Advertisement
০২ মে ২০২৪
Child Labour

বন্দি শৈশবের দায় কে নেবে

ইটভাটাতে মজুরি নির্ভর করে কাজের পরিমাণের উপর। যত বেশি লোক হাত লাগাবে, আয় তত বেশি।

আশিস কুমার রায়
শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২২ ০৫:২৮
Share: Save:

ঝাড়গ্রামের একটি ইটভাটা থেকে তেরো জন শিশুশ্রমিক উদ্ধার হল। এ ঘটনা ব্যতিক্রম নয়, বরং এটাই দস্তুর। ভারতের ষাট শতাংশের বেশি ইটভাটা রয়েছে চারটি রাজ্যে— পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে। পরিবেশ সুরক্ষা, শ্রম আইন, মানবাধিকার, নারী সুরক্ষা, শিশু সুরক্ষা, শিক্ষার অধিকার— দেশের সব আইন থমকে যায় এই ইটভাটাগুলির দরজায়। অনেক ইটভাটা অবৈধ, ফলে সেগুলি সব বিধিনিয়মের বাইরে থেকে যায়। ভিতরে সম্পূর্ণ নৈরাজ্যের মধ্যে চলে চরম শোষণ।

ইটভাটা শুরু করতে প্রধানত স্থানীয় পঞ্চায়েতের অনুমতির প্রয়োজন হয়। কিছু দিন আগে পর্যন্ত ইটভাটাগুলি সেচ দফতরের অধীনে থাকলেও, বর্তমানে তা শ্রম দফতরের অধীনে। কিন্তু কোন ইটভাটায় কত শ্রমিক কী শর্তে কাজ করছেন, তার খোঁজ শ্রম দফতরের আধিকারিকরা কতটুকু রাখেন? প্রশাসনিক নজরদারি কম থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভাটায় রাজনীতির আধিপত্য বেড়েছে। স্থানীয় বাহুবলী নেতারা ইটভাটা পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নয়াগ্রামের যে ভাটা থেকে শিশু শ্রমিকরা উদ্ধার হয়েছে, তার মালিক এক সাংসদের আত্মীয়, এ খবর তাই আশ্চর্য করে না।

পশ্চিমবঙ্গের ইটভাটায় কাজ করার জন্য শ্রমিকরা প্রধানত ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা ও ছত্তীসগঢ় থেকে আসেন। মালিকদের সঙ্গে শ্রমিকদের সরাসরি কোনও চুক্তি হয় না। চুক্তি হয় মূলত ‘দফাদার’ অর্থাৎ ঠিকাদার, বা দালালদের সঙ্গে। দৈনন্দিন ঝামেলা এড়াতে মালিকপক্ষও মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ পছন্দ করেন। এই দালালদের কোনও আইনি শাসনের আওতায় নিয়ে আসার মতো পরিকাঠামো এ রাজ্যে নেই। শ্রমিকদের ভুল বুঝিয়ে, ভয় দেখিয়ে, কখনও বা আবার অগ্রিম দাদনের পরিবর্তে কার্যত দাস শ্রমিকের মতো কাজ করতে বাধ্য করা হয়। পুজোর আশেপাশে তাঁরা কাজ শুরু করেন, বর্ষা আসা পর্যন্ত ভাটাতেই বাস করেন, অনেকেই সপরিবারে।

ইটভাটাতে মজুরি নির্ভর করে কাজের পরিমাণের উপর। যত বেশি লোক হাত লাগাবে, আয় তত বেশি। তাই বড়দের সঙ্গে শিশুরাও কাজে হাত লাগাতে শেখে— বোধ তৈরি হওয়ার আগেই তারা মজুরে পরিণত হয়। সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ভাবে ভাটার শিশুরা বড় হতে থাকে। শিশু অধিকার পূরণের কোনও শর্তই ভাটায় মানা হয় না। নিরাপত্তাহীন কাজের জায়গা, ইটের পাঁজা দিয়ে তৈরি ঘরে অতি কষ্টে বসবাস, সেই সঙ্গে নানা রকম নির্যাতনের শিকার হতে হয় এই পরিযায়ী শিশুদের। স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় না, কারণ প্রয়োজনীয় নথিপত্র, জন্মের শংসাপত্র তাদের থাকে না। ভাষাগত সমস্যাও থাকে। কিছু কিছু এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির উদ্যোগে শিশুদের শিক্ষার মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা, শিক্ষা দফতরের আধিকারিকরা সহযোগিতা করছেন। কিন্তু সমস্যাটির যা ব্যাপ্তি, তাতে এমন সীমিত উদ্যোগে সামান্যই লাভ হয়। সমস্যাটিকে স্থানীয় পরিসরে সীমিত করে দেখলে সমাধান খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

যে হেতু পরিবারগুলি মূলত পড়শি রাজ্যগুলি থেকে আসে, তাই এই একে আন্তঃরাজ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দরকার, ও সমন্বয় প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় স্তরে পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে লিখিত চুক্তি বা বোঝাপড়া দরকার, যার ভিত্তিতে বিভিন্ন সরকারি দফতর ইটভাটার শ্রমিক তথা সব পরিযায়ী শ্রমিকের অধিকারের সুরক্ষা এবং উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা করতে পারবে। শ্রম আইনের বিভিন্ন ধারাকে কী ভাবে এই শ্রমিকদের স্বার্থে ব্যবহার করা যেতে পারে, কী ভাবে ভিনরাজ্যে এসেও তাঁরা এ রাজ্যে সরকারি সুযোগ-সুবিধাগুলি পেতে পারেন, তার জন্য সদর্থক চিন্তা প্রয়োজন।

এ দেশে পঁয়ত্রিশ শতাংশের বেশি মানুষ তাঁদের আদি বাসস্থানে থাকেন না। নানা কারণে তাঁরা স্থানান্তরিত হয়েছেন, পরিযায়ী হয়েছেন। অনেক সময়ই স্থানান্তর উন্নয়নের সহায়ক হয়। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। রোজগারের তাগিদে, অর্থ-সহ নানা প্রলোভনের শিকার হয়ে ঘর, বাড়ি, সংসার ফেলে কাজে আসতে বাধ্য হন, এবং ঋণের জালে পড়ে কার্যত দাসশ্রমিকে পরিণত হন। এই বাস্তব চিন্তার, উদ্বেগের কারণ।

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার কমিশন শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য একটি সুসংহত পরিকল্পনা তৈরির কাজ করছে। কিন্তু তার রূপায়ণ হবে কবে? আরও কত শিশু এ রাজ্যের কত অবৈধ ভাটায় বন্দিদশায় জীবন কাটাচ্ছে, কে বলতে পারে? ইটভাটায় যেন শিশুদের ভবিষ্যৎ নষ্ট না হয়। শিশুদের অধিকার সুনিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য; রাষ্ট্র দেশের শিশুদের কাছে দায়বদ্ধ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Child Labour Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE