সব শ্রেণি, সব লিঙ্গ-যৌনতার মানুষকে যদি সমাজে এবং কর্মজগতে অংশগ্রহণ করতে হয়, তা হলে কী কী প্রয়োজন? যে সব পরিকাঠামো, পরিষেবা জরুরি, তার অন্যতম শৌচাগার। যথেষ্ট সংখ্যায়, যথেষ্ট ভাল মানের গণশৌচাগার প্রতিটি মানুষের সম্মানের সঙ্গে জীবনধারণের অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংবিধানের ২১ নম্বর ধারার দ্বারা এই অধিকার সুরক্ষিত। তা সত্ত্বেও ভারতের মহানগরগুলিতে গণশৌচাগারের সংখ্যা বা মান, কোনওটাই প্রয়োজনের ধারেকাছে নয়। ছোট শহর, মফস্সলে কী অবস্থা, সহজেই অনুমেয়। যেটুকু ব্যবস্থা রয়েছে, তার বণ্টনও নির্ধারিত আর্থিক শ্রেণি অনুসারে। স্কুল, হাসপাতালের মতো, গণশৌচাগারও ধনীদের পাড়ায় সংখ্যায় বেশি, চেহারাও চলনসই। আর গরিব, ঘিঞ্জি এলাকাগুলিতে সেগুলোর দেখা পাওয়া ভার, থাকলেও ব্যবহারের অযোগ্য।
সম্প্রতি কলকাতার গণশৌচাগারের হাল নিয়ে একটি সমীক্ষা হল। সবর ইনস্টিটিউট এবং আজ়াদ ফাউন্ডেশন, এই দুই অসরকারি সংস্থার এই সমীক্ষায় সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি নারী ও ট্রান্স এবং কুইয়ার মানুষের মতামত নেওয়া হয়েছে। ভারতে এ বিষয়ে এত বেশি মানুষের সঙ্গে কথা বলে এ ধরনের সমীক্ষা খুব বেশি নেই, তাই এর ফলাফলগুলির গুরুত্ব যথেষ্ট। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বাজার এলাকায় শৌচাগারগুলি টাকার বিনিময়ে ব্যবহার করা হয়। ফলে যাঁরা রাস্তায় নানা ধরনের ব্যবসা করেন, বিক্রি করেন, তাঁদের আয়ের ১০ শতাংশ শৌচাগার ব্যবহার করতেই চলে যায়। এই অনুপাত তাৎপর্যপূর্ণ। কোনও গৃহস্থ যদি তার আয়ের এতখানি অংশ কোনও মৌলিক পরিষেবার জন্য ব্যয় করে, তবে তাকে সে বিষয়ে ‘দরিদ্র’ বলে ধরা হয়। যেমন, ব্রিটেনে যদি কোনও পরিবার তার আয়ের ১০ শতাংশ বা তার বেশি জ্বালানির (গ্যাস, বিদ্যুৎ) জন্য খরচ করে, তা হলে তাকে ‘জ্বালানি-দরিদ্র’ (এনার্জি পুয়োর) বলে ধরা হয়। সেই নিরিখে কলকাতায় যে মেয়েরা রাস্তায় হকারি করছেন, ব্যবসা করছেন, গাড়ি চালাচ্ছেন, তাঁরা ‘টয়লেট পুয়োর’— শৌচাগার-দরিদ্র। যথেষ্ট শৌচাগার না থাকার সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য সমস্যাও— অধিকাংশই অভিযোগ করেছেন পরিচ্ছন্নতার অভাব, আলোর অভাব, ভাঙা ছিটকিনি নিয়ে। বিশেষত দরজা বন্ধ না-হওয়ার সুযোগ নিয়ে যৌন হয়রানি আকছার ঘটছে, কখনও শৌচাগারের রক্ষক পুরুষটির দ্বারা, কখনও স্থানীয় পুরুষদের দ্বারা। সমস্যাটা কেবল মেয়েদের নয়, রাষ্ট্রের। শৌচাগারের মতো মৌলিক পরিষেবাগুলোর জোগান না দিলে মানবসম্পদের যে অপচয় হবে, তাতে ‘বিকশিত ভারত’-এর লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে না।
বিশ্বের নিরিখে ভারত বহু পিছিয়ে রয়েছে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হারে। আফ্রিকার মানচিত্রে সাহারা মরুভূমির নীচের দরিদ্র দেশগুলিতে ১৫-৫৯ বছর বয়সি মেয়েদের মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি যোগ দেন শ্রমের বাজারে। সেখানে ভারতের শহরগুলিতেও মেয়েদের শ্রমবাহিনীতে যোগদানের হার কোনও বছরেই ২৩-২৫ শতাংশ ছাড়ায় না। যদিও ২০২৩-২৪ সালে ওই হারে একটা হঠাৎ-বৃদ্ধি লক্ষ করা গিয়েছে। সম্ভবত তার কারণ পরিবারের আর্থিক সঙ্কট। কিন্তু কাজে যোগ দিতে চাইলে মেয়েদের বেশ কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এক দিকে রয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুশাসন, যা গৃহকাজের দায় চাপিয়ে দেয় মেয়েদের উপর। ফলে অর্থকরী কাজ করার সময়টাই থাকে না মেয়েদের হাতে। যাঁরা এ সব বাধা পেরিয়ে রোজগার করতে চান, তাঁদের মেয়ে হওয়ার জন্য নানা ‘জরিমানা’ দিতে হয়। অপ্রতুল, অসুরক্ষিত শৌচাগার তারই একটা। কর্মক্ষেত্রেও মেয়েরা পান প্রতিকূল, পীড়নকারী পরিস্থিতি। একই কাজে পুরুষদের চেয়ে কম মজুরি। এক দিকে ঘরের বাইরে বেরোনো নিয়ে সামাজিক রীতি, অন্য দিকে কর্মক্ষেত্রে অসম্মান, অস্বাচ্ছন্দ্য, এ সব কিছুর ফলে মেয়েদের মনে বাধা তৈরি হয়। পরিবারের রোজগার বাড়ানোর জন্য শ্রমের বাজারে যোগ দিতে তাঁরা দ্বিধা করেন।
তার উপর রয়েছে মজুরির স্বল্পতা। স্বনিযুক্ত কর্মী বা ঠিকা, অস্থায়ী কর্মীদের ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা। গত দশ বছরে মজুরি প্রায় কিছুই বাড়েনি। যদি বা পরিবার, প্রতিবেশীর বাধা ডিঙিয়ে মেয়েরা কাজে যোগ দেন, তখন বাধা হয়ে দাঁড়ায় মেয়ে হওয়ার বিশেষ অসুবিধা। এই সমীক্ষায় দেখিয়েছে, শহরের দরিদ্র এলাকাগুলিতে শৌচাগারের সংখ্যা কম, অবস্থাও খারাপ। দরিদ্র, শ্রমজীবী মেয়েদের আরও বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। মেয়েদের শ্রমশক্তিকে যদি সত্যিই কাজে লাগাতে হয়, তা হলে জনসুবিধার নানা পরিকাঠামোর জন্য অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হবে— শৌচাগার, জনপরিবহণ, ক্রেশ, হস্টেল, স্কুল, হাসপাতাল, ইত্যাদি। দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে এগুলি সুলভ, সুগম করা চাই। সামাজিক নীতি ও প্রকল্পগুলির ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারী এবং ট্রান্স ও কুইয়ার মানুষের প্রতি সংবেদনশীল ব্যবস্থা তৈরি করতে, তাঁদের উপযোগী পরিষেবার অভাব দূর করতে সরকারি নীতিকে কাজে লাগাতে হবে, যাতে মেয়েরা বড় সংখ্যায় কাজে যোগ দিতে পারেন। মুশকিল হল, নীতি যাঁরা তৈরি করেন, তাঁরা সামাজিক প্রকল্পগুলিকে প্রায় কখনওই এমন পরিকাঠামো, পরিষেবার ব্যবস্থার নির্মাণকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির উপায় বলে মনে করেন না। মনে করেন, সংবিধান বা আইন-বিধি সরকারের উপর যে সব দায় চাপিয়েছে, সেগুলো কোনও মতে সেরে ফেলাই সামাজিক প্রকল্পের কাজ। অথচ উল্টোটাই সত্যি।
ইতিহাসের নানা নিদর্শন থেকেই তা স্পষ্ট হয়। অধিকাংশ উন্নত দেশ তাদের অর্থনীতির বৃদ্ধি ঘটাতে পেরেছে বেশি সংখ্যায় মেয়েরা শ্রমবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরে। এবং মেয়েদের সেই যোগদান সম্ভব হয়েছে তখনই, যখন দেশের সরকার সামাজিক প্রকল্পে বড় অঙ্কের টাকা বরাদ্দ করতে শুরু করে। যেমন, শিশু ও বৃদ্ধদের পরিচর্যার পরিষেবা যদি সুলভ করা যায়, তা হলে কর্মক্ষম মহিলাদের সময় অনেকটা বেঁচে যায়, ফলে তাঁরা কাজে যোগ দিতে পারেন। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান প্রভৃতি সমৃদ্ধ দেশগুলি তাদের জিডিপি-র ২২ শতাংশ খরচ করেছিল সামাজিক প্রকল্পে। তাদের কাছে এটা অপচয় নয়, অর্থনীতির বৃদ্ধির জন্য জরুরি ব্যয়। যত বেশি মহিলা শ্রমের বাজারে যোগ দেন, ততই বৃদ্ধি পায় অর্থনীতি— এমনকি প্রত্যাশিত অনুপাতকেও ছাড়িয়ে যায়। বাড়তি রোজগারের ফলে ভোগব্যয় বাড়ে, চাহিদা বাড়লে বাড়ে উৎপাদন, এমন একটি শুভচক্র শুরু হয়। আয় এবং ব্যয় বাড়ার ফলে সরকারের কর আদায়ও বাড়ে। সে টাকা থেকেই ফের সামাজিক প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়, তাতে সরকারের উপর বাড়তি চাপ তৈরি হয় না।
অতএব সময় এসেছে, আমাদের দেশেও মেয়েদের এবং ভিন্ন লিঙ্গ-যৌনতার সব ধরনের গোষ্ঠীর প্রতি সংবেদনশীল মানসিকতা তৈরি করার। সংবিধানের ২১ নম্বর ধারার প্রতি দায়বদ্ধতা বজায় রাখতে এটা জরুরি। সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যা অনুসারে, এই ধারা সসম্মানে বেঁচে থাকার অধিকারের নানা দিককে সুরক্ষিত করে। যেমন, স্বাস্থ্য, জীবিকা অর্জন, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, এবং তার সঙ্গেই ইচ্ছেমতো ঘোরাফেরা, বা দীর্ঘ যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয়, উন্নত মানের শৌচাগার। কিন্তু এই নৈতিক অনুশাসনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রয়োজনও কম নয়। শৌচাগারের মতো পরিকাঠামো তৈরি করলে অসম্মান, অস্বাস্থ্যের ‘জরিমানা’ কমবে, ঘরের কাজে মেয়েদের বন্দি করে রাখার প্রবণতা কমবে। মেয়েদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে যোগদান বাড়বে। কিছু কিছু রাজ্য ইতিমধ্যেই সেই উদ্যোগ করেছে। বেঙ্গালুরু এবং দিল্লিতে মেয়েদের বিনা টিকিটে বাসযাত্রা শুরু হয়েছে। তামিলনাড়ু এবং তেলঙ্গানাতে চলছে গণরসুই। এই উদ্যোগগুলি প্রশংসনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। ‘বিকশিত ভারত’-এর স্বপ্নকে সাকার করতে হলে সামাজিক সুবিধার জন্য বাজেটে বড়সড় বৃদ্ধি চাই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)