একটা খোলা চিঠি। পড়ে মনে হচ্ছিল আত্মহত্যাকালীন জবানবন্দি নয়, যেন কারও ইচ্ছাপত্র (উইল) পড়ছি। এমনকি সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনীও ভাবা যায়। ঠিক কী কী কারণে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হল, তার জন্য কে কী ভাবে দায়ী, কাকে কী শাস্তি দিতে হবে, তার পূর্ণ বিবরণ দিয়ে এমনকি আগের অভিযোগের সূত্র (আন্তর্জালের একটি লিঙ্ক) পর্যন্ত দিয়ে সব গোছগাছ করে ছেলেটি যেন তাঁর জীবন থেকে বেরিয়ে গেলেন। হ্যাঁ, আমি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটস অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার)-এর গবেষক সদ্যপ্রয়াত অনমিত্র রায়ের খোলা চিঠির কথাই বলছি। মনে পড়ছে এই ধরনের চিঠি আগেও এক বার পড়েছি, প্রায় দশ বছর আগে। সেখানে অবশ্য সে ভাবে কাউকে দায়ী করা ছিল না; যেন ‘দায়ী করে কী হবে’ এই তীব্র হতাশায় আর অভিমানে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার মুহূর্তে এমনকি শত্রুদেরও রেহাই দিয়েছিলেন হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রোহিত ভেমুলা।
দু’জনেই গবেষক, উচ্চ মেধার অধিকারী। তাঁদের ‘কেরিয়ার’, তাঁদের শেষ চিঠির ভাষা ও বয়ান থেকেও তা পরিষ্কার। অথচ দু’জনেই নিজেদের জীবন দিয়ে অনুভব করেছেন যে তাঁরা এই পৃথিবীর উপযুক্ত নন, জীবনের চেয়ে মৃত্যুতেই তাঁরা বেশি ভাল থাকবেন। সে কথা তাঁদের শেষ চিঠিতে লেখাও আছে। এইখানে এসে আমাদের থমকে দাঁড়াতে হয়, ভেবে দেখতে হয়, আসলে আমরাই কেন এই উজ্জ্বল তরুণদের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারলাম না! সে কি শুধু তাঁরা কোনও ভাবে একটু ‘আলাদা’ বলেই?
রোহিতের কথা সরিয়ে আপাতত অনমিত্রের কথাই ভাবি। ছেলেটিকে কেন চলে যেতে হল? কারণটা তিনি নিজেই স্পষ্ট লিখে গিয়েছেন, সহ-গবেষকের ধারাবাহিক উৎপীড়ন বা র্যাগিং। অনেকেরই হয়তো বুঝতে অসুবিধা হবে যে একটা উচ্চ মানের গবেষণাগারের ভিতরে, যেখানে একই ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত, স্বাবলম্বী, অন্তত ২৩-২৪ বছর বয়সি অল্প কিছু ছাত্র-ছাত্রী কাজ করেন, সেখানে কী করে র্যাগিং হয়, কে কাকে র্যাগিং করেন। আসলে র্যাগিং মানে শুধুই ধরাবাঁধা শারীরিক নির্যাতন নয়, পদে পদে নানা ভাবে আহত-অপমানিত-উত্ত্যক্ত করা এমনকি উপেক্ষা করাও এক রকমের র্যাগিং এবং যেখানেই কোনও রকমের অনুক্রমের (হায়ারার্কি) অস্তিত্ব আছে, সেখানেই এই দ্বিতীয় ধরনের র্যাগিং সম্ভব। গবেষণাগারের চৌহদ্দির ভিতরে ‘ছাত্র-শিক্ষক’ (গাইড-স্কলার) অনুক্রম এমনকি ‘সিনিয়র-জুনিয়র’ অনুক্রমও খুবই সম্ভব আর যেখানে এই অনুক্রম কঠোর, সেখানে র্যাগিং-এর সম্ভাবনা প্রবল। এক জন ছাত্র-গবেষকের পিএইচ ডি-কালীন পাঁচ-ছয় বছর তাঁর ভবিষ্যতের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; জীবনের এই পর্যায়ে বাবা-মায়ের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠেন তাঁর শিক্ষক বা গাইড।
কোনও ছাত্র-গবেষকের জীবনের তৃতীয় অক্ষে অবস্থান করেন তাঁর সহ-গবেষকেরা, যাঁরা কিছু বছর আগে থেকে ওই গবেষণাগারে কাজ করছেন, অর্থাৎ ‘সিনিয়র’। অনেক ক্ষেত্রেই নতুন ছাত্রদের প্রাথমিক ভাবে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া, বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবহার শেখানো এই সব দায়িত্ব সিনিয়ররাই নিয়ে থাকেন। সেটাও খারাপ কিছু নয়, বরং দলবদ্ধ কাজের এটাই সুবিধা। কিন্তু এই সুবাদে কোনও কোনও (সব নয়) গবেষণাগারের ভিতরে কিছু সিনিয়র এক-এক জন ক্ষমতাবান নেতার মতো হয়ে ওঠেন, জুনিয়ররা কে কখন কোন যন্ত্রে কতটা কাজ করবেন, কোন পেপার অর্থাৎ গবেষণাপত্রে কার নাম কোন ক্রমে থাকবে, সব এঁরাই ঠিক করেন। এর বিরুদ্ধে গলা তুললে জুনিয়র শুধু অপমানিতই হন না, কাজের ক্ষতিও হতে পারে। যে বিজ্ঞানীর অধীনে (তত্ত্বাবধানে) এঁরা গবেষণা করেন তাঁর পরোক্ষ প্রশ্রয়েই এই সিনিয়রদের এত রমরমা হয়, কারণ এঁরা অনেক দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এই দাদাগিরি বা দিদিগিরি সহ্য করা অনেক সময়েই জুনিয়রের পক্ষে অসহনীয় হয় ওঠে, অনমিত্রের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ধারাবাহিক ভাবে অপমান ও দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হচ্ছিল বিশেষ এক জন ‘দাদা’র কাছ থেকে।
তবু সব গবেষক আত্মহনন করেন না। বেশির ভাগই এই সব পেরিয়ে পৌঁছে যান নিজের লক্ষ্যে। কেউ কেউ অবশ্য পারেন না, বীতশ্রদ্ধ হয়ে ছেড়ে দেন গবেষণা। কিন্তু এই আপাতসামান্য বিষয়ে অনমিত্র কেন তাঁর নিজের জীবন ছেড়ে চলে গেলেন? কারণ কিছু মানুষ অন্য রকম ভাবে সংবেদনশীল হন, অনমিত্রও ছিলেন ‘অটিজ়ম স্পেকট্রাম’-এর প্রান্তে থাকা এক মেধাবী ছাত্র, যিনি আচরণে-অভিব্যক্তিতে কোথাও হয়তো ‘একটু’ অন্য রকম। কে না জানে অন্য রকম মানুষেরা নিজেদের বিষয়ে অধিক সংবেদনশীল হন আর তাঁরাই তীক্ষ্ণতর আক্রমণের শিকার হন! অনমিত্র বেশ কয়েক বছর ওই সংস্থায় ছিলেন, গাইডের সঙ্গে তাঁর কয়েকটিগবেষণাপত্রও আছে। তাই এই বিষয়ে ওঁর গাইড-এর ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ছেলেটি যে একটু অন্য রকম, সেটা জেনেও তাঁকে একটু বেশি সহানুভূতি বা সমানুভূতির সঙ্গে দেখা, তাঁর সমস্যাটা একটু বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা কি গাইডের উচিত ছিল না? সেই সঙ্গে সিনিয়র ছাত্র যতই দক্ষ ও দায়িত্ববান হোন তাঁকে তাঁর অন্যায়টা নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করে তাঁকে তা শুধরে নেওয়ার কথা বলাও নিশ্চয়ইউচিত ছিল।
অনমিত্র কিন্তু চেষ্টা করেছিলেন, বিশ্বাস রেখেছিলেন ‘সিস্টেম’-এর উপর। তাই সিনিয়রের উপর নির্দিষ্ট অভিযোগ ও এই বিষয়ে তাঁর দাবির কথা জানিয়ে ‘অ্যান্টি র্যাগিং’ সমিতির কছে চিঠি লিখেছিলেন। ২০১৭ সাল থেকে এই সমিতির কাছে নাকি এই একটিই অভিযোগ জমা পড়েছিল। অনমিত্র স্পষ্ট করে লিখেছেন, বিশেষ এক জন সিনিয়রের ধারাবাহিক খবরদারি (‘বসিং’) ওঁর সহ্য হচ্ছিল না। সামান্য চেয়ার সরানো নিয়ে ওঁকে প্রকাশ্যে যে অপমান করা হয়েছিল, তাতেই ওঁর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। উনি চেয়েছিলেন, সিনিয়র ওঁকে প্রকাশ্যেই ‘সরি’ বলুন, যা খুবই সাধারণ ও যৌক্তিক দাবি। যেখানে প্রচলিত অর্থে র্যাগিং হয় না, সেখানে এই প্রথম অভিযোগটির গুরুত্ব কেন অনুধাবন করা গেল না, আজ সে প্রশ্নের জবাব কেউ দেবেন? তা হলে এই সমিতি আছে কেন? এমনকি তাঁর গাইডও নিজে দু’জনকে এক সঙ্গে বসিয়ে আলোচনা না করে চাইলেন ওঁরা নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নিক। যাঁর শাস্তি চাইছি, তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসতে বলা মানে তাঁর অপরাধটাই লঘু করে দেওয়া। যাঁর প্রতি অভিযোগ, তাঁকে কেউ তিরস্কার তো করলেনই না, উপরন্তু যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেই গাইডই যদি প্রকাশ্যে সেই অপরাধীর প্রশংসা করেন, তার পরে আর কোথাও বিশ্বাস থাকে! এই হতাশা অনেকে কাটিয়ে ওঠেন, কিন্তু যিনি এমনকি নিজের বাবা-মায়ের কাছ থেকেও নিষ্ঠুরতা পেয়েছেন (বলে মনে করেন), তাঁর পক্ষে এই উপেক্ষা ও হতাশা জয় করা যে কঠিন হতেও পারে, এইটা আমরা তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ মানুষরা বুঝে উঠতে পারলাম না।
আজও আমরা এই কথাগুলো ভাবছি, কারণ অনমিত্র আর আমাদের মধ্যে নেই। মৃত্যুটা যে একটা প্রতিবাদ হতে পারে সেটা আমরা আগে অনেক বার দেখেছি, শিক্ষা নিইনি। যাঁরা মনে করেন মানুষ মুহূর্তের উন্মাদনায় আত্মহত্যা করেন, ওঁর চিঠি পড়ে তাঁরা নতুন করে ভাবুন। ওঁর আবেগকে যাঁরা গুরুত্ব দেননি, তাঁরা আজ এক বার লজ্জা পান, আফসোস করুন যে এই ক্ষতিটা কেন সইতে হল, কী করলে এই ক্ষতিটা আটকানো যেত। স্মরণসভায় মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোর ও-পারে শুধু একটিই হাসিমুখ; যিনি চলে গিয়েছেন, তিনি বার বার বলেছিলেন, তিনি ভাল নেই। আমরা কান দিইনি। মৃত্যুর পর আর কোনও বিচার হয় না, সংশোধনও হয় না। কিন্তু আমরা কি এই ক্ষতিটা স্বীকার করলাম, না ভেবেই নিলাম এমন তো কতই হয়!
পুনশ্চ: এই লেখা লিখতে লিখতে মনে পড়ল আর একটি মেয়ের কথা। প্রায় তিন দশক আগে তাঁর মৃদুভাষী গাইডের সমর্থন পেয়েছিলেন বলে এক সিনিয়রের দাদাগিরি সে দিন অগ্রাহ্য করতে পেরেছিলেন। এ ভাবেই পাশে থাকা যায়।
রসায়ন বিভাগ, সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)