Advertisement
E-Paper

নানা ভাষা-সাহিত্যে গড়া জাতি

ভারতীয় ভাষাচর্চার মধ্য দিয়ে ভারতীয় সাহিত্যের ‘সমতট’ তৈরি করতে চেয়েছিলেন আশুতোষ, যেখানে দেশের শ্রেষ্ঠ সব মন এসে মিশবে।

মৃন্ময় প্রামাণিক

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:১২

উনিশ-বিশ শতকে ভারতে এমন অনেক চিন্তাবিদ এসেছেন, যাঁরা একমাত্রিক জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসাবে বহু-কে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। তেমনই এক জন হলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, বিদ্যায়তনিক কর্মী হিসাবে যাঁর বহু ভাবনা এখনও আমাদের চেতনার আড়ালেই রয়ে গিয়েছে।

১৩২২ ও ১৩২৬ বঙ্গাব্দে দু’টি বক্তৃতা দেন আশুতোষ— ‘জাতীয় সাহিত্যের উন্নতি’ এবং ‘ভারতীয় সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’। যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য লিখছেন, ১৮৯১-এর ২৪ জানুয়ারি সমাবর্তন বক্তৃতায় ভারতীয় ভাষাগুলিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার বিষয় হিসাবে গ্রহণের প্রস্তাব করেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়; ১ মার্চ এফ এ, বি এ এবং এম এ পাঠ্যসূচিতে ভারতীয় ভাষা গ্রহণের দাবি জানান আশুতোষ। চন্দ্রনাথ বসু এবং বঙ্কিমচন্দ্র সেই দাবি সমর্থন করলেও শেষাবধি তা গৃহীত হয়নি। ১৯১৯-এর ৩ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় ভাষা বিভাগ অনুমোদন করে ভারত সরকার। ১ জুন থেকে মূল ভাষা হিসাবে বাংলা পড়ানো শুরু হয়। ১৯২০-র ২৭ সেপ্টেম্বর গৃহীত হয় হিন্দি, ওড়িয়া ও মৈথিলী, ১৯২১-এর ১৫ সেপ্টেম্বর গুজরাতি, ১৯২৯-এ উর্দু, ১৯৩৮-এ অসমিয়া। বিভাগের নাম হয় আধুনিক ভারতীয় ভাষা। পাশাপাশি, সিংহলি-সহ ১১টি ভাষা বিকল্প হিসাবে গৃহীত হয়, মৌলিক ভাষা হিসাবে গৃহীত হয় পালি, প্রাকৃত ও ফারসি। প্রধান ভাষার সঙ্গে একটি বিকল্প ও দু’টি মৌলিক ভাষাও পড়তে হত। এই অভিনব ব্যবস্থায় গর্বিত ছিলেন আশুতোষ। বলতেন, এটা কোনও প্রাদেশিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তাই এখানে ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ শিক্ষকতা করেন। তাঁদের বিষয় যদিও সাহিত্য নয়।

ভারতীয় ভাষাচর্চার মধ্য দিয়ে ভারতীয় সাহিত্যের ‘সমতট’ তৈরি করতে চেয়েছিলেন আশুতোষ, যেখানে দেশের শ্রেষ্ঠ সব মন এসে মিশবে। এবং, এক ভাষা অন্যের উপর রাজত্ব করবে না। একাধিক ভাষায় শিক্ষিত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রজন্ম অনুবাদের মধ্য দিয়ে অন্য ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য আনবে বাংলায়, বাংলা হয়ে উঠবে জাতীয় সাহিত্য। মরাঠি, তামিল, গুজরাতি, হিন্দি সব ভাষাতেই অন্য ভাষার সাহিত্য অনূদিত হয়ে সেখানেও জাতীয় সাহিত্য তৈরি হবে। এই জাতীয় সাহিত্য একই জাতীয়তাবোধ থেকে জাত হলেও তা বহু, বিচিত্র ও স্বতন্ত্র। তাঁর ভাবনায়, এই জাতীয় সাহিত্যই হবে বাঙালির ‘আত্মসাহিত্য’। তাঁর মতে, ইংরেজি ‘ওয়ার্ল্ড ল্যাঙ্গোয়েজ’— সে ভাষার মধ্য দিয়ে একাধিক সভ্যতার তুলনামূলক পাঠ প্রস্তুত হবে। আবার, ইংরেজির অধ্যাপক ও বিদ্যার্থীদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্য অনূদিত হয়ে তৈরি করবে বিশ্বসাহিত্য। আশুতোষের জাতীয় সাহিত্য আসলে এমন এক পরিসর ও পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সমস্ত ভারতীয় নিজেকে ও অপরকে চিনতে-জানতে পারবে। এই জাতি বহুস্বরিক।

৩১ অগস্ট ১৯১৮ এবং ২৪ মার্চ ১৯২৩ স্নাতকোত্তর পাঠ সমিতির সভা এবং সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভারতীয় ভাষা-সাহিত্যে তুলনামূলক চর্চার কথা উল্লেখ করেন আশুতোষ। এ দেশে তুলনামূলক সাহিত্যচর্চা নিয়ে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সফল চিন্তক তিনিই। ১৯০৭ সালে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের বক্তৃতায় তুলনামূলক সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্য হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরে, আশুতোষের প্রয়াসেরও প্রশংসা করেছিলেন। এক ভাষার উপর অন্যের আধিপত্য দূর করতে গোড়াতেই ইংরেজি ও হিন্দিকে ক্ষমতার ভাষা হিসাবে চেনার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন আশুতোষ। তিনি বলেছিলেন, “স্ব-স্ব ব্যক্তিত্ব বা বৈশিষ্ট্য না হারাইয়া, যাহার যাহা আছে, তাহা বজায় রাখিয়া কি করিয়া ভারতে এক ভাব, এক চিন্তা, এক সাহিত্যের সৃষ্টি করা যাইতে পারে— কি করিয়া সমগ্র ভারতে এক জাতীয় সাহিত্যের নির্মাণ করা যাইতে পারে, তাহাই আমার বক্তব্য। বাঙ্গালী বাঙ্গালীই থাকিবে, পাঞ্জাবী পাঞ্জাবীই থাকিবে, অথচ তাহারা পরস্পরের যাহা কিছু উত্তম, যাহা কিছু সুন্দর, নির্মল, মনোহর, তাহা নিজের নিজের ভাষায় ফুটাইয়া তুলিয়া ক্রমে, ধীরে ধীরে এক হইতে শিখিবে, ইহাই আমার বক্তব্য।” এই এক হওয়া স্বাতন্ত্র্য হারানো নয়, জাতিদাঙ্গা থেকে মুক্তির পথ। প্রত্যাখ্যানের যে ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদ আজ ভারতের বাস্তবতা, তা থেকে মুক্তির পথ কল্পনা করেছিলেন আশুতোষ। এই আদর্শেই ২০০৫ সালে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধীনে তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য পাঠ্যক্রম তৈরি হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৫ সালে তা বিভাগে রূপান্তরিত হয়। পাঠ্যসূচিতে আবশ্যিক হয় ভারতীয় ভাষাশিক্ষার কোর্স।

খেয়াল করব, কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু ইত্যাদি ভাষার প্রতিষ্ঠান তৈরি হলেও অন্যান্য আধুনিক ভারতীয় ভাষাশিক্ষার জন্য ছিল একমাত্র ভারতীয় ভাষা সংস্থান। গত সাত বছরে সেখানেও পড়ুয়াদের বৃত্তি বন্ধ হয়েছে, তাদের তরফে আর্থিক সহায়তা কমানো হয়েছে নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। উর্দু, সিন্ধি প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্বও কমেছে। অন্য দিকে, নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে ভারতীয় ভাষা-সাহিত্যের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। অতএব হিসাব কষতেই হবে, গত ৭৫ বছরে কতগুলো ভাষার মৃত্যু ঘটেছে; কত ভাষা, সাহিত্য মৃত্যুপথযাত্রী। কেননা, স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’-এ যার যার মাতৃভাষা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পাক, দিকে দিকে ভারতীয় ভাষা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হোক, প্রান্তিক ভাষা চর্চিত হোক— এটুকু চাওয়া যেতেই পারে। বলা যেতে পারে যে, ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দি, মরাঠির সঙ্গে পড়ানো হোক লেপচা, টুলু, কোডাভা, সাদরি, রাজবংশী। শতবর্ষ আগে এই সেপ্টেম্বর মাসেই একাধিক নতুন ভাষা স্নাতকোত্তর স্তরে অন্তর্ভুক্ত করেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাসই বলে দেয়, একশো বছরে এগিয়েছি না পিছিয়েছি, কোথায় এসেছি।

তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

Ashutosh Mukherjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy