মুর্শিদাবাদের নবগ্রামের ব্যস্ত বাজারের কাছেই বাড়ি নজরুলের। যে মূল সড়কটা গ্রামের মধ্যে চলে গিয়েছে, তার ধারেই তাঁর প্রাসাদোপম বাড়ি। প্রায় এক দশক কাজ করেছেন উপসাগরীয় এক দেশে, তার পর বাড়ি ফিরে জীবনের সব সঞ্চয় ও স্বপ্ন ঢেলে তৈরি করেছেন এই বাড়ি।
নজরুলের গল্প শুধু নবগ্রামেরই নয়, যেখানে যে পরিবারেই পরিযায়ী শ্রমজীবী সদস্য আছেন, সেখানেই দেখা যাবে পাকা বাড়ি, এমনকি আধুনিক সুযোগসুবিধা-সহ। অন্য দিকে, পরিযায়ী শ্রমিক সদস্যহীন পরিবারগুলোয় নিয়ম করে দেখা যায় সাদামাঠা ঘর— টিনের চাল দেওয়া বা ইটের তৈরি ছোট বাড়ি, সরকারি সাহায্যে গড়া। এ এমনই নিয়মের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, নবগ্রাম-সহ সাগরদিঘির অন্য গ্রামগুলোয় পরিদর্শনে গিয়ে আমরা প্রায় নির্ভুল ভাবে শনাক্ত করতে পেরেছিলাম, কোন পরিবার বা বাড়িগুলো থেকে অন্তত এক জন সদস্য পরিযায়ী রূপে দীর্ঘকাল প্রবাসী। আন্তর্জাতিক স্তরে পরিযাণ যে জীবনকে আমূল পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তা স্বীকার করে আইআইটি খড়্গপুরের মতো প্রতিষ্ঠানে একটি নিরীক্ষামূলক প্রকল্পও চলছে, যাতে নজরুলদের আন্তর্জাতিক পরিযাণ সহজ ও স্বচ্ছ করে তোলা যায়। এই প্রকল্পের আওতায় তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৈশিষ্ট্যযুক্ত এমন এক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেখানে ভবিষ্যতের পরিযায়ীরা নিজেদের মোবাইলেই সারা বিশ্বের কাজের সঠিক খবর সহজেই পাবেন। চাকরির আবেদন থেকে চূড়ান্ত নিয়োগ পর্যন্ত সমস্ত ধাপ স্বচ্ছ ভাবে পার করতে সাহায্য করায় এই অ্যাপটি বহুলপ্রচলিত হয়ে উঠছে। নবগ্রাম হাসপাতালের ল্যাব টেকনিশিয়ান হুমায়ুন কবীরের মতো কিছু মানুষের চেষ্টায় আইআইটি খড়্গপুরের ওই প্রকল্প ক্রমশ গতি পাচ্ছে। নবগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষও বিনা খরচে সফল ভাবে পরিযাণে সক্ষম হচ্ছেন।
করিম, প্রসেনজিৎ, রাহুল, রহিমের মতো তরুণদের মধ্যে একটা মিল হল উপসাগরীয় কোনও দেশে কাজ করতে যেতে পারা, যাতে জীবন বদলানো যায়। ওঁরা প্রতীক্ষা করেন একটা ‘ভাল’ সুযোগের, যেখানে পরিযাণ প্রক্রিয়াটা দ্রুত ও ন্যূনতম ঝামেলার, সার্ভিস চার্জ কম, প্রতিশ্রুত কাজ পাওয়া নিশ্চিত, ‘ওভারটাইম’-এর সুযোগের পাশাপাশি অনুমতিসাপেক্ষে পার্ট-টাইম কাজের সুবিধা আছে, কাজও এমন যেখানে বকশিশ মেলে ভাল। তাঁদের মতে, একটা বিশ্বস্ত পরিযাণের সুযোগই জীবনে দিতে পারে স্থিতি, উন্নতি। কাছেই খড়গ্রাম বা সুতি ব্লকেও একই ছবি। উপসাগরীয় দেশগুলিতে শ্রম-পরিযাণের সুবাদে বহু পরিবারের আর্থিক উত্তরণ: শুধু ব্যক্তি স্তরে নয়, সমগ্র গোষ্ঠীর স্তরেও।
তবে ‘ভাল’ সুযোগ পাওয়া কঠিন। সচরাচর কাজের যে বিজ্ঞাপন ভাবী পরিযায়ীদের কাছে আসে তাতে সব তথ্য মেলে না, সংশয় থাকে অনেক কিছু ঘিরে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই চোখে পড়ে তথ্যের অভাব: কর্মদাতার নাম, কাজের ধরন, অন্য খুঁটিনাটি বিষয়ে। বিজ্ঞাপনগুলোও স্রেফ পোস্টারের মতো, চটকদার শব্দের প্রয়োগে নজর কাড়ার চেষ্টা। পরিযাণ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় এজেন্টদের ভূমিকা খুব জরুরি, তাঁরা এই পোস্টারগুলোই শেয়ার করেন ভাবী পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে। ফলত, কাজের খুঁটিনাটি বিষয়ে এজেন্টদের বিশ্বাস করা ছাড়া পথ থাকে না ভাবী পরিযায়ীদের।
পুরো পরিযাণ প্রক্রিয়া জুড়েই স্থানীয় এজেন্টদের রমরমা। টাকা দেওয়া ও পাসপোর্ট জমা দেওয়া, তার পর উদয় হয় অতিরিক্ত নানা খরচ: পাসপোর্ট, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, মেডিক্যাল টেস্ট, আরও অনেক কিছু বাবদ। প্রতিটি স্তরে সচরাচর এজেন্ট আলাদা, এবং এঁদের প্রত্যেককেই টাকা দিতে হয়, ধরাবাঁধা কোনও নিয়ম নেই। এজেন্টদের অনেকে শত শত পাসপোর্ট নিয়ে বড়সড় কারবার চালান, ছোট এজেন্টরা অল্প কিছু নিয়ে। পরিযায়ী শ্রমিকরা এ ভাবেই হয়ে ওঠেন পণ্যস্বরূপ, এমন এক নেটওয়ার্কের অংশ যেখানে প্রতিটি স্তরে প্রত্যেক এজেন্ট তাঁদের কাছ থেকে অর্থলাভ করতে চান, প্রতিটি স্তরে বাড়তে থাকে পরিযায়ীদের বিপন্নতাও। শ্রমিকেরা এই টাকা জোগাড় করেন ব্যাঙ্কের সহায়তা ছাড়াই— নিজেদের সঞ্চয় কুড়িয়ে, বা পরিবার, বন্ধু, স্থানীয় মহাজনদের থেকে চেয়েচিন্তে ও ধার করে।
বিজ্ঞাপনসূত্রে আসল জায়গায় গিয়ে যে দৃশ্য দেখা গেছে তা হিন্দি ছবিকেও হার মানাবে। স্থানীয় এজেন্টরা কাগজপত্র-সহ প্রার্থীদের ‘রিক্রুটমেন্ট সাইট’-এ পাঠান ছোট গাড়িতে চাপিয়ে, হাবভাব এমন যেন প্রার্থীরা আসলে যুদ্ধবন্দি। এজেন্টদের ভয় থাকে, পাছে বিপক্ষের বা অন্য এজেন্টরা তাঁদের প্রার্থীদের তুলে নেয়। স্থানীয় স্তরে পরিযাণ ব্যবসায় হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কারণ এটাই। স্থানীয় এজেন্টদের পছন্দের প্রার্থী যাতে একটু বেশি সুবিধা পায়, তার জন্য রিক্রুটিং এজেন্টদের ‘উপরি’ দেওয়ার চলও আছে। নথিভুক্ত বহু রিক্রুটিং এজেন্সির কর্তারা খোলাখুলি নগদ টাকা বা অন্য কিছু চাইছেন, এও দেখা যায়। এই ‘উপরি প্রথা’ পৌঁছে যায় বিদেশি চাকরিদাতা পর্যন্তও।
এই অর্থ দিতে এবং এত সব জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতেও ভাবী পরিযায়ীরা কখনও পিছপা হন না। এ নিয়ে তাঁদের খুব অভিযোগও নেই। তাঁদের উদ্দেশ্য একটাই: বাইরে চলে যাওয়াটা সহজ, নির্বিঘ্ন হোক। তাঁরা নিজেরাও স্বীকার করেন যে এজেন্টরা প্রচুর টাকা হাঁকছেন, কিন্তু এ নিয়ে তাঁদের ব্যাখ্যা— ভাল কাজের সুযোগ খুঁজতে ওটুকু দরকার। সুযোগ ‘সন্ধান’-এ ঝুঁকিও কম নয়। প্রতারকদের পাল্লায় পড়ার ভয় আছে; দূর দেশে বা শহরে নথিভুক্ত ও সঠিক নিয়োগকারীদের খুঁজে পেতে অনেক সময় ভুগতে হয় সতর্ক পরিযায়ীদেরও। অনেক সময়েই যথেষ্ট অর্থব্যয় করে যেতে হয় অজানা যাত্রায়, অথচ এজেন্টের বা কাজের ভাল-মন্দ যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না কোনও। তদুপরি পরিযায়ীদের পাসপোর্ট জমা রাখতে হয় এজেন্টদের কাছে, তাতে অবস্থা আরও জটিল হয়। যত অর্থব্যয়ই হোক, স্থানীয় এজেন্টদের অন্ধবিশ্বাসই পরিযায়ীদের কাছে অবস্থার বিচারে যুক্তিযুক্ত হয়ে দাঁড়ায়। পরিযাণের আগে-পরে কোনও সমস্যা হলে পরিযায়ী বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা গিয়ে ধরেন সরাসরি স্থানীয় এজেন্টকে: পরিণতি দরদস্তুর, নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি বা বচসার তিক্ততা।
স্থানীয় এজেন্টদের চেষ্টা থাকেই, পরিযায়ীদের সফল ভাবে কাজ পাইয়ে দেওয়ার। তবে সব সময় যে সাফল্য আসে তা না। এজেন্টদের কাছেও অনেক সময় কাজ সংক্রান্ত সব তথ্য থাকে না। নথিভুক্ত রিক্রুটিং এজেন্টদের মন জোগাতে স্থানীয় এজেন্টরা অনেক সময় প্রার্থীদের বলেন মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে প্রস্তুত থাকতে— চূড়ান্ত নির্বাচনের ফল বেরোনোর আগেই। এক জন নথিভুক্ত রিক্রুটারের অধীনে কর্মরত অগণিত স্থানীয় এজেন্ট— এঁদের মধ্যে কত রেষারেষি থাকতে পারে সহজেই অনুমেয়। ভুক্তভোগী হন পরিযায়ীরাই। তাঁদের থেকে জরুরি নানা তথ্য লুকিয়ে রাখা হয়; অনেক সময় ‘ভিজ়িট’ ও ‘এমপ্লয়মেন্ট’ ভিসার তফাত না বোঝার জেরে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। খড়গ্রামের উসমান ও সুরজিৎ ভিজ়িট ভিসায় বিদেশ গিয়েছিলেন, এমপ্লয়মেন্ট ভিসা না হওয়ায় তিন মাসের মধ্যেই ফিরে আসতে হয়। আর এক জন পরিযায়ীকে রান্নার কাজে বিদেশে পাঠানো হলেও তাঁকে করতে হত ইস্ত্রি করার কাজ। স্থানীয় এজেন্টদের অসম্পূর্ণ বা ভুল তথ্য দেওয়ার জেরেই এ ধরনের দুর্দশা হয় পরিযায়ীদের।
আইআইটি খড়্গপুরের তত্ত্বাবধানে গত তিন বছর ধরে চলা আমাদের এই নিরীক্ষার আওতায় শতাধিক যোগ্য পরিযায়ী বিভিন্ন দেশে নিজেদের পছন্দের কাজের সুযোগ পেয়েছেন। এজেন্টদের সাহায্য ছাড়াই কী ভাবে পরিযাণ সম্ভব, তা কর্মপ্রার্থীদের হাতে ধরে শেখাচ্ছেন আমাদের গবেষণা দলের সদস্যরা। সিসকো ইউনিভার্সিটির গবেষণা কর্মসূচির সুপারিশে এই প্রকল্পের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করছে সিলিকন ভ্যালি কমিউনিটি ফাউন্ডেশন। এজেন্টদের ফাঁদ এড়িয়ে প্রায় বিনা খরচে পরিযাণ যে সম্ভব, তা সাধারণ কর্মপ্রার্থীদের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাই এই নিরীক্ষার একটি বড় সাফল্য। মালয়েশিয়া, কুয়েত বা আরবের বিভিন্ন দেশে বসে তারেক, জীবন, ইনতাজ বা প্রদীপদের পাঠানো ভিডিয়ো-বার্তায় গ্রামের ভাবী পরিযায়ীরা সাহস পান স্থানীয় এজেন্টদের ছেড়ে নিজের চেষ্টায় পরিযাণের।
নজরুলের কথা দিয়েই শেষ করা যাক। গোটা এলাকায় তাঁর বাড়িটাই হোক সবচেয়ে ভাল, এমনই চেয়েছিলেন তিনি। এমনকি সে কাজে পড়শিদের থেকে ঋণও করেছিলেন কিছু। পরে দেখা গেল, রোজকার জীবনধারণের ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফের টাকা ধার করে একটা টোটো কিনতে হয়, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় রোজগারের উপায়। কিন্তু তার পরেই এক দিন বাসের সঙ্গে টোটোর সংঘর্ষ, এবং নজরুলের মৃত্যু। প্রতিটি পরিযায়ী শ্রমিকের পরিণতি হয়তো এমন দুর্ভাগ্যের নয়, কিন্তু একটা ব্যাপার সবার ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়— ফেরার পর স্থানীয় অর্থনীতির সঙ্গে মিশে যাওয়া। বিদেশ থেকে ফিরে স্থানীয় শ্রমিকদের মতো কাজ করা তাঁদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। কেউ কেউ অর্জিত বা সঞ্চিত অর্থে ব্যবসা খোলেন: খাবারের দোকান, বা কম্পিউটার সেন্টার। বাকিরা থাকেন দোলাচলে— ঘরেও নহে, পারেও নহে।
অর্থনীতি বিভাগ, আইআইটি খড়্গপুর
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)