বলার দরকার নেই, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নার্সিং কত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশিক্ষিত নার্স ছাড়া এক ঘণ্টাও কোনও হাসপাতাল চালানো অসম্ভব। নার্সিং অফিসাররা অধিকাংশই মহিলা, তাঁদের কাজ করতে হয় তিনটি শিফ্টে। পরবর্তী নার্সকে দায়িত্ব হস্তান্তর করে তবে তাঁরা বেরোতে পারেন কাজ থেকে। সময়ানুবর্তিতার দৃষ্টিতে যে কোনও পেশার কর্মীদের অনুপ্রেরণা হতে পারেন নার্সরা। শত অসুবিধা সত্ত্বেও নার্সরা ‘ক্যাজ়ুয়াল লিভ’ নিতে চান না। হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের টিম-এ নার্সদের উপস্থিতি আবশ্যক, মুমূর্ষু রোগী, অসুস্থ নবজাতক এবং অন্য রোগীদের প্রয়োজনও কখনও ফুরোয় না। যথাসময়ে নার্সরা না পৌঁছলে এই অসহায়, যন্ত্রণাকাতর মানুষগুলির সঙ্কট আরও তীব্র হবে। নার্সরা সেটা চান না, তাই রোগীর অনুপাতে নার্স অত্যন্ত কম হলেও নার্সহীন ওয়র্ড দেখা যায় না। সব ধরনের সরকারি কর্মীদের উপস্থিতির নথিপত্র খতিয়ে দেখলে হয়তো দেখা যাবে, সময়ানুবর্তিতার নিরিখে নার্সরা রয়েছেন শীর্ষের দিকে।
অথচ, ঠিক সময়ে হাসপাতালে এসে পৌঁছনো যে কত কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এই বিশাল মহিলা কর্মী-বাহিনীর কাছে, সে খবর রয়ে যায় আড়ালে। নার্সিং অফিসাররা অধিকাংশই সন্তানের মা। আজ যৌথ পরিবারের অস্তিত্ব বিলুপ্তপ্রায়। সন্তানকে বাড়িতে অন্য কোনও প্রবীণ আত্মীয়ের কাছে রেখে আসার দিন আর নেই। সারাক্ষণের পরিচারিকা পাওয়াও কঠিন এবং খরচসাপেক্ষ। দিনে বা রাতে সন্তানকে বাড়িতে রেখে নিজের কাজের জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে এসে পৌঁছনো প্রায়শই একটা দুরূহ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তার উপর একক মা বা সিঙ্গল মাদার-এর সংখ্যা বাড়ছে সর্বত্র, নার্সরাও সেই সমাজচিত্রের বাইরে নন। কেউ হয়তো বিবাহের সম্পর্কের বাইরে রয়েছেন, আবার অনেকে কর্মসূত্রে রয়েছেন স্বামীর থেকে দূরে। অভিভাবকত্বের সব দায়িত্ব বইতে হচ্ছে কর্মব্যস্ত, একক তরুণীকে। এই মেয়েদের দৈনন্দিন জীবন কতখানি জটিল, তা আর বলার নয়।
চিন্তা করতে বসলে মনে হয়, এর একটা সমাধান আছে। সেটা হল ক্রেশ। আইনের নির্দেশও রয়েছে, যে কর্মক্ষেত্রে পঞ্চাশ জন বা তার বেশি কর্মী (পুরুষ ও মহিলা, সকলকে ধরে) কর্মরত, সেখানে ক্রেশ বাধ্যতামূলক। মাতৃত্বের সুবিধা আইন (১৯৬১), যা ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সংশোধন করেছে, সেখানেই এ কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া জাতীয় ক্রেশ নীতি (২০১৭) অনুসারে, শহরে কিংবা গ্রামে, বাবা-মায়ের বাসস্থানের কাছাকাছি ক্রেশ তৈরি করতে হবে।
কোনও হাসপাতালে কর্মরত কোনও নার্স কি দেখেছেন যে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, নার্সিং কর্তৃপক্ষ বা স্বাস্থ্য ভবনের আধিকারিকরা ক্রেশ-এর বিষয়ে আলোচনা, পরিকল্পনার জন্য এক সেকেন্ডও ব্যয় করেছেন? উত্তরটা জানা— না, কেউ দেখিনি। এটা যে আলোচনার একটা প্রসঙ্গ হতে পারে, তা-ই যেন কেউ ভাবতে পারেন না। অথচ, হাসপাতালে ক্রেশ-এর ব্যবস্থা থাকলে শিশুরা শারীরিক এবং মানসিক ভাবে সুস্থ থাকবে, তা নিশ্চিত করা অনেক সহজ। নার্স ছাড়াও হাসপাতালে কাজ করেন বহু মহিলা কর্মী— মহিলা চিকিৎসক থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মী, গ্রুপ ডি কর্মী ও অন্যরা। কর্মক্ষেত্রে সন্তান-পরিচর্যার একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা হলে এঁরা সকলেই নিজেদের কাজে আরও মনোযোগী হতে পারবেন। অনুপস্থিতির হার অনেকটা কমবে।
এই সুষ্ঠু ব্যবস্থার এতখানি প্রয়োজন থাকলেও বছরের পর বছর কেন এই প্রসঙ্গ প্রশাসন এড়িয়ে চলে, তার কারণ অজানা। শিশুদের দেখাশোনার সুব্যবস্থা না থাকার ফলে অনেক মেয়ে বাধ্য হন এমন কোনও ব্যবস্থায় রেখে আসতে, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবৈজ্ঞানিক, অপরিচ্ছন্ন। নার্স মেয়েরা এ কথা যতখানি বোঝেন, অত আর কে? সব বুঝেও তাঁরা বাধ্য হন, জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি রেখে আসতে এমন জায়গায়, যা শিশুর যোগ্য নয়। চাকরি ভাল করে করতে গেলে সন্তান অবহেলিত, সন্তানকে ঠিক মতো দেখতে গেলে চাকরি অবহেলিত, এই দোটানার মধ্যে দিন কাটান মেয়েরা।
সব পেশার ক্ষেত্রেই এটা সত্য— আদালত-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলকারখানা, সর্বত্র মেয়েরা কাজ করলেও কোথাও ক্রেশ চোখে পড়ে না। তবে হাসপাতালের ক্ষেত্রে প্রশ্নটি যেন একটি বিশেষ হয়ে দেখা দেয়। অন্য অনেক কর্মক্ষেত্রে শিশু-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে নানা সমস্যা হতে পারে, কিন্তু হাসপাতালে নবজাতক থেকে শুরু করে নানা বয়সের শিশুদের পরিচর্যার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েই রয়েছে। ক্রেশ চালানোর কাজে অবসরপ্রাপ্ত নার্সদের পাশে পাওয়া যায়। তাঁদের নির্দেশমতো কর্মীরা কাজ করলে শিশুদের পরিচর্যা যে খুবই ভাল হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা দেখি, হাসপাতালের নানা শ্রেণির কর্মী বিধিলঙ্ঘন করছেন কি না, তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন আধিকারিকরা। এমন নিয়মও জারি করেন যা পীড়িত করে বহু নার্সকে। অথচ, মহিলা কর্মীদের যা যা আইনি অধিকার আছে নার্স-সহ সমস্ত মহিলা কর্মচারী যাতে তার সুযোগ নিতে পারেন, সেই উদ্যোগ তাঁরা কতটা করেছেন? আইন অনুসারে ক্রেশ-এর ব্যবস্থা নেওয়া হোক প্রশাসনিক স্তরে, যাতে নিজের সন্তানকে নিরাপদ জেনে নার্সরাও রোগী পরিষেবার কাজে মন দিতে পারেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)