বানু মুস্তাক, অনুবাদ সাহিত্যে ‘আন্তর্জাতিক বুকার’-জয়ী দ্বিতীয় ভারতীয় নারী, বলেছেন, ‘কোনও গল্পই আঞ্চলিক নয়’। তাঁর গাঁয়ের বটগাছের তলায় যে গল্পের শুরু, তা ছায়াবিস্তার করেছে বহু দূর। তিনি নির্দিষ্ট সমাজের মেয়েদের কথা লিখতে চেয়েছেন, এমন নয়। নিজ সমাজে যা দেখেছেন, তাকেই স্বাভাবিক ভাবে ধারণ করেছে তাঁর লেখনী। কিন্তু তিনি মনে করেন, নানা দেশের, নানা ধর্মের, বর্ণের মেয়ের ব্যথার মধ্যে এক রকম সাম্য আছে। সেই সাযুজ্যই বিশ্বজনীন ভগিনিত্ব রচনা করে। হয়তো যন্ত্রণার উৎসগুলি বহিরঙ্গে নানা রকম, কিন্তু ভিতরের ক্ষত একই। প্রতিরোধের ভাষাও এক।
কন্নড় কথকতার ঐতিহ্য ধমনীতে বহন করার ফলে, আন্তর্জাতিক বুকার-জয়ী হার্ট ল্যাম্প বইটিতে তাঁর কথনে এসেছে পা-ছড়িয়ে বসে গল্প বলার ঢং। এলেন সিক্সু বলেছিলেন, মেয়েদের তথাকথিত ‘মেয়েলি গল্প’ বলার ভাষা ও ধরনও অন্য হবে। এই কি সেই ধরন? বানু কথা বলেন ‘দখিনি’ ভাষায়। উর্দু যেমন উত্তর ভারতে হিন্দু-মুসলমান সাংস্কৃতিক সমন্বয়ে উদ্ভূত ভাষা, দক্ষিণে তেমনই ‘দখিনি’। আবার, লেখাপড়া আর দফতরি কাজকর্ম তাঁকে করতে হয়েছে কন্নড়ে। তদুপরি তাঁর লেখায় যখন তখন ঢুকে পড়ে আরবি শব্দ, লব্জ, ছড়াও। কখনও তিনি কোরানের উদাহরণ টানেন, কখনও রামায়ণ মহাভারতের। তাঁর টেক্সট নিজেই তাই বহুভাষিক, বহুসাংস্কৃতিক হয়ে ওঠে। আবার, ভারতবর্ষ নামক বহুমাত্রিকতার পরিধি যে আসলে বিন্ধ্য পেরিয়ে বহু দূর বিস্তৃত, হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান দিয়ে যে তার নাগাল পাওয়া যায় না, সে কথা স্পষ্ট ঘোষণা করে বানু মুস্তাক-বর্ণিত মানবীদের ছোট-ছোট ভাঙাগড়ার আখ্যানগুলি। তাঁর আখ্যান হয়ে ওঠে এক খণ্ড ভারতবর্ষ, যেমন ভারত শুধু নারীর চোখই দেখে।
প্রথম গল্পের নামই যেমন ‘শায়েস্তা মহলের পাথর’। অচিরেই নামকরণের চোরাগোপ্তা ব্যঙ্গ মনে করিয়ে দেয় তাজমহলকে। শায়েস্তার বরের প্রেমস্তুতিময় বাক্যজাল আর শায়েস্তা মারা যাওয়ার পর চটজলদি পুনর্বিবাহ ইঙ্গিত দেয়, পুরুষালি কাব্যময় প্রেমে আর বাস্তবে যোজন ফারাক। দ্বিতীয় আর তৃতীয় গল্প, যথাক্রমে ‘অগ্নিবর্ষা’ ও ‘কালো গোখরো’, ধর্মগ্রন্থ থেকে ধার করেছে অশুভর রূপকদের। ‘অগ্নিবর্ষা’য় মুসলমান নারীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি আসে। ‘কালো গোখরো’ গল্পটি শুরুই হয় মুত্তাওয়ালির (ওয়াকফ-প্রধান) বৌয়ের সন্তাননিরোধক অপারেশন করার ইচ্ছাপ্রকাশ দিয়ে। ও দিকে, একাধিক কন্যাসন্তানের জননী আশরফ পরিত্যক্ত হয়েছে তার বরের দ্বারা। মসজিদে সে এসেছে বিচার চাইতে। কিন্তু তার স্বামীর সঙ্গে মুত্তাওয়ালির আগেই বোঝাপড়া হয়ে গেছে। মসজিদে এমন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মেয়েদের ঢোকা মানা। কিন্তু বানু বর্ণনা দেন: ‘রাতে যখন বরেরা ঘুমিয়ে পড়েছে বা টিভি দেখছে, বৌরা তখন গৃহকাজের ফাঁকে দেওয়ালের টিকটিকির মতো মসজিদের প্রাচীরে গোড়ালি উঁচু করে উঁকি দিচ্ছে, কান পাতছে।’ সবাই জানতে চায়, আশরফ আর তার মেয়েদের কী হবে? ‘অশুভ সেই সরীসৃপ’দের ভয়ে মুত্তাওয়ালি সরাসরি ঘাড়ধাক্কা দিতে পারছেন না আশরফকে। নীরব ভগিনিত্বের প্রতিরোধ তাঁর দোর্দণ্ডপ্রতাপকে প্রতিহত করছে। হঠাৎ বরের ধাক্কায় আশরফের কোলের কন্যাশিশুটি মারা যায় হাত থেকে পড়ে। পাড়ার মেয়েরা তখনও চিৎকৃত প্রতিবাদ করতে পারে না। কিন্তু তাদের চোখের ঘৃণা, বিদ্রুপ মুত্তাওয়ালির মাথা হেঁট করে দেয়। আর সপাট চড়টি খায় সে নিজের বাড়িতে। তার সন্তানদের মা কোলের শিশুদের নামিয়ে রেখে মুখের উপর বলে, ‘বাচ্চাদের দেখাশোনা করো বাড়ি বসে। চললাম আমি মায়ের সঙ্গে অপারেশন করাতে।’
‘হৃদয় দীপ’ গল্পে মেয়েটির জন্মঘর এখন পর হয়েছে। সে মেয়েকে দাদারা বহুগামী স্বামীর বাড়িতে ফেরত রেখে আসে। সেই মেয়ে যখন গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেশলাই জ্বালাতে যাচ্ছে, তখন মনে পড়া অস্বাভাবিক নয় যে, বানুর নিজের দাম্পত্য সুখের হলেও, শুরুর দিকে শ্বশুরবাড়িতে বোরখা পরতে বাধ্য করায় তিনিও গায়ে আগুন লাগাতে গিয়েছিলেন। ‘শায়েস্তা মহল...’ থেকে ‘হৃদয় দীপ’, সব গল্পেই দেখা যায়, জ্যেষ্ঠা মেয়েরা মায়ের সহচরী, সমমর্মী, ভগিনী যেন। রক্ষণশীল পিতৃতান্ত্রিক গার্হস্থেও ভগিনিত্বের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন বানু। ‘এক টুকরো স্বর্গ’ গল্পে বৃদ্ধা বি-দাদি জীর্ণ একটা ‘জা-নামাজ’ (নামাজ পড়ার মাদুর) নষ্ট হওয়ায় মুহ্যমান। বালিকাবেলায় তাঁর স্বামীর মৃত্যু ঘটেছিল যৌনমিলনেরও আগে। কিন্তু সে পুরুষ দুষ্টুমি করে এক সন্ধেয় জুঁই ফুল ছড়িয়ে দিয়েছিল নবোঢ়ার জা-নামাজ-এ, তার নামাজ পড়ার কালে। সেই জুঁইয়ের সুবাসই তাঁর জন্নত। আবার ‘কাফন’ গল্পে নারীর সব অপ্রাপ্তি পুঞ্জীভূত হয়ে একটি স্বপ্নবস্তুর দিকে ধায়: তার ‘কাফন’টি যেন হয় মক্কা থেকে আনা, জমজমের পানিতে স্নাত।
‘উঁচু হিলের জুতো’-য় পুরুষটির ফ্যান্টাসিতে কল্পনারীর হিলজুতো পায়ের ছন্দোময় চলন। তাই সে তার রুগ্ণ গর্ভবতী স্ত্রীর পায়ে বেঢপ হিল জুতে দেয়। সে জুতো যখন ছিঁড়ে ফেলে মেয়ে, তখন ‘যেন উল্কারা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দিগ্দিগন্তে’, লেখক বলেন। ব্যক্তির মুক্তিও কি এক মহাজাগতিক আশ্চর্য ঘটনা নয়? বইয়ের শেষ গল্পটির নাম ‘এক বার নারী হোয়ো, হে ঈশ্বর!’ সেই একই আকুতি, ‘বনমালী, তুমি পরজনমে হোয়ো রাধা।’
বিংশ শতকের সত্তর আর আশির দশকে বান্দায়া সাহিত্য আন্দোলন থেকে উঠে আসা আখ্যানকার বানু। সে সময়ে উচ্চবর্ণ, উচ্চশ্রেণির পুরুষ লেখকদের একবগ্গা বিষয় আর সংস্কৃত-ঘেঁষা ভাষায় রচনার বিপ্রতীপে জেগে উঠেছিলেন নারী-দলিত-মুসলমান লেখকেরা। তাঁদেরই এক জন বানু মুস্তাক। লিঙ্গগত আর ধর্মগত— দ্বিবিধ প্রান্তিকতায় জারিত হয়েছে বানুর স্বর। যন্ত্রণার সলতে পাকিয়ে, অশ্রুর তেলে, ব্যথার প্রদীপ জ্বালতে পারে এমনই স্বর। তারই আলোয় প্রান্তিকের প্রতিরোধের পথচলা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)