Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
নেতাদের লোভ এবং অহমিকা বিরোধী জোটের পথে বড় কাঁটা
BJP

শাসকের পোয়া বারো

মহারাষ্ট্রে শাসক শিবসেনার মধ্যে ভাঙন ধরানোর কৌশল থেকে সম্প্রতি উপনির্বাচনগুলিতে বিজেপির একচেটিয়া জয় তৎপর্যপূর্ণ।

প্রচেষ্টা: এনসিপি নেতা শরদ পওয়ার এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাপচারিতা, দিল্লি, ১৪ জুন।

প্রচেষ্টা: এনসিপি নেতা শরদ পওয়ার এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাপচারিতা, দিল্লি, ১৪ জুন। ছবি: পিটিআই

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২২ ০৫:০৬
Share: Save:

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে বাজি ধরতে ঠিক এই মুহূর্তে কত জন উৎসাহী? সমীক্ষা না করেও তার উত্তর বলে দেওয়া হয়তো খুব কঠিন হবে না। তার উপর বিরোধীদের দুয়ারে নানা ভাবে ‘ধাক্কা’ পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে আপাতত বিজেপি যে খানিকটা সফল, সেটাও আজ না-মানার কারণ নেই।

দেশ জুড়ে বিরোধীদের ডেরায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের তৎপরতা তার একটি উপকরণ। পাশাপাশি মহারাষ্ট্রে শাসক শিবসেনার মধ্যে ভাঙন ধরানোর কৌশল থেকে সম্প্রতি উপনির্বাচনগুলিতে বিজেপির একচেটিয়া জয় ইত্যাদিও তৎপর্যপূর্ণ। কারণ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঠিক আগে বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে এগুলির সরাসরি প্রভাব পড়বে। যেমন, শিবসেনার ভোট ভেঙে তার একাংশ এনডিএ প্রার্থীর পক্ষে চলে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত।

তবু শাসক-প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মু এবং সম্মিলিত বিরোধী পক্ষের যশবন্ত সিন্‌হার লড়াইকে শুধুই জয়-পরাজয়ের হিসেবে ধরলে খণ্ড-ব্যাখ্যা হবে। এটা আগামী দিনের রাজনীতির একটি রোডম্যাপও বটে। সেই জন্যই এ বারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের চরিত্র একটু আলাদা।

ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিরোধী শিবিরের প্রার্থী স্থির করার উদ্যোগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগ্রণী ভূমিকা সবাই দেখেছেন। তিনিই সর্বাগ্রে দিল্লিতে বিরোধী নেতাদের বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান এবং তাতে আমন্ত্রিত সবাই যোগ দেন। কংগ্রেস এবং সিপিএম বৈঠকের ঔপচারিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও বিরোধী ঐক্যের ‘স্বার্থ’-এ সাড়া দিয়েছিল। ফলে সামগ্রিক পর্যবেক্ষণে মমতা-অনুরাগীরা ওই বৈঠককে তৃণমূল নেত্রীর ‘সাফল্য’ বলে ধরে নিতেই পারেন।

যদিও এটা ঘটনা যে, বৈঠকে কংগ্রেস-সহ কোনও দল কোনও নাম প্রস্তাব করেনি। করতে চায়নি। তাই সবটাই ঘুরপথে কার্যত এসে পড়ল মমতার ঘাড়ে। আবার তাঁর দিক থেকে পর পর যে তিনটি নাম সামনে এল, দেখা গেল তাঁরা কেউই প্রার্থী হতে রাজি নন। অতএব ‘ঐক্য’ ভাবনা ছাপিয়ে অচিরে চর্চা শুরু হল, মমতার ‘মুখ’ ডুবেছে!

তার পরেও কিন্তু অন্য কোনও দলের থেকে অন্য কোনও নাম আলোচনায় এল না। বরং শরদ পওয়ারের ডাকা দ্বিতীয় বৈঠকে যে নামটি সাব্যস্ত হল, তিনি কাগজে-কলমে মমতারই দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি।

যশবন্ত সিন্‌হা জিতুন বা হারুন, তাঁর তৃণমূল থেকে লড়তে আসার পরিচয়টি থেকেই যাবে। শুধু তা-ই নয়, যশবন্তকে দলীয় পদ ছেড়ে রাষ্ট্রপতি-ভোটে লড়ার ‘আনুষ্ঠানিক’ অনুমতি মমতাকেই দিতে হয়েছে। যদিও এই নামটির উত্থাপক তৃণমূল নয়।

এখন প্রশ্ন হল, বিরোধী শিবিরে বাকি দলগুলির কেউ অন্য কোনও প্রার্থীর নাম আলোচনায় পেশ করলেন না কেন? তাঁদের কারও কাছে কি প্রার্থী করার মতো কোনও নাম সত্যিই ছিল না? কেউ এর পিছনে ‘বাঘ মারতে শত্রু পাঠানো’র ছক খুঁজে পাবেন কি না, জানা নেই। তবে সব মিলিয়ে কোথাও একটা সংশয়ের কাঁটা খচখচ করে। এ যেন গিলছে, কিন্তু খাচ্ছে না!

সাধারণত কে রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন, তার আভাস ভোটের আগে পাওয়া যায়। সে দিক থেকে বিজেপি-নিয়ন্ত্রিত এনডিএ জোটের অঙ্ক এখনও পর্যন্ত তুলনায় পোক্ত বলেই মনে হয়। তবু ভোট হল অনিশ্চয়তার খেলা।

ভুললে চলবে না, ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৎকালীন শাসক কংগ্রেস-জোটের প্রার্থী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাক্সে বিজেপি-জোটেরও কিছু ভোট ভেঙে চলে এসেছিল বলে বোঝা যায়। তাঁর বিরুদ্ধে এনডিএ প্রার্থী ছিলেন প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা পূর্ণ সাংমা।

১৯৬৯ সালে নিজের দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে ‘নির্দল’-কে জেতাতে ইন্দিরা গান্ধী যা করেছিলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ইতিহাসে অবশ্যই তার নজির মেলা ভার। কংগ্রেসে ভাঙনরেখা তখন স্পষ্ট। দলীয় নেতৃত্ব নীলম সঞ্জীব রেড্ডিকে প্রার্থী করলেও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা তা মেনে নেননি। কংগ্রেস সভাপতি নিজলিঙ্গাপ্পার ফতোয়া অগ্রাহ্য করে তিনি ভোটের মাত্র চার দিন আগে ভি ভি গিরিকে সমর্থন করার লক্ষ্যে ‘বিবেক ভোট’-এর ডাক দেন। সেই আহ্বানেই গিরি জিতে যান।

কংগ্রেসের অধিকাংশ ভোট গিয়েছিল গিরির পক্ষে। সে বার ছিল ত্রিমুখী লড়াই। তখন বিজেপি গঠিত হয়নি। জনসঙ্ঘ, স্বতন্ত্র পার্টি ইত্যাদি মিলে প্রার্থী করেছিল সি ডি দেশমুখকে।

সুতরাং ‘চমক’ যদি কিছু হওয়ার থাকে, তা হলে যে কোনও দিকেই সেটা হতে পারে। সেই কারণে শাসক গোষ্ঠী বা বিরোধী শিবির কোন প্রার্থীর ক্ষেত্রে পাল্লা কী ভাবে ঝুঁকবে, আগাম বলা শক্ত। আবার কিছুই না হয়ে সরল অঙ্কের হিসাবে ভোট পড়াও খুবই সম্ভব। বেশির ভাগ সময় তো সেটাই হয়।

রাষ্ট্রপতি-প্রার্থী ‘সর্বসম্মত’ করার চেষ্টাও প্রচলিত। এ বার যেমন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ আগে বিরোধী নেতাদের ফোন করেছিলেন। শাসক গোষ্ঠীর প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মুর ফোন পেয়েছেন সনিয়া গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা। একই ভাবে সমর্থন চেয়ে যশবন্তের ফোন যাবে বিজেপি-সহ এনডিএ নেতাদের কাছেও। এ সবই নেহাত রুটিন।

কিন্তু আসল হল, এর পরে কী হবে? বিষয়টি মূলত বিরোধী-ঐক্যের নিরিখে বিচার করার। রাজনীতির কোনও জাদুতে যশবন্ত যদি জিতে যান, তা হলে তা অবশ্যই ’২৪-এর খেলায় নতুন মোড় আনতে পারবে। তখন তিনি তৃণমূল থেকে এলেন, না কি এই প্রাক্তন বিজেপি নেতাকে শরদ পওয়ারেরা ‘রাজি’ করিয়েছিলেন সে সব কূট তর্ক ভেসে যাবে। বিরোধীরা ‘বল’ পাবেন। বিজেপি কিছুটা ব্যাকফুটে থাকবে। এমনকি, আঞ্চলিক দলের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার যে দাবি মমতা সব সময় তোলেন, সেই পালে বাড়তি হাওয়া ওঠাও বিচিত্র নয়।

যদিও অভিজ্ঞরা অনেকেই যশবন্তের জয়ের সম্ভাবনাকে আপাতত কষ্টকল্পনা বলে মনে করছেন। বিরোধী-ঐক্য ধরে রাখার প্রকৃত চ্যালেঞ্জ ঠিক সেইখানে। কারণ যশবন্ত যদি না-ও জেতেন, তবু লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে ‘ঐক্য’-এর এই আবহে বিরোধীদের একত্র হওয়ার উদ্যোগটি জারি রাখা তাঁদের দিক থেকে জরুরি। এতে যদি ভাটা পড়ে, তা হলে মুশকিল। কিন্তু কে নেবেন সেই ভার? কার ডাকে কে আসবেন? কী ভাবে তৈরি হবে পরবর্তী পরিকল্পনা? উত্তর এখনও অধরা।

রাষ্ট্রপতি-নির্বাচন নিয়ে এ বার মমতা যখন প্রথম বৈঠক ডাকেন, কংগ্রেস ও সিপিএম তখন প্রশ্ন তুলেছিল। দু’জনেরই বক্তব্য ছিল, একতরফা বৈঠক ডেকে দেওয়া মমতার উচিত হয়নি। দ্বিতীয় বার শরদ পওয়ার যখন বৈঠক ডাকেন, তখন আবার প্রথম বৈঠকের কোনও উল্লেখই তাঁর চিঠিতে ছিল না। সেটাও মমতার মতো কয়েক জনের ‘ভাল’ লাগেনি। ঘটনাচক্রে শরদের ডাকা বৈঠকে উপস্থিতির সংখ্যাও ছিল কম। প্রার্থী অবশ্য ‘সর্বসম্মত’ করা গিয়েছে।

তবে লোকসভা ভোটের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী প্রার্থীর জেতা-হারার মধ্যে একটি রাজনৈতিক বার্তা থাকে। সরাসরি কোনও দলের আসন সংখ্যায় ক্ষতি-বৃদ্ধি হয় না। লোকসভা বা বিধানসভার ভোটে সেটা হয় বলেই সেখানে নির্বাচনী বোঝাপড়ার পদ্ধতি জটিল। বিভিন্ন রাজ্যে যে দলগুলি পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ে জমি আঁকড়ে রাখতে চায়, তাদের এক ঠাঁই করার প্রক্রিয়া সেই জন্য সর্বদা অনায়াস হয় না।

ইতিমধ্যেই কিছু ইঙ্গিত মিলছে। বাংলার কথা বাদই দিলাম। কেরলে শাসক সিপিএম চায়, রাহুল গান্ধী যেন এ বার ওখানে না লড়েন। কেন? তাদের যুক্তি, রাহুল লড়লে ‘চাপ’ হয়ে যাবে। তাই কংগ্রেস যেন ‘ছোট’ মাপের স্থানীয় কোনও প্রার্থী দেয়! জোট-নীতির এমন বিচিত্র সূত্র কেউ কোনও দিন শুনেছেন?

শেষ পর্যন্ত কোথায় কী দাঁড়াবে, এখনই বলার সময় নয়। কিন্তু নির্মম সত্য হল, লোভ এবং আত্মম্ভরিতা কিন্তু বিরোধী জোটের পথে কাঁটা বিছিয়েই চলেছে। এ জিনিস চলতে থাকলে বিরোধীদের ‘সৌজন্য’-এ শাসকের ‘পোয়া বারো’ আটকানো কঠিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Opposition Parties
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE