সদ্যপ্রাক্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর বিদায়ী-ভাষণে বললেন ‘টেক-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’-এর অস্তিত্বের কথা— সতর্ক করলেন, আমেরিকার গণতন্ত্র ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পরিণত হচ্ছে ‘অলিগার্কি’-তে, যাকে বলে গোষ্ঠীতন্ত্র। কিছু অতি-ধনী লোকের হাতে ক্ষমতার বিপজ্জনক কেন্দ্রীকরণ।
রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার মাখামাখি সর্বত্র। কখনও সেটা বিপজ্জনকও হয়ে ওঠে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্তমান মন্ত্রিসভা আমেরিকার ইতিহাসে ধনীতম। ইলন মাস্ক রয়েছেন নতুন গড়ে ওঠা ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি’-র দায়িত্বে। এই ক্ষমতা মাস্ক কিনেছেন রীতিমতো গাঁটের কড়ি ফেলে— ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের প্রচারকালে প্রায় ২৫ কোটি ডলার খরচ করে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় অভিষেক-আসর আলো করে ছিলেন প্রযুক্তি দুনিয়ার ধনীতম ব্যক্তিরা— অ্যামাজ়নের জেফ বেজ়োস, মেটা-র মার্ক জ়াকারবার্গ, অ্যাপলের টিম কুক— আমেরিকান সরকারের বহুমূল্য সব বরাত যাঁদের অনেকেরই পকেটে।
‘অলিগার্কি’ কথাটা মিলবে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের লেখায়। অভিজাত উচ্চ শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ বা ‘অ্যারিস্টোক্র্যাসি’-র বিপ্রতীপে ‘অলিগার্কি’ হল অল্প কিছু লোকের শাসন— কিন্তু দুর্নীতি এবং অন্যায় উদ্দেশ্যে। ‘অলিগার্ক’-রা ক্ষমতার দখল নেন প্রধানত অর্থের সাহায্যে। তাঁরা রাজনীতিবিদদের প্রচুর পরিমাণে অর্থ সাহায্য করেন, পরিবর্তে রাজনীতিকরা দেশ চালান তাঁদের কথামতো। অলিগার্কদের ঐতিহাসিক রূপরেখা, তাঁদের উদ্দেশ্য এবং কর্মপদ্ধতির মধ্যে মিল বর্ণনা করেছেন নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জেফ্রি উইন্টার্স, তাঁর ২০১১-র বই অলিগার্কি-তে। শুধুমাত্র সম্পত্তি তৈরি নয়, সম্পত্তি রক্ষার একটা চাপও তাঁদের রয়েছে। সেটা একক ভাবে হতে পারে, হতে পারে সম্মিলিত ভাবেও।
অলিগার্কি মানেই যে খারাপ তা কিন্তু নয়। অলিগার্কি ‘দুষ্ট’ হয়ে ওঠে যখন তা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখায়, নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে না, নিজেদের স্বার্থে জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়। মুশকিল হচ্ছে, ঐতিহাসিক ভাবে সেটাই ঘটে বার বার। অলিগার্কদের রাজনীতির ধরন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু তাঁদের একটা উদ্দেশ্য অপরিবর্তনীয়— সম্পদের রক্ষণ। নানা ভাবে তাঁরা সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করেন তাঁদের সম্পত্তিকে। গণতন্ত্রে তাঁরা এই দায়িত্ব আউটসোর্সিং করে দেন রাষ্ট্রের কাছে। অলিগার্কি নিয়ে জ্যাক লন্ডনের ১৯০৮ সালের বহুচর্চিত ডিসটোপিয়ান উপন্যাস দি আয়রন হিল-এ বিপ্লবীরা অলিগার্কির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার আগেই সরকার চেষ্টা করে বিপ্লব শেষ করতে। সরকার শিকাগোতে একটি ধর্মঘট করায়, একটি দাঙ্গা করায় প্রতিরোধকে দায়ী করে, এবং অলিগার্কি দ্বারা নিযুক্ত ভাড়াটে বাহিনীর সাহায্যে তা দমন করে চরম শক্তির সঙ্গে। জনমত গঠনেও স্পষ্ট আগ্রহ থাকে অলিগার্কদের। সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল থেকে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, সব কিছুই কিনে নিতে চান অলিগার্ক-রা। কিনেও ফেলেন।
সমাজতত্ত্ববিদরা কিছু দেশকে অলিগার্কি বলে দাগিয়ে দিয়েছেন। যেমন ফিলিপিনস— ঔপনিবেশিক ইতিহাস এবং কিছু ক্ষমতাশালী পরিবার নাকি এ জন্য দায়ী। যেমন চিন— তারা নিজেদের জনগণের প্রজাতন্ত্র বললেও দশকের পর দশক অল্প কিছু লোকের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকায় অনেকেই একে ‘অলিগার্কি’ বলে মনে করেন। সাম্প্রতিক কালে অবশ্য ‘অলিগার্ক’ শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয় ধনী, শক্তিশালী এবং ক্ষমতার অলিন্দে লেপ্টে থাকা রাশিয়ান ব্যবসায়ীদের বোঝাতে। এই শতকের একেবারে শুরুতে ক্ষমতায় এসে ভ্লাদিমির পুতিন নাকি এঁদের ‘জেলে যাওয়া’ এবং ‘নিরাপত্তার পরিবর্তে আনুগত্য প্রদর্শন’, এই দু’টি বিকল্পের যে কোনও একটি বাছতে বলেন। অবশ্য, আমেরিকান সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ২০২২ সালে বলেছিলেন, “অবশ্যই অলিগার্করা রাশিয়া চালায়। কিন্তু অলিগার্করা আমেরিকাও চালায়।”
অলিগার্ক-রা আগেও ছিলেন। কিন্তু হালে তাঁরা এক অভূতপূর্ব রূপ ধারণ করেছেন। ২০১৭-র বই আমেরিকান অলিগার্কি: দ্য পার্মানেন্ট পলিটিক্যাল ক্লাস-এ এই নব্য-রাজনৈতিক শ্রেণির তত্ত্বতালাশ করেছেন আমেরিকান রাজনৈতিক সংস্কৃতি-বিষয়ক ইতিহাসবিদ রন ফরমিসানো। অলিগার্কদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এ সবের ফলেই ক্রমবর্ধমান সামাজিক বৈষম্য, বলছেন তিনি। শুধু রাজনীতিবিদরাই নন, লবিইস্ট, পরামর্শদাতা, আমলা, বিশিষ্ট সাংবাদিক, এবং পর্দার আড়ালে সক্রিয় ধনীদের কাজকর্মের অন্বেষণ করেন ফরমিসানো। অর্থনীতিবিদ সাইমন জনসনের মতে, অর্থনৈতিক অভিজাততন্ত্রের হালের রমরমা শুরু ২০০৮-এর অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে। আবার ২০১০-এ আমেরিকান সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক প্রচারে অনুদানের উপর তুলে দেয় বিধিনিষেধ। ‘ডার্ক মানি’ প্লাবিত করে রাজনীতির আঙিনাকে। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার একে বলেছিলেন ‘সীমাহীন রাজনৈতিক ঘুষ সহযোগে অলিগার্কি’। ধনীদের পক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেনা হয়ে যায় আরও সহজ। এ সব মিলেমিশেই অলিগার্কি-র বাঁধ ভাঙে।
অলিগার্কি কি তা হলে কয়েকটি দেশেই সীমাবদ্ধ? বার্নি স্যান্ডার্স বলেছেন, “কেবল আমেরিকায় নয়, কেবল রাশিয়ায় নয়; ইউরোপে, ব্রিটেনে, সারা বিশ্বে, আমরা দেখতে পাচ্ছি অল্প সংখ্যক অসম্ভব ধনী লোক সব কিছু চালাচ্ছেন তাঁদের স্বপক্ষে।” তাই ক্রমবর্ধমান অলিগার্কি-র জন্য শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কাঠগড়ায় তোলা হয়তো সঠিক বিচার নয়। কত জন বিলিয়নেয়ার ভোটের প্রচারে বাইডেনকে টাকা জুগিয়েছেন, সেই হিসাবটাও জরুরি।
আমেরিকা নিয়ে ভাবার ফাঁকে অবকাশ পেলে ঘরের কাছের আরশিনগরের খবরও নেওয়া যায়।
রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)