আমাদের শব্দকোষ থেকে ‘মারণব্যাধি’ শব্দটি কি তা হলে এত দিনে সরে যেতে বসেছে? গুগল-মালিকানাধীন সংস্থা আইসোমরফিক ল্যাবস তেমনই দাবি করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-র অভাবনীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা ওষুধ আবিষ্কারের যে নতুন দিগন্ত খুলছে, তাতে চিকিৎসার পরিচিত রীতি-নীতি একেবারে বদলে যাবে। এ বছরই এআই ব্যবহার করে পাওয়া ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হচ্ছে। ক্যানসার, হৃদ্রোগ, স্নায়ুর ক্ষয়, এমন নানা গুরুতর রোগের জন্য এআই-নির্ভর ওষুধও নাকি প্রস্তুত, জানা গেল দাভোস-এ ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম সম্মিলনে।
একটি নতুন ওষুধ তৈরিতে প্রচুর সময়, শ্রম, অর্থ ব্যয় হয়। পাঁচ থেকে দশ বছর গবেষণার পরেও সর্বদা সফলতার নিশ্চয়তা থাকে না। এআই এই দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে চিরতরে বদলে দিতে পারে। ডেটার সমুদ্র থেকে প্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম কণাগুলি খুঁজে বার করতে সাহায্য করছে এআই। কোনও রোগের জন্য ঠিক কোন প্রোটিন বা জিন দায়ী, তা এআই এমন ভাবে চিহ্নিত করতে পারে, যা আগে সম্ভব ছিল না। এর মাধ্যমে রোগের প্রকৃত কারণ বুঝে দ্রুত ওষুধ তৈরির দিশা পাওয়া যায়। চিকিৎসার খরচও কমানো যায়। আগামী তিন বছরের মধ্যে এআই কোটি কোটি মানুষের জীবন বদলে দেবে, দাবি এই রকম।
চিকিৎসায় এআই-এর সম্ভাবনা অসীম। হয়তো এমন দিন আসবে, যখন ক্যানসার বা অ্যালঝাইমার’স-এর মতো রোগ, যার চিকিৎসা আজ দুঃসাধ্য, তা ঠান্ডা লাগার চিকিৎসার মতোই সহজ হয়ে যাবে। কল্পবিজ্ঞানের গল্পে এক সময়ে এমন ম্যাজিকের মতো ঘটনার কথা পাওয়া যেত। সেই কল্পনাগুলো আজ বাস্তব রূপ নিতে চলেছে। আজ যে প্রতিশ্রুতি শোনাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা, তা যদি সত্যি হয় তা হলে কেবল সহজ, সুলভ চিকিৎসাই নয়, এআই মানবসভ্যতাকে আরও সুস্থ, আরও উন্নত ভবিষ্যৎ দিতে চলেছে। কারণ, কেবল ভাল ভাল ওষুধ তৈরি হবে, তা তো নয়, রোগকে গোড়া থেকেই নির্মূল করা যাবে। এআই ব্যবহার করে মানব জিনোমের বিশ্লেষণ দ্রুততর ও সুলভ হচ্ছে। ক্রিসপার-এর মতো জিন এডিটিং প্রযুক্তির সঙ্গে এআই যুক্ত হলে জেনেটিক অসুখ প্রকাশ হওয়ার আগেই তা শনাক্ত এবং সংশোধন করা সম্ভব। এই কাজ এগোলে সিক্ল সেল অ্যানিমিয়া বা
হান্টিংটন-এর মতো জেনেটিক রোগ ভবিষ্যতে নির্মূলও হতে পারে।
আর একটা সুবিধা, প্রতিটি মানুষের শরীরের নিজস্ব চাহিদা বুঝে চিকিৎসার ব্যবস্থা। এআই রোগীর জিনগত বিশেষত্ব, জীবনধারা এবং পরিবেশগত তথ্য বিশ্লেষণ করে, সেই অনুসারে চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারে। যেমন, কোনও ক্যানসার রোগীর নির্দিষ্ট মিউটেশন লক্ষ করে, বিশেষ ভাবে তাঁর জন্য উপযোগী ইমিউনোথেরাপি তৈরি করা যেতে পারে। ভ্রূণের স্ক্যান করে জিনগত সম্ভাব্য সমস্যাগুলি পূর্বেই শনাক্ত করতে পারে এআই প্রযুক্তি। সম্ভাব্য সমস্যার প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ করার সুযোগও করে দেয়। এআই-চালিত রোবটিক সার্জারি এখন অনেক সূক্ষ্ম এবং নির্ভুল। এআই-চালিত টেলিমেডিসিন রোগী এবং চিকিৎসকের মধ্যে আরও ভাল সেতুবন্ধন করে, যা প্রান্তিক অঞ্চলগুলিতে চিকিৎসা উন্নত করতে সাহায্য করে। নতুন এবং বিরল রোগ শনাক্ত করতেও এই প্রযুক্তি অত্যন্ত কার্যকর। কোভিড-১৯ অতিমারির সময়, ভ্যাকসিন তৈরিতে সাহায্য করেছিল এআই। ভবিষ্যতে মহামারির পূর্বাভাস দিতে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সহায়ক হতে পারে।
তবে এআই প্রয়োগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক প্রশ্নও। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার সুরক্ষা বড় চ্যালেঞ্জ। রোগীদের মেডিক্যাল ডেটা বিশ্লেষণে দক্ষ হওয়ার জন্য এআই যে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে, তার সঠিক ব্যবহার এবং সুরক্ষার নিশ্চয়তা অত্যন্ত জরুরি। ডেটা লঙ্ঘন বা অপব্যবহার হলে রোগীদের ক্ষতি হতে পারে, আস্থার অভাব দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও, এআই প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত ডেটাসেট-এ যদি কোনও নির্দিষ্ট জনসংখ্যার প্রাধান্য থাকে, বা অন্য সমস্যা থাকে, তবে তা অন্য জনগোষ্ঠীর জন্য যথাযথ ফলাফল দিতে ব্যর্থ হতে পারে। অর্থাৎ, প্রদত্ত তথ্যে পক্ষপাত বা ত্রুটি থাকলে চিকিৎসার গুণমানে তা প্রভাব ফেলবে।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, এআই সিস্টেম যদি রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসার বিষয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, তার দায়ভার কে নেবে? চিকিৎসক, প্রযুক্তি নির্মাতা না কি হাসপাতাল বা ক্লিনিক? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে বার করা অত্যন্ত জরুরি। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের কাছে কি সহজলভ্য হবে? তাই, এআই ব্যবহারে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পাশে নৈতিক এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
ভারতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-নির্ভর চিকিৎসার ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। একটি স্টার্টআপ এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্তন ক্যানসার নির্ণয়ের সহজলভ্য, ব্যথাহীন পদ্ধতি তৈরি করেছে, যা গ্রামীণ অঞ্চলে অত্যন্ত কার্যকর হবে। আর একটি স্টার্টআপ রেডিয়োলজির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে, যক্ষ্মা এবং নিউমোনিয়া শনাক্ত করতে বিশেষ কাজে লাগতে পারে। ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এআই যাতে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে, তার জন্য এখনই নীতি তৈরি অত্যন্ত জরুরি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)