জানুয়ারি মাসের তিন তারিখ। নতুন করে বন্ধ হল স্কুল। শিক্ষকরা স্কুলে বসে তৈরি করছি একাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের তালিকা, এমন সময় সামনে এসে দাঁড়াল মলিন ছাপা কাপড়ের মাস্কে ঢাকা একটি মুখ। মিনতি বর্মণ। বাবা টোটো চালান, মা লোকের বাড়িতে ঠিকা কাজ করেন। প্রশ্ন করে, “স্যর, আমাদের আর ক্লাস হবে না?” বাইরে দাঁড়িয়ে একঝাঁক কিশোরী। “আপনি বললেন ওদের পাড়ায় যাবেন পড়া দেখিয়ে দিতে। আমাদের মুন্ডাবস্তিতে আসবেন এক দিন, স্যর?”
পাঠশালা আবার বন্ধ হওয়ায় সমাজমাধ্যমে অন্য বারের তুলনায় কিঞ্চিৎ জোরালো আপত্তি আর অসন্তোষের স্বর। পাল্টা যুক্তিটাও এত দিনে পরিচিত— সে যুক্তির সবটাই যে উড়িয়ে দেওয়া যায়, তা-ও নয়। তবু, এক দিকে বারে বারে ফিরে আসা ব্যাধির হুমকি, আর অন্য দিকে পাঁচ থেকে তেরো বছর বয়সি স্কুলপড়ুয়াদের পড়াশোনা প্রায় স্তব্ধ হয়ে থাকা, এই দুইয়ের মাঝখানে উঠে আসে কয়েকটি প্রশ্ন।
আমরা— অধিকাংশ শিক্ষক— গত দু’বছরের প্রায় লেখাপড়াহীন স্থবির সময় জুড়ে কোনও গঠনমূলক বিকল্পের ছবি তৈরি করতে পারিনি, এমনকি নিজেদের কাছেও। কোনও কোনও নিষ্ঠাবান সংগঠন বা সমাজকর্মীর উদ্যোগে কিছু ‘কমিউনিটি ক্লাস’ চলেছে। কিন্তু তাদের পদ্ধতি অন্যদের প্রয়োগে উৎসাহিত করা হয়নি। সরকার কেন্দ্রীয় ভাবে ‘অ্যাক্টিভিটি টাস্ক’ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কিছু পরিশ্রমী স্কুল নিজেদের উদ্যোগে অনলাইন ক্লাস করেছে— সরকারের অনুদান হিসাবে পাওয়া হাতের স্মার্টফোনটি সে ক্ষেত্রে পড়ুয়াকে এই অনলাইন ক্লাস করার ‘স্ব-ক্ষমতা’ দিয়েছে। এমন বিচ্ছিন্ন কিছু আশাব্যঞ্জক ছবি ছাড়া এই দুইটি বছর ধরে সরকার ও শিক্ষকরা মিলে কোনও গ্রহণযোগ্য বিকল্প তৈরি করতে পারেননি, যা পড়াশোনাটুকু ধারাবাহিক ভাবে চালু রাখবে।