শেষ পাতে রাবড়ির মতোই বাজেট-ভাষণে মধ্যবিত্তের জন্য করছাড়ের সংবাদটি তুলে রেখেছিলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। প্রত্যক্ষ করের অংশটিতে এসে রীতিমতো রহস্য করে তিনি বললেন, “ব্যক্তিগত আয়ের উপরে করের বিষয়ে বলব একদম শেষে।” সংসদকক্ষে তখন গমগম করছে তাঁর দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাসি— অনুমোদনের, প্রত্যাশার। এই বাজেটে যে মধ্যবিত্তের লক্ষ্মীলাভ হতে চলেছে, এমন ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রী দিয়েই রেখেছিলেন।
বাজেটের আগেই তাই সমাজমাধ্যম ভেসে গিয়েছিল মধ্যবিত্তের প্রত্যাশা সংক্রান্ত মিম-এ। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে বাজেট-ভাষণ সম্পর্কে যাঁরা আগ্রহ দেখান, তাঁদের একটা বড় অংশই মধ্যবিত্ত। মলিবডেনাম বা মাছের খাবারের হাইড্রোলাইসেটে শুল্কের হারের খুঁটিনাটি তথ্যের খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো করেই তাঁরা বেছে নেন শুধুমাত্র নিজেদের জন্য করছাড়ের হিসাবটি। এ ছাড়া অর্থনীতির জটিল পরিভাষা আর সরকারের আয়-ব্যয়ের পরিসংখ্যানে তাঁদের আগ্রহ ক্ষীণ। রাস্তাঘাট, দোকান-বাজার, বা আত্মীয়দের জমায়েতে দেখেছি, মধ্যবিত্তের বেজায় অভিমান, “গরিবদের তোফার পর তোফা দিয়ে চলেছে সরকার, বড়লোকদের সঙ্গেও গোপন আঁতাঁত রয়েছে নেতা-মন্ত্রীদের, বানের জলে ভেসে এসেছি শুধু আমরা!”
মনে রাখতে হবে, আয়ের হিসাব অনুযায়ী মধ্যবিত্তের কিন্তু কোনও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। মোটামুটি ভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, তাঁরা দেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। অতিমারি-পরবর্তী সময়ে এই এক-তৃতীয়াংশ যে চাপে রয়েছে, সে কথা অনস্বীকার্য। লাগাতার মূল্যস্ফীতির ফলে তাঁরা খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন। এই ব্যয়সঙ্কোচন সরাসরি প্রভাব ফেলেছে দেশের অর্থনীতিতে, বিশেষত ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে। চাহিদার অভাব চিন্তায় ফেলেছে সরকারকে, কারণ চাহিদা কমলে জিডিপির বৃদ্ধির হারও কমে। বস্তুত, জিডিপির বৃদ্ধি আশানুরূপ না হওয়ায় তা নিয়ে অন্যান্য বারের তুলনায় এ বার ঢক্কানিনাদও কম। শেষ এক বছরে শহরাঞ্চলে কমেছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা, পাশাপাশি বেড়েছে ধনী পরিবারের সংখ্যা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের মতে মধ্যবিত্তের ক্ষোভ প্রতিফলিত হয়েছে ভোটবাক্সে, বিজেপির সমর্থন কমেছে।
কিন্তু মধ্যবিত্ত মাত্রেই কি আয়করদাতা? যাঁরা ধনী বা গরিব নন, তাঁরাই যদি মধ্যবিত্ত হন, তবে এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই নেতিবাচক। জনসংখ্যার ৩৩% মধ্যবিত্ত হলে, আয়করদাতার সংখ্যা তিন শতাংশেরও নীচে। টিভি চ্যানেলে কর-ছাড় সম্পর্কে যাঁরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ওই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশটির। ভুললে চলবে না, ইন্টারজেনারেশনাল ইনইকোয়ালিটি বা আন্তঃপ্রজন্ম অসাম্য এ দেশে মাত্রাছাড়া। বিভিন্ন সমীক্ষা দেখিয়েছে, শ্রেণি এবং জাতির বিভাজন দেশে এমনই সুপ্রোথিত যে, এখানে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পেশাগত উত্তরণের সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। এহ বাহ্য! আয়করদাতা মধ্যবিত্তের ‘প্রিভিলেজ’ বা জন্মগত সুবিধার কথা আর যে-ই স্বীকার করুক, তাঁরা নিজেরা করেন না। বার্ষিক বারো লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে কর মকুব করে অর্থমন্ত্রী তাঁদের অভিমানে খানিক মলম লাগাতে সক্ষম হলেন।
দার্শনিকেরা বলেন যে, সরকারের কোনও নীতির মূল্যায়ন করতে গেলে দরকার ‘ইম্পার্শিয়াল স্পেক্টেটর’ বা ‘পক্ষপাতহীন দর্শক’-এর দৃষ্টি। নিজেদের সামাজিক অবস্থানটি ভুলে যেতে পারলে ভারতে আয়কর দেন যে ক্ষুদ্রতম অংশের মানুষ, তাঁদের চোখেও সহজেই ধরা পড়বে বাজেটের অন্যায্য দিকগুলি। এত দিন দেশের মাথাপিছু আয়ের সাড়ে তিন গুণ রোজগার করলে তবেই আয়কর দিতে হত। এ বার যাঁরা আয়কর দেবেন, তাঁরা মাথাপিছু আয়ের ছয় গুণ রোজগার করবেন। অতএব গরিবদের মাথায় পরোক্ষ করের বোঝা আপেক্ষিক ভাবে আরও বাড়বে।
সরকারি ওয়েবসাইটের ‘বাজেট অ্যাট আ গ্লান্স’ অনুযায়ী গত বছরের বাজেটে সরকারের মোট খরচ যা ধরা হয়েছিল, সংশোধিত হিসাব অনুযায়ী শেষ এক বছরে খরচ হয়েছে তার চেয়ে কম। এ বছরের প্রস্তাবিত খরচ তার তুলনায় বেড়েছে মোটে সাত শতাংশ। এর থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাদ দিলে দেখা যাবে যে, খরচ কম রাখার লক্ষ্যে অবিচল রয়েছে সরকার। নির্মলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ৪.৮% রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে করা হবে ৪.৪%। সেই লক্ষ্য মাথায় রেখেই হয়তো তাঁর ভাষণে উচ্চারণই করেননি একশো দিনের কাজের কথা। ২০২৪-২৫’এর সংশোধিত হিসাব অনুযায়ী এই প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৮৬ হাজার কোটি টাকা, এ বারও তা-ই। সেখানে ২০২৩-২৪’এ একশো দিনের কাজে খরচ হয়েছিল ৮৯ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে একশো দিনের কাজ না থাকায় অসুবিধার কথা বলেছেন গ্রামাঞ্চলের বহু মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় অ্যাক্রোনিম অবশ্য ‘জ্ঞান’— গরিব, যুব, অন্নদাতা আর নারী। বাজেট-বক্তৃতায় নির্মলাও বলেছেন, এঁদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হবে। বলেছেন ‘জ়িরো পভার্টি’র লক্ষ্যের কথাও। মনে পড়ে যায় সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের গল্পে চন্দর নামের ছেলেটির কথা— “মুখে যার বড় বড় কথা। হয়কে নয়, নয়কে হয় করা-এ যেন তার কাছে দুধ ভাত।” গণমাধ্যমের একটা বড় অংশও যেন চন্দরের ক্লাসের ছেলেদের মতো ‘চুপ করে তার এই সব অসহ্য মিথ্যা গল্প সত্য-কাহিনীর মতো গলাধঃকরণ করছে’।
প্রতি বছর বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের নিরিখে দেশের খারাপ র্যাঙ্ক প্রকাশিত হলে উন্নত বিশ্বের ষড়যন্ত্রের গল্প খাড়া করে সরকার। ক্ষুধা সূচকের গঠন-প্রক্রিয়ায় বিস্তর গোলযোগ আছে, সে কথা মেনে নিয়েও বলতে হয়, সরকারি তথ্যসূত্র অনুযায়ী অপুষ্টির যে ভয়াবহ চিত্রটি উঠে আসে, তা অবহেলা করার নয়। আফ্রিকার অনেক গরিব দেশের তুলনাতেও এখানকার শিশু-অপুষ্টি বেশি। গবেষকেরা দেখিয়েছেন, ভারতীয়রা যথেষ্ট পরিমাণে আনাজ এবং ফল খান না। স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণে শ্রেণিগত অসাম্যও বিপুল। অথচ নির্মলার বাজেট-ভাষণ বলছে, দেশে আনাজ, ফল এবং ‘শ্রী-অন্ন’ খাওয়ার হার বাড়ছে। ভারতীয়েরা নাকি পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া সম্বন্ধে উত্তরোত্তর সচেতন হচ্ছেন। এ দিকে, অপুষ্টি কমানোর কেন্দ্রীয় প্রকল্প পি এম পোষণ-এর বরাদ্দ কমেছে।
বাজেট অধিবেশনে গরিবদের মঙ্গলের জন্য লক্ষ্মীর কাছে প্রার্থনা করেছেন মোদী। সেই মঙ্গল কোন পথে আসবে বলে ভাবছেন তিনি? বাজেট-ভাষণে খানিক ইঙ্গিত আছে। ২০১৯-এ কর্পোরেট করে ছাড় দিয়ে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। এখন ব্যক্তি-মানুষেরা যতখানি কর দেন, তার পরিমাণ কর্পোরেট সংস্থাদের দেওয়া করের অঙ্কের চেয়ে বেশি। বেসরকারি লগ্নির ফলেই কর্মসংস্থান হবে এবং সরকারের ভূমিকা তার উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করাতেই সীমিত, এই আর্থনীতিক দর্শনটি অবশেষে ধাক্কা খেয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগের রাস্তা ধরে কর্মসংস্থান বাড়েনি, চাহিদা কমেছে। হতাশা চেপে রাখতে না পেরে নির্মলা সীতারামন এক বার বলেই ফেলেছিলেন, “এ দেশের বিনিযোগকারীরা কি হনুমানের মতো? তাঁদের শক্তি কতখানি তা কি তাঁরা নিজেরাই জানেন না? প্রাণ খুলে বিনিযোগ করতে এত দ্বিধা কেন তাঁদের?” সরকার বুঝেছে, ২০৩০-এ জিডিপির অঙ্কটিকে সাত ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার পথে পূরণ হবে না।
তাই আয়করে ছাড় দিয়ে ভোগব্যয় বাড়ানোর বিকল্প রাস্তাটি এ বার বেছে নেওয়া হল। অর্থনীতিবিদেরা আক্ষেপ করতেন, বর্তমান সরকারের নীতি চাহিদা বা ক্রয়ক্ষমতার প্রশ্নগুলিকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র জোগানের দিকটির উপরে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়। এ বছরের বাজেট আয়করে ছাড় দিয়ে চাহিদার রাস্তা ধরে আর্থিক বৃদ্ধিতে পৌঁছতে চাইছে, সে কথা স্পষ্ট। কিন্তু আয়করের আওতার বাইরে ছিলেন যে বিপুল অংশের মানুষ, তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বড় কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়ল না। বাজেটের মধ্যে দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানো যায়, এমন উদ্ভট দাবি কেউই করবেন না। তবু সরকারি ভাষ্য এখনও বেড়ে চলা অসাম্য সম্পর্কে কতখানি উদাসীন, ‘সবকা বিকাশ’-এর লব্জটি সব কথায় ব্যবহার করেও সকলের উন্নয়নের প্রশ্নে সরকার কতখানি দিশাহীন, তা আর এক বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এ বছরের বাজেট।
অর্থনীতি বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy