ভারত খাদ্য উৎপাদনে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। দেশের খাদ্য সুরক্ষা আরও দৃঢ় করতে ইতিমধ্যেই ‘জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন’ এবং ‘মিড-ডে মিল’-এর মতো প্রকল্প চালু করেছে। সম্প্রতি, রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)-র ডেপুটি এগজ়িকিউটিভ ডিরেক্টর কার্ল স্কাউ ভারত সফরে এসে প্রকল্পগুলির প্রশংসা করে বলেন, ভারত নিজেদের খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যে সমাধানসূত্র তৈরি করেছে, তা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জন্য একটি শিক্ষণীয় মডেল হতে পারে। চাল সরবরাহের জন্য ভারত সরকারের খাদ্য মন্ত্রকের সঙ্গে ডব্লিউএফপি-র একটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা বিশ্বের খাদ্য সঙ্কট মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভারতের গুরুত্ব আরও বাড়িয়েছে।
প্রশ্ন হল, খাদ্যশস্য উৎপাদনে ভারত উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করার পরও কেন দেশের একটি বড় অংশ (বিশেষত পাঁচ বছরের কম বয়সিরা) অপুষ্টিতে ভুগছে? ২০২৪ সালের ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’ (জিএইচআই) অনুসারে, ভারত ১২৭টি দেশের মধ্যে ১০৫তম স্থানে রয়েছে। এই নিম্ন র্যাঙ্কিংয়ের মূল কারণ শিশুদের মধ্যে উচ্চমাত্রার অপুষ্টি, বিশেষ করে ‘ওয়েস্টিং’ বা উচ্চতার সাপেক্ষে কম ওজন এবং ‘স্টান্টিং’ বা বয়সের তুলনায় কম উচ্চতার হার যথাক্রমে ১৮.৭% ও ৩৫.৫%। এই হার বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ হারগুলির মধ্যে অন্যতম। ভারত সরকার জিএইচআই-এর পদ্ধতিকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ ও ‘অবৈজ্ঞানিক’ বলে বার বার এই তথ্য প্রত্যাখ্যান করেছে, নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের ‘পোশন ট্র্যাকার’-এর পরিসংখ্যানকে ঢাল হিসেবে তুলে ধরেছে। এই তথ্য অনুযায়ী, শিশুদের কৃশতার হার ৬% থেকে ৭.২%-এর মধ্যে, যা জিএইচআই-এর দেওয়া তথ্যের তুলনায় অনেক কম। তবে, জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা ৫-এর মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত সমীক্ষাও দেশের মধ্যে অপুষ্টির ব্যাপকতা তুলে ধরেছে, যেখানে শিশুদের কৃশতার হার ১৯.৩%।
এই সঙ্কট মোকাবিলায় ভারতে ২০১৩-য় চালু হওয়া ‘জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন’ প্রায় আশি কোটি মানুষকে ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্যের আইনি অধিকার দিয়েছে। তবে, প্রকল্পটির মূল ত্রুটি হল, যোগ্য পরিবারগুলিকে সঠিক ভাবে চিহ্নিত করতে না পারা, এবং খাদ্যে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজের অভাব। ফলে ‘লুকোনো ক্ষুধা’ দূর করা সম্ভব হয়নি। একই ভাবে মিড-ডে মিলের ক্ষেত্রে তহবিল সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা ও প্রশাসনিক দুর্নীতি সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
খাদ্য নিরাপত্তা কেবল খাদ্য পাওয়ার উপর নির্ভর করে না, বরং খাদ্যের সহজলভ্যতা, পুষ্টির গুণমান ও স্থায়িত্বের মতো বহুমুখী দিকও এর সঙ্গে জড়িত। ভারত দীর্ঘ দিন কেবল উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিয়েছে, কিন্তু খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার অদক্ষতা ও ব্যাপক অপচয়ে নজর দেয়নি। ফলে খাদ্য উৎপাদন ও ক্ষুধার মধ্যে এক অদ্ভুত ব্যবধান তৈরি হয়েছে। ভারতে উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় ৪০% নষ্ট হয়, যা উৎপাদনের সাফল্যকে সমাজের সব স্তরে সমান ভাবে পৌঁছে দিতে পারেনি। এ ছাড়াও, ভারতের অপুষ্টি কেবল খাদ্যের অভাবের ফল নয়, বরং দারিদ্র, সামাজিক বৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য ও স্বাস্থ্যগত দুর্বলতার এক জটিল পরিণতি। দলিত ও জনজাতি সম্প্রদায়ের শিশুরা বেশি পুষ্টিহীনতায় ভোগে। মহিলারা প্রায়শই খাদ্যের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। এর বাইরেও, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও দূষিত পানীয় জলের কারণে সৃষ্ট সংক্রমণ প্রায় ৫০% অপুষ্টির জন্য দায়ী বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে।
ভারত খাদ্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে বিশ্বমঞ্চে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। কিন্তু এই আপাত-সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক চরম বৈপরীত্য। খাদ্যের উৎপাদক কৃষকরাই চরম দুর্দশার শিকার। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র ২০২২-এর ‘অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথস অ্যান্ড সুইসাইডস ইন ইন্ডিয়া’ রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মূল কারণ ঋণের বোঝা। বীজ, সার ও কীটনাশকের মতো কৃষি উপকরণের চড়া দাম, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শস্যহানি তাঁদের আর্থিক অবস্থা দুর্বলতর করে তোলে। তাঁরা ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না, দারিদ্রের দুষ্টচক্রে জড়িয়ে পড়েন। নীতিগত দুর্বলতা ও পরিকাঠামোগত অভাবও কৃষকদের দুর্দশার অন্যতম কারণ। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যনীতি ধান বা গমের মতো নির্দিষ্ট কিছু ফসল চাষে উৎসাহিত করে। কিন্তু এর বিপদ হল, কৃষকরা একটি বা দু’টি ফসলের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। কোনও কারণে সেই ফসল নষ্ট হলে আয়ের কোনও বিকল্প উৎস থাকে না।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাজ়িলের ‘জ়িরো হাঙ্গার’ মডেল এবং ভিয়েতনামের ‘ডই মই’ নীতি থেকে ভারত শিক্ষা নিতে পারে। ব্রাজ়িল দরিদ্র পরিবারগুলিকে সরাসরি আর্থিক সহায়তা দিয়ে পুষ্টি নিশ্চিত করেছে, এবং ‘খাদ্য সংগ্রহ কর্মসূচি’র মাধ্যমে সরকার সরাসরি ক্ষুদ্র কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য কিনছে। সামাজিক সুরক্ষা ও কৃষি উৎপাদনকে সঠিক ভাবে যুক্ত করলে ক্ষুধা ও দারিদ্র উভয়ই কমানো সম্ভব— এটা তার প্রমাণ। অন্য দিকে, ভিয়েতনাম প্রথমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, তার পর উন্নত কৃষি পদ্ধতি ও সরাসরি বাজার সংযোগের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং ফসলের পুষ্টির মান বাড়িয়েছে।
এই দুই মডেল প্রমাণ করে, উৎপাদন, বণ্টন, কৃষকদের নিরাপত্তা এবং জনগণের পুষ্টির চাহিদার মধ্যে কার্যকর সংযোগ স্থাপন করা জরুরি। ভারতের জন্য মডেলগুলি পথনির্দেশক হয়ে উঠতে পারে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)