E-Paper

আবার এক বঙ্গভঙ্গ?

রোহিঙ্গাদের মতো হতভাগ্য জাতি কমই আছে। তাঁরা বাংলাভাষী নন। তবু স্বদেশ মায়ানমারে তাঁদের ‘বাঙালি’ তকমা দিয়ে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দেওয়া হয়, আবার ভারতে ‘রোহিঙ্গা’ তকমা দিয়ে।

সুকান্ত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২৫ ০৫:২৭

হিন্দির পর ভারতে সবচেয়ে বেশি লোকের মাতৃভাষা বাংলা। ভারতের এক মুখ্যমন্ত্রী তবু বললেন, জনগণনায় বাংলাকেকেউ মাতৃভাষা ঘোষণা করলে ধরা হবে সে বিদেশি। তাঁর রাজ্যের একটি অংশে ৮০ শতাংশ বাসিন্দা বাংলাভাষী, বাকি রাজ্যেও ২২ শতাংশ। দিল্লির এক পুলিশকর্তা তো খোলাখুলি ‘বাংলাদেশি ভাষা’র উল্লেখ করেছেন, সমর্থনে অমিত মালবীয় বলেছেন বাংলা কোনও সংহত ভাষাই নয়।

বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি যে রব উঠেছে, তার ভিত্তি অবশ্যই তথ্য বা যুক্তি নয়। পশ্চিমবঙ্গে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর যে সংখ্যা চাউর হচ্ছে, কিছু হিসাবে দুনিয়ায় অত রোহিঙ্গা নেই। রোহিঙ্গাদের মতো হতভাগ্য জাতি কমই আছে। তাঁরা বাংলাভাষী নন। তবু স্বদেশ মায়ানমারে তাঁদের ‘বাঙালি’ তকমা দিয়ে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দেওয়া হয়, আবার ভারতে ‘রোহিঙ্গা’ তকমা দিয়ে। তবে ভারতে বাঙালিরাই যে বাঙালি বলে বিপদে পড়বেন, তা এত দিন হিসাবে ছিল না।

ভারতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী নিশ্চয় আছে; তবে কত কেউ জানে না, বিভিন্ন আন্দাজে ৩০ লাখ থেকে ২ কোটি। ফলে যে কোনও মনগড়া সংখ্যা আওড়ে বাকি ভারতীয়দের খেপিয়ে তোলা যায়, বঙ্গভাষীদের নিপীড়ন করা যায়। যে সব রাজ্যে ধরপাকড় চলছে, তাদের কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট জানাচ্ছেন না কত অনুপ্রবেশকারী শনাক্ত হয়েছে। দু’-একটি খুচরো সংখ্যা তাও ইঙ্গিতবহ। ওড়িশার ঝাড়সুগুদায় ৪৪৭ জন বঙ্গভাষী আটক হয়েছিলেন। ৪০৩ জন কিছু দিনে ছাড়া পান। বাকিদের তদন্ত তখনও চলছে, সম্ভবত অধিকাংশই ভারতীয় নাগরিক প্রমাণিত হবেন বা হয়েছেন। হরিয়ানার গুরুগ্রামে শয়ে শয়ে বঙ্গভাষী আটক হয়েছেন; জুলাইয়ের শেষ অবধি বাংলাদেশি পাওয়া গেছে মাত্র ১০ জন।

আটকের সাফাই গাইতে ভাষার চমকপ্রদ কারিকুরি চলছে। হতভাগ্য ব্যক্তিদের ‘অ্যারেস্ট’ নয়, ‘ডিটেন’ করা হয়েছে; তাও নয়, ‘হোল্ড’ করা হয়েছে কেবল। মোদ্দা কথা, এঁদের স্বগৃহ বা কর্মস্থল থেকে তুলে এনে দিনের পর দিন, হয়তো কয়েক সপ্তাহ এমনকি মাসাধিক কাল বন্দি রাখা হচ্ছে, রোজগার বন্ধ হচ্ছে। তাঁদের মানসিক বিপর্যয় অবশ্যই সীমাহীন; শারীরিক অত্যাচার, অপমান ও অর্ধাহারের অভিযোগ প্রায় সর্বত্র। মারের চোটে হাড় ভেঙেছে কারও বা। কেউ বাসস্থান থেকে উৎখাত হচ্ছেন, আতঙ্কে পালাচ্ছেন আরও শতগুণ। প্রায়ই এমনটা হচ্ছে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, এমনকি পাসপোর্ট বা জমির দলিল দেখানো সত্ত্বেও।

বিবরণে অতিরঞ্জন এবং মিথ্যা থাকতেই পারে। তবু দেশ জুড়ে— অন্তত বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে— বঙ্গভাষীরা ব্যাপক হারে উৎপীড়িত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, এটা মর্মান্তিক সত্য। চরম পরিতাপের বিষয়, সেই দলের বঙ্গীয় সদস্যেরা বিপন্ন স্বরাজ্যবাসীর পাশে দাঁড়িয়ে একটি সহানুভূতির বাক্য উচ্চারণ করেননি, প্রতিকারের দাবি তো দূরের কথা। বরং যে-হেতু বিপক্ষ দলগুলি স্বভাবতই বিরোধিতার এই সুবর্ণ সুযোগ লুফে নিয়েছে, এঁরা এক মুখে অত্যাচারীর পক্ষেই সওয়াল করে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে দুষছেন পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে। সে প্রসঙ্গ অন্যত্র জরুরি হতে পারে, এখানে অবান্তর। কারণ যা-ই হোক, প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের অধিকার দেশের যে কোনও প্রান্তে বসবাস ও জীবিকা অর্জনের।

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিকদের জন্য তিনি রাজ্যেই অর্থসংস্থান করবেন। কোথা থেকে তিনিই জানেন। তাঁর সদিচ্ছা ধন্য হোক, কিন্তু আসল সমস্যা তাতে মিটবে না। আসলে দরকার, দেশের সর্বত্র বাঙালির বাস, জীবিকা ও স্বাধীন বিচরণের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা; অতএব পরিযায়ীদের বরং বলা, ‘তোমরা ফিরে যাও যে সব রাজ্যে কাজ করতে, কেউ তোমাদের কেশাগ্র স্পর্শ করলে আমরা আছি’। বাগ্মিতার স্তরে কথাটা বলা সহজ, সরকারি বা আইনি স্তরে কী করে কার্যকর করা যায় সেটাই দেখার।

মূল প্রশ্ন: নথি থাকা সত্ত্বেও এত লোকে হেনস্থা হচ্ছেন কেন? অন্য কোনও রাজ্যবাসী বা ভাষাভাষী তো হচ্ছেন না। ওড়িশা বা হরিয়ানার দৃষ্টান্তগুলি দেখাচ্ছে, সন্দেহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অমূলক। সেই রাজ্যের পুলিশ তবে চরম অদক্ষ, নয়তো আসল প্রেরণা বাঙালিমাত্রের প্রতি সন্দেহ বা বিদ্বেষ।

একটা অপ্রিয় প্রসঙ্গ না তুললেই নয়। চরম লজ্জা ও পরিতাপের বিষয়, আমরা ভারতীয়রা সব সহনাগরিককে এক চোখে দেখি না, সমান নাগরিক মর্যাদা দিই না। এমন ঘটে বিভিন্ন অন্ত্যজ শ্রেণির ক্ষেত্রে; সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে (আজকের ভারতে যা উৎকট পর্যায়ে পৌঁছেছে); সেই সঙ্গে কিছু বিশেষ অঞ্চলের অধিবাসীদের ক্ষেত্রে। জাতীয় মানসের এক কোণে এই বেয়াড়া বদ্ধমূল ধারণা যে, কাশ্মীর বা উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগরিকরা যেন একটু কম মাত্রায় ভারতীয়। অনেকে ভাবে এঁরা সকলে ছদ্মবেশী পাকিস্তানি বা চিনা; কিন্তু একটা অবচেতন ভিন্নতাবোধ আমাদের এই সম্মাননীয় সহনাগরিকদের ভাবমূর্তিতে ছায়াপাত করে।

আশঙ্কা হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে একাকার করে ভারতীয় বাঙালিদের উপর একই ভাবে অপরত্ব আরোপের চেষ্টা চলছে। এমনিতেই বাকি ভারতের থেকে আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান খানিক আলাদা ভাবে দেখা হয়। কিছু দিন যাবৎ সেটা স্থূল বঞ্চনা আর ধরপাকড়ের পর্যায়ে চলে গেছে। কর্নাটকে যেমন আগের সরকারের আমলে অন্য অনেকের মতো বর্ধমানবাসী এক দম্পতি তাঁদের শিশুসন্তান-সহ দশ মাস জেলবন্দি ছিলেন। এখন তো এই ফল্গুধারা প্রবল ও বেআব্রু।

বিপদটা কত দূর, তা একটা অশনি সঙ্কেত থেকে স্পষ্ট। সঙ্কেত কেন, যাঁরা এই অনাচারের বলি, তাঁদের মাথায় বাজ ভাঙতে কিছু বাকি নেই। বাংলাদেশি সন্দেহে কিছু ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে চালান করা হয়েছে। অনুসন্ধান, আইন-আদালত, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ইত্যাদি সব বালাই এড়িয়ে রাতের অন্ধকারে দুই সীমান্তের মধ্যবর্তী ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ ঠেলে দিয়ে। কত খাঁটি ভারতীয় নাগরিক এই ভাবে রাষ্ট্রচ্যুত হয়েছেন জানার উপায় নেই। খুব সম্প্রতি হয়েছেন এক শিশু-সহ অন্তত দশ জন, দেশে ফিরেছেন বহু টানাপড়েন হয়রানির পর। ফিরেছেন বলেই ব্যাপারটা জানা গেল, নইলে এঁরা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতেন।

এই ‘পুশব্যাক’ আদৌ আইনসিদ্ধ কি না, আশা করি আইনজ্ঞেরা তা দ্ব্যর্থহীন ভাবে দেশবাসীকে জানাবেন; কারণ সদর্পে সংঘটিত হলেও এর হাড়হিম বার্তা আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছে। আজকের বিশ্বে মানুষের পরিচিতি ও অস্তিত্ব সম্পূর্ণ ভাবে কোনও রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে। আমাদের সব অধিকার সব প্রাপ্তি সেই সূত্রে। স্টেটলেস বা রাষ্ট্রহীন হওয়া মানে অস্তিত্বের সব অবলম্বন হারানো, জর্জ অরওয়েলের ভাষায় ‘আনপার্সন’ বনে যাওয়া।

বিনা তোয়াক্কায় যে নাগরিককে এই সর্বনাশের মুখে নিক্ষেপ করা হল, রাষ্ট্র তাঁর প্রতি চরম অপরাধী। বহু বিলম্বে আধমরা অবস্থায় ক্ষমাঘেন্না করে দেশে ফেরালে সেই অপরাধ ক্ষালন হয় না। প্রশ্ন ওঠে ক্ষতিপূরণের। তারও আগে রাষ্ট্রের তরফে অনুতাপ ও আশ্বাসের স্পষ্ট বার্তা।

রাষ্ট্র কিন্তু নির্বিকার, যেমন নির্বিকার সমাজের সুবিধাভোগী ‘সচেতন’ শ্রেণি। তার কারণ আমাদের মজ্জাগত বিশ্বাস, এ সব অঘটন ঘটে ‘ওদের’, ‘আমাদের’ নয়। আমাদের আর্থিক ও শ্রেণিগত বর্ম যথেষ্ট পুরু, যেমন পুরু চোখের চামড়া। আমরা সর্বভারতীয় আখড়ায় নেমে বাঙালিয়ানায় আপস করতে জানি, আমাদের মারে কে?

মারা না পড়লেও অন্য নানা বিপত্তি কিন্তু ওত পেতে আছে। ভিন রাজ্যে রাস্তাঘাট দোকানবাজারে তুচ্ছ বচসা সঙ্গিন হয়ে উঠতে পারে, বিশেষত পুলিশ বা স্থানীয় রাজনৈতিক বাহিনী জড়িয়ে পড়লে। বস্তিচ্যুত কর্মহারা বাঙালি যে ঝকঝকে বহুতল ঝাঁট দিতেন, ‘আমরা’ সেখানে মহার্ঘ ফ্ল্যাট ভাড়া নাও পেতে পারি, এমনকি সেই মুলুকে চাকরিও না জুটতে পারে। খুচরো ঠিকাদার বা বস্তি-মালিকের মতো কর্পোরেট নিয়োগকর্তা বা অভিজাত আবাসন-সচিব একই অজুহাত দেখাবেন— বাঙালি পোষণের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা ফ্যাসাদে পড়তে চান না।

আজকের ভারতে বহু নিশ্চিত অধিকার, ন্যায্য আশ্বাস, অভ্যস্ত ব্যবস্থা বিষঝড়ে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে। অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকবে না। বরং নিম্নচাপ যাতে সৃষ্টি না হয়, সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে সেই চেষ্টা করা যাক।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali languages

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy