E-Paper

‘তোমার মধ্যে গায় নদীরা’

পাবলো নেরুদা নোবেল পাবেন জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে, তখন ১৯৭১ সাল। তবে প্রথম থেকেই তাঁর কবিতার পঙ্‌ক্তিতে স্পষ্ট চিনে নেওয়া যায় ভবিষ্যতের ‘পৃথিবীর বাসভূমি’-র কবিকে, ‘আমি যেন সুড়ঙ্গের মতো একা।

অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৪:২১
লাতিন আমেরিকার চিলির নোবেলজয়ী পাবলো নেরুদা।

লাতিন আমেরিকার চিলির নোবেলজয়ী পাবলো নেরুদা।

সম্প্রতি শতবর্ষ পূরণ করল একটি ছোট্ট কবিতার বই কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান। কবি, লাতিন আমেরিকার চিলির নোবেলজয়ী পাবলো নেরুদা (ছবি)। এ তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, যা লেখার সময় তাঁর বয়স কুড়ি বছরও পূর্ণ হয়নি। কিন্তু বইটির প্রকাশমাত্রই সাহিত্য সমাজ আন্দোলিত হল। কামার্ত প্রেমের আতিশয্য দেখে এক পত্রিকা-সম্পাদক ছাপতে অস্বীকার করেছিলেন গ্রন্থের প্রথম কবিতাটি, যার শুরু হয়োছিল এই ভাবে, ‘নারীর দেহ, শুভ্র শৈল, শুভ্র ঊরু, তুমি যেন ধরিত্রী, নিজেকে করেছ সমর্পণ’। কিন্তু দেখা গেল, পরে প্রকাশ হওয়ামাত্র তরুণ সম্প্রদায় বইটিকে অতি সাদরে গ্রহণ করলেন। আসলে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর মৃত্যু-উপত্যকায় নিঃসঙ্গ মুহূর্তে মানুষ শিল্পের মধ্যে তখন খুঁজছিলেন অন্তরঙ্গতার জমি, যেখানে আছে একক ব্যক্তিসত্তা, ভালবাসা, পরাজয়। ভালবাসার বিমূর্ত আদর্শ নয়, পাঠক আবিষ্কার করলেন অগোছালো প্রেম ও বাসনার প্রবল অনুভব— তরুণ নেরুদার কবিতায়।

সময়টাই তখন অন্য রকম। দু’বছর আগে ১৯২২-এ প্রকাশিত হয়েছে জেমস জয়েসের ইউলিসিস, টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড, পেরুর কবি সেসার বাইয়েহোর ত্রিলসে। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হবে স্পেনের কবি গার্সিয়া লোরকার ভুবনবিজয়ী রোমান্সেরো হিতানো। এরই মাঝখানে নেরুদা তাঁর চোখ, কান, নাক, জিভ, আঙুলের ডগা সব কিছু দিয়ে যে প্রেম উচ্চারণ করলেন সেখানে পাইনের বন, কূলে ঢেউয়ের শব্দ, ঘণ্টার ধ্বনি, সব মিলে যায় তাঁর প্রেয়সীতে, ‘তোমার মধ্যে গায় নদীরা’। ক্ষণস্থায়ী প্রেম আর অনন্ত বিস্মরণের এই সব কবিতা শতাব্দী পার করেও সমান ঐশ্বর্যময়।

চিলির রাজনীতিতে তখন পরিবর্তনের ঢেউ। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নতুন সংবিধানে গির্জার ক্ষমতা কমিয়েছে, গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। এমন সংস্কারের অভিমুখ স্বাভাবিক ভাবেই থাকে ইউরোপ, বিশেষ করে ফ্রান্সের দিকে। কিন্তু নেরুদা অতীত প্রভুদের থেকে মুখ ফিরিয়ে সবার সমানে আনলেন চিলির আপন সম্পদ, অপরূপ পর্বত, অরণ্যের মহিমাকে, সে মাটির মেয়েদের। এই কবিতার বইয়ের আয়নায় তাঁর দেশের মানুষ দেখতে পেলেন তাঁদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এ ভাবেই তাঁর কবিতা পরবর্তী কালে লাতিন আমেরিকার নিজস্ব আত্মা আবিষ্কারের স্পর্ধা দেখাবে। চিলির ঘরে ঘরে বাইবেল না থাকলেও একখানি কুড়িটি প্রেমের কবিতা... থাকবেই।

পাবলো নেরুদা নোবেল পাবেন জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে, তখন ১৯৭১ সাল। তবে প্রথম থেকেই তাঁর কবিতার পঙ্‌ক্তিতে স্পষ্ট চিনে নেওয়া যায় ভবিষ্যতের ‘পৃথিবীর বাসভূমি’-র কবিকে, ‘আমি যেন সুড়ঙ্গের মতো একা। আমার মধ্যে থেকে উড়ে যায় পাখি/ আর আমার ভিতরে ঢুকে রাত্রি জারি করে তার প্রমত্ত অধিকার।’ শব্দ ও ভাবের সন্ধানে তিনি পৌঁছে যান সুদূর প্রাচ্যে, রবীন্দ্রনাথের কাছে, আগের শতকের শেষে লেখা ‘মানসপ্রতিমা’ কবিতার অবয়বে গড়ে ওঠে তাঁর কবিতা, ‘তুমি আমারই, তুমি আমারই, মধু অধরের রমণী/ তোমারই হৃদয়ে সঞ্জাত মম অশেষ স্বপ্নচারণা।’ তাঁর কবিতায় পাশাপাশি বসে থাকে সংবেদনশীলতা ও প্রখর বুদ্ধিমত্তা। চূড়ান্ত দক্ষতায় তিনি দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে মাহাত্ম্যের নির্যাস মেলে ধরতে পারেন। তাই কুড়িটি প্রেমের কবিতা... যত বার পড়া যায় তত বারই আবিষ্কৃত হয় প্রেম, বিচ্ছেদ ও আশা-হতাশার এক আশ্চর্য অপূর্ব বলয়, যেখানে না-বলা কথারা কবিতা হয়ে চার পাশ ঘিরে রাখে: ‘তোমায় ভাল লাগে যখন তুমি নিশ্চুপ থাকো’।

এত জনপ্রিয় হওয়ায় এই বইটির প্রেক্ষাপটও বহু-আলোচিত। তরুণ নেরুদা যে প্রেমের সন্ধান পেয়েছিলেন তাঁর তিন প্রেমিকার সন্নিধানে, আলবেরতিনা রোসা, তেরেসা বাস্কেস ও মারিয়া পারোদি (চতুর্থ এক জনও থাকতে পারেন)— তারই অভিব্যক্তি এ সব কবিতায়। এঁদের কারও সঙ্গেই স্থায়ী হয়নি তাঁর সম্পর্ক, কিন্তু সেই কিশোরীরা অমর হয়ে আছেন তাঁর কবিতায়। ধরা রয়েছে তাঁর শৈশব-কৈশোরের শহর তেমুকো ও পুয়ের্তো সাভেদ্রার বৃষ্টিভেজা পাহাড়, বন। নেরুদা নিজে তাঁর আত্মজীবনীতে এই বইটি সম্বন্ধে বলেছেন, এতে ধরা ছিল তাঁর বয়ঃসন্ধির প্রবল আবেগ, এবং দক্ষিণ চিলির অবিস্মরণীয় প্রকৃতি।

তাঁর লেখার নিজস্ব শৈলীর সূত্রপাতও এই বই থেকে। ১৯৬৪ সালে দেওয়া ভাষণে নেরুদা বলেছেন, সমকালীন খ্যাতিমান কবি কার্লোস সাবাত এরকাস্তির প্রভাব কাটাতে তিনি কী ভাবে মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন। যে বই এক ভুবনজয়ী কবির যাত্রাপথের সূচনা করে, তার প্রকাশের একশো বছর পূর্তিতে যে স্প্যানিশ বিশ্বের সাহিত্যসমাজ উৎসবের আয়োজন করবে, সে তো স্বাভাবিক। লাতিন আমেরিকার প্রায় প্রতিটি দেশের খবরের কাগজ ও সাহিত্য পত্রিকায় বইটি আলোচিত হয়েছে। চিলি থেকে প্রকাশিত হয়েছে শতবর্ষের নতুন সংস্করণ। পানামায় চিলির দূতাবাস কবিতা দিবসকে বেছে নিয়েছিল কুড়িটি প্রেমের কবিতা... পাঠ ও উদ্‌যাপনে। এমন অনেক আরও অনুষ্ঠান চলছে। বিশ্বজোড়া উৎসবের এই আবহে আমরাও যদি আর এক বার নেরুদার প্রেমের পাঠে নিঃসঙ্গতার সাক্ষাৎ পাই, তাঁর হতাশার গানে পেয়ে যাই আশার বৈভব, তা হলে বেশ হয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Chile

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy