ইন্দিরা গান্ধী যে আপৎকালীন অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন, তা যে প্রকৃতপক্ষে ইলাহাবাদ হাই কোর্টের রায়কে বুড়ো আঙুল দেখানোর জন্যক্ষমতাগর্বী স্বৈরতন্ত্রপন্থী এক শাসকের পদক্ষেপ এ-কথা তাত্ত্বিকদের আর বলার অপেক্ষা রাখে না, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানওয়ালা মানুষমাত্রেই বোঝেন। জরুরি অবস্থাকে ন্যায়সঙ্গত হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য ইন্দিরা দেশের ভিতরে ক্রিয়াশীল চরম দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তি-গোষ্ঠী-দলের দোহাই দিয়েছিলেন। বামমনস্কদের একাংশ তাঁকে সমর্থনও করেছিলেন। এই জরুরি অবস্থায় এক দিক থেকে শেষ অবধি সেই সাম্প্রদায়িক-দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক জোটেরই আদতে লাভ হয়েছিল কি না, সে কথাটাই আবার নতুন করে উঠছে। মহাত্মা গান্ধীর মুখকে মুখোশ হিসাবে ব্যবহার করে, দুর্নীতি ও সামাজিক সংস্কারের নাম করে, ভোটের রাজনীতির বাইরে থেকে নানা শক্তি কী ভাবে অতি-দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক জোটকে মদত দিয়েছিল, তা-ও এখন অনেকের আলোচনার বিষয়।
এরই মাঝে একটি স্থানীয় দল, যার জন্ম হয়েছিল বিহারে এবং বিস্তার লাভ ঘটেছিল পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায়, সেই গান্ধীবাদী লোক সেবক সঙ্ঘের কার্যাবলিকে ‘ব্যতিক্রম’ হিসাবে পুনরায় বিবেচনা করতে ইচ্ছে করে। মহাত্মা গান্ধী ভাঙা দেশে স্বাধীনতা লাভের পর জাতীয় কংগ্রেসকে ভেঙে দিতে বলেছিলেন, তা কেবল নৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না— তার পিছনে বাস্তব কাণ্ডজ্ঞানও প্রখর ভাবে কাজ করেছিল। কায়েমি স্বার্থ ও ক্ষমতা কী ভাবে কংগ্রেসকে ঘিরে স্বাধীন ভারতে ক্রিয়াশীল হয়েছিল, তাঁর বাস্তব-বিশ্লেষণ নির্মলকুমার বসুর গণতন্ত্রের সঙ্কট বইতে গত শতকের পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় চমৎকার ধরা পড়েছিল।
সে বই প্রকাশের একটু আগের কথা। ১৯৪৮। দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক জেলা এখনকার পুরুলিয়া তখন পশ্চিমবঙ্গের অধীন নয়, বিহারের অন্তর্গত। পুরুলিয়াকে ঘিরে আত্মপ্রকাশ করল একটি রাজনৈতিক দল— মানভূম লোক সেবক সঙ্ঘ। স্থানীয় এই দলটি সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এক সময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। দলটি মানভূমের গান্ধী নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্তের শিষ্য-সহচরদের দ্বারা পরিচালিত। নিবারণচন্দ্র মানভূম বলতে ‘মানবভূম’কে বুঝতেন, এই অঞ্চলের বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল সহযোগের। এই মানুষগুলিকে কারা নিজের দিকে টানবেন, হিন্দিভাষীরা না বাংলাভাষীরা— এই লড়াই প্রবল হয়ে উঠেছিল। শুধু তা-ই নয়, ভাষার ক্ষেত্রে স্বাধীন ভারতে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শ বজায় রাখার কথা বলা হয়েছিল, বিহার কংগ্রেসের নেতারা তা মানছিলেন না। খনিজ সম্পদপ্রধান মানভূমকে বিহারের আওতায় রাখতে সেখানকার বৃহৎ সংখ্যক বঙ্গভাষীদের উপর এক রকম করে হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দিতে চাইছিলেন।
এ ছাড়া ছিল দুর্নীতি। এই দুই সমস্যাকে কেন্দ্র করেই কংগ্রেস থেকে নিবারণচন্দ্রের অনুগামীরা বেরিয়ে আসেন, প্রতিষ্ঠা করেন মানভূম লোক সেবক সঙ্ঘ। স্বাধীন ভারতে প্রথম নির্বাচনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি আসনে জয়লাভ করেছিলেন তাঁদের প্রতিনিধিরা। ভারতীয় রাজনীতি মানেই কংগ্রেস, এই আবহে তাঁদের এই জয়লাভ ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সে কালে কংগ্রেসি পন্থা কী ভাবে মানভূমে হিন্দি আধিপত্য বিস্তার করত, তার পদ্ধতি এ কালেও বেশ চেনা লাগতে পারে। মুক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, “ঝরিয়ায় ‘দেশবন্ধু সিনেমা’ গৃহে আরম্ভ ও মধ্যবর্তী বিশ্রামের সময় হিন্দী প্রচারিণী সমিতি কর্তৃক ইংরাজী ও হিন্দী ভাষায় নিম্নলিখিত বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেওয়া হয়— ‘Hindi is the mother tongue of Manbhum.’”(১৩৫৫, ২২ অগ্রহায়ণ) একই আধিপত্যবাদী পদ্ধতি কখন যে কোন দল গ্রহণ করে! মানভূমের বাংলা ভাষাপ্রধান অঞ্চলকে ছিন্ন করে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে আসার কাজে এই দল শেষ অবধি সাফল্য পেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ভাষিক আত্মতা বজায় রাখার আন্দোলন সাফল্য লাভ করল, পূর্ব পাকিস্তান ও শিলচরের আগে প্রথম বাংলা ভাষা আন্দোলনের সফল কর্মসূচি গ্রহণকারী এই ‘অসাম্প্রদায়িক’ ‘অহিন্দুত্ববাদী’ দলটি এর পর পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক জেলাটিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে, সমাজের নিম্নস্তরের মানুষদের জন্য সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলি প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হয়।
পরে গান্ধীবাদী এই দলটির অস্তিত্ব ভোটের রাজনীতিতে আর রইল না। কারণ ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই দলীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, ভোটের রাজনীতি থেকে তাঁরা সরে যাবেন। তাঁদের মুখপত্র মুক্তি-তে প্রকাশিত হল দীর্ঘ আলোচনা-নিবন্ধ ‘নির্ব্বাচনে না দাঁড়ালে কি দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়?’ (৩০ মে ১৯৭৭) এক দিক থেকে দেখলে ভোটনির্ভর প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে দলটির রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা খুব দীর্ঘ দিনের নয়, কিছু কম ত্রিশ বছর। তবে ভারতীয় রাজনীতিতে এই সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেসি ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্যের কাঠামোটিকে আঘাত করে গণতন্ত্রের পরীক্ষায় কী ভাবে উত্তীর্ণ হওয়া যায়, নানা দল নানা ভাবে তার চেষ্টা করছিল। সে চেষ্টা অতি-দক্ষিণপন্থী দলগুলির ক্ষেত্রে নিজেদের হাতে ক্ষমতা নেওয়া; অপর দিকে ভোটের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে লোক সেবক সঙ্ঘ রাজনৈতিক ভাবেই চেষ্টা করছিল যথার্থ অর্থে এককেন্দ্রিক ক্ষমতার বিরোধিতা করতে।
ইন্দিরার আপৎকালীন জরুরি অবস্থার অবসান ও নির্বাচনে পরাজয়ের পর কংগ্রেস-বিরোধীরা তখন ক্ষমতায়, সে সময় জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনের পাটিগণিতে জনতা ও সিপিএম কাছাকাছি। লোক সেবক সঙ্ঘ ক্ষেত্রবিশেষে দু’পক্ষেরই গুণগ্রাহী ও সমালোচক। তাঁদের প্রধান সমালোচনা, “কিন্তু জনতা পার্টি বা বাম সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে বোঝাবার কোনো চেষ্টা নেই।” (২০ চৈত্র ১৩৮৪) বোঝানোর সঙ্গে বোঝার সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। ১৯৭৮-এ চৌকিদার-দফাদারদের মতো নিম্নবর্তী সরকারি চাকুরে, বিড়ি শ্রমিক-রিকশাওয়ালা, কৃষিমজুরদের মতো অসংগঠিত শ্রমিকদের পক্ষ নিচ্ছেন তাঁরা।
বামেদের থেকে এঁদের পক্ষ-নেওয়া ও পক্ষ নিয়েও পর্যালোচনা করার পদ্ধতি অন্য রকম। বামেরা সংগঠিত জন-আন্দোলনের ক্ষেত্রে যেখানে-যেখানে ‘দায়িত্ব জ্ঞানহীনতা’র পরিচয় দিচ্ছেন, সেখানে তাঁরা সরব। যেমন রিকশাচালকদের ধর্মঘট পর্যবেক্ষণ করে তাঁদের বক্তব্য, ধর্মঘটের ফলে জনসাধারণ যে দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়েছেন সে দিকে নজর দেওয়া উচিত ছিল। “জরুরী প্রয়োজনে কিভাবে রিক্সা পাওয়া যাবে তা জনসাধারণকে অবহিত করার নৈতিক দায়িত্ব ছিল ধর্ম্মঘটী য়ুনিয়নের।” যেগুলি মালিকদের রিকশা নয়, চালকদের রিকশা, সেগুলিই বা তুলে নেওয়া হল কেন? আর “রোগীর আত্মীয় ও ডাক্তারকে দুনিয়া ঘুরে... বের করতে হবে য়ুনিয়ন নেতাকে এবং তিনি লিখে দিলে এক রিক্সা দেয়া হবে— এটা কোনো ব্যবস্থা নয়, জনসাধারণকে ক্রীতদাস বানাবার ইন্দিরা পরিকল্পনারই এটা একটা সুলভ সংস্করণ মাত্র।”
ইমার্জেন্সির ভূত যে ফিরে ফিরে আসে পার্টিতন্ত্রে, এটা মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছিল সে দিনের ইমার্জেন্সি-উত্তর টাটকা-অতীতে। জনতা পার্টি ও বামফ্রন্টের মধ্যে ও দুই পার্টির নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু হতেই তাঁদের মন্তব্য “এই আত্মকলহের কারণ কি? সেই পুরনো রোগ। যে ক্ষমতা হাতে এসেছে— দলের হাতে এবং ব্যক্তির হাতে— তাকে কীভাবে... কায়েম করা যায়।” ক্ষমতা শুধু আত্মকলহ তৈরি করে না, যাদের জন্য কাজ করছি বলে বলছি, তাদের লাঠি পিটিয়ে কথা শোনাতেও প্রস্তুতি নেয়। “সি পি এম কর্ম্মীরা... মজুরদের মারপিঠ করে জমি থেকে উঠিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য এই যে, ঐ সব মজুরেরা কেন আটটাকা চার আনার ধর্ম্মঘটে সামিল হচ্ছেন না।... যে সব মজুরদের ঐ ভাবে কাজ থেকে বিরত করা হয়েছে— তাঁদের জন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়নি।”
জরুরি অবস্থা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৮-এ মুক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত এই সমস্ত পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, জরুরি অবস্থা বলতে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার অস্বীকার করা যে এককেন্দ্রিক ক্ষমতাতান্ত্রিকতাকে বোঝানো হয়, তার উপসর্গগুলি ইন্দিরার একুশ মাসের শাসনের অবসানে হারিয়ে যায়নি, রূপে রূপান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেগুলিকে সাংগঠনিক ভাবে দেশের মজ্জায় মজ্জায় মিশিয়ে দেওয়ার উৎকট দক্ষিণপন্থার আমরা যেমন মুখোমুখি হয়েছি ও হচ্ছি, তেমনই এই রোগ বাম দলগুলিকেও গ্রাস করেছিল আর এক ভাবে। মুক্তির উপায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে, নির্বাচনী পাটিগণিতের বাইরে দাঁড়িয়ে জনসাধারণকে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করার মধ্যে পাওয়া যেতেও পারে। উপর থেকে পার্টির কাঠামো সব ঠিক করে দেবে এটা কিন্তু জনসাধারণকে সচেতন করার মডেল নয়, ছোট ছোট ভাবে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দাবির উত্থাপনে সংগঠিত জনগোষ্ঠীর কাজে কথায় কান রেখেই দল তার কার্যক্রম তৈরি করবে।
ক্রমশ বিস্মৃতির দিকে এগিয়ে যাওয়া লোক সেবক সঙ্ঘ দলটি নয়, তাঁদের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ আজকের প্রেক্ষিতে এই সূত্রেই বিশেষ ‘কেস-স্টাডি’র বিষয় হতে পারে।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)