অর্থনীতি বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

world bank Economy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy