ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী চিন সফর করছেন। এমন একটা সুযোগে জেনে নেওয়া ভাল, আজকালকার চিনেও কিন্তু আর ‘কমরেড’ কথাটা তেমন চলছে না। চিনে ভাষায় ‘কমরেড’ হল ‘টোং ঝ’। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা কথাটাকে খানিক ঠাট্টার ছলেই ব্যবহার করছে বেশি। বিশ্বায়নের জেরে চিন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ফলে চিনের সমাজেও এসেছে গভীর পরিবর্তন। ‘হ্যালো কমরেড, শেয়ার বাজারে আপনার স্টক কতটা উঠল এ সপ্তাহে?’ কিংবা ‘চলো কমরেড, ইটালিয়ান ক্যাফে থেকে ব্রেকফাস্ট খেয়ে আসি’— এ কি বলা যায়? কয়েক কোটি ডলারের ব্যবসার যিনি কর্ণধার, যাঁর নিজের ধনসম্পত্তির কোনও লেখাজোখা নেই, কয়েক হাজার কর্মীর নিয়োগকারী, তাঁকে কি ‘কমরেড’ বলে সম্বোধন করতে পারেন কোনও অধীন কর্মচারী? না কি, তিনিই কোনও কর্মীকে ডেকে বলতে পারেন, “কমরেড, কাল থেকে আর আসতে হবে না।”
‘কমরেড’ সম্বোধনের এ-হেন পড়তি দশায় চিনের কমিউনিস্ট পার্টি উদ্বিগ্ন। পার্টির মুখপত্র, এবং চিনের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পিপলস ডেলি-র সাম্প্রতিক একটি সম্পাদকীয়তে দেশের নেতাদের আহ্বান করা হয়েছে শব্দটির ব্যবহার ফিরিয়ে আনতে। চিনের মানুষ যেন পরস্পরকে ‘কমরেড’ সম্বোধন করার অভ্যাস হারিয়ে না ফেলেন। দলের নেতা-সদস্যদের মধ্যে অবশ্য এখনও ‘কমরেড’ সম্বোধন চালু রয়েছে, তবে সেটা প্রধানত দলের প্রশাসনিক কাজকর্মে, পোশাকি সম্বোধন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন নথিতে, নিয়োগপত্রে কিংবা কারও সম্মাননার সময়ে তাঁর সম্পূর্ণ নামের আগে ‘কমরেড’ বসানো হয়।
দৈনিক ব্যবহারে ‘কমরেড’-এর প্রয়োগ কিন্তু খানিকটা ভিন্ন। সরকারি দফতরের কনিষ্ঠ কেরানি, কিংবা রাস্তায় ডিউটি-রত কোনও পুলিশকে ‘কমরেড’ বলে ডাকা যেতে পারে। কিন্তু কথোপকথনের সময়ে সামনের মানুষটির সম্পূর্ণ নাম উল্লেখ না করে কেবল ‘কমরেড’ বললে তাঁর মর্যাদা একটু খাটো করা হয়। মনে হতে পারে, তাঁকে যথেষ্ট পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না। পর্যবেক্ষকদের মতে, সরকারি আধিকারিকদের সম্বোধনের উপযুক্ত শব্দ হল ‘লিং ডাও’, যার মানে ‘কর্তাব্যক্তি’। আর যদি তাঁর নাম জানা থাকে, সম্বোধন লাগাতে হবে নামের আগে। ‘ডিরেক্টর ওয়াং’ বলে সম্বোধন করাই ভাল, ‘কমরেড ওয়াং’ বলার চাইতে।
‘কমরেড’ শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ ‘কমাহাদ’ থেকে, যার মানে বন্ধু, বা সঙ্গী। ফরাসিতে শব্দটি যে কোনও ধরনের সঙ্গী বোঝাতেই ব্যবহার হয়— স্কুলের বন্ধুও ‘কমরেড’ হতে পারে। কিন্তু কমিউনিস্ট এবং বামপন্থী মনোভাবাপন্ন মানুষরা এই শব্দটিকে তাঁদের পছন্দের সম্বোধন হিসেবে ছড়িয়ে দিয়েছেন সারা বিশ্বে। মানুষে মানুষে সমতা বোঝাতে তাঁরা শব্দটি ব্যবহার করেন। কমিউনিস্ট চিনের শীর্ষ নেতা মাও জে দং দাবি করেছিলেন যে, কমিউনিস্ট পার্টির সব সদস্য পরস্পরকে ‘কমরেড’ বলে সম্বোধন করবেন, এর কোনও ব্যতিক্রম থাকবে না। দলের মধ্যে শৃঙ্খলা এবং একতা রাখার এটা অন্যতম উপায় বলে মনে করতেন তিনি।
কিন্তু বলা সোজা, করা কঠিন। যে দিন অধিকাংশ লোক গলাবন্ধ ‘মাও স্যুট’ পরত আর সাইকেল চালাত, সে দিন অনেক পিছনে ফেলে এসেছে চিন। যখন সমাজে খুব বেশি শ্রেণিভেদ ছিল না, তখন হয়তো ‘কমরেড’ সম্বোধন বেখাপ্পা শোনাত না। কিন্তু সত্তরের দশকে চিনের অর্থনীতি বিশ্বের প্রতি দরজা খুলে দেওয়ার পর থেকে সমাজতান্ত্রিক মনোভাবে, জীবনযাত্রায়, ক্রমশ অনেক পরিবর্তন এসেছে। চিনকে আদৌ কমিউনিস্ট দেশ বলা চলে কি না, তা নিয়ে নানা দেশ নানা প্রশ্ন তুলেছে। উত্তরে বেজিং-এর নেতারা তাঁদের অর্থনৈতিক সংস্কারকে আখ্যা দিয়েছিলেন, ‘চিনা বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন সমাজতন্ত্র’। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা তাঁদের দলের সর্বময় কর্তৃত্বকে সর্বশক্তিতে রক্ষা করে চলেছিলেন, যে কোনও বিরোধিতাকে শক্ত হাতে দমন করেছিলেন।
তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষত সমাজে, পরিবর্তনকে তাঁরা কোনও ভাবে বাধা দেননি। আর্থিক সংস্কারের ফলে চিন কয়েক কোটি মানুষকে দারিদ্রের কবল থেকে মুক্ত করতে পারল। বিশাল জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারল। অগণিত মানুষের জীবনে পরিবর্তন এল। তৈরি হল ঝাঁ চকচকে রাস্তা, হোটেল, অট্টালিকা, শপিং মল। চিনের পরিকাঠামোর উন্নতি নিজেদের সঙ্গে তুলনা করে পশ্চিমের অনেক দেশ খানিকটা লজ্জিতই হয়ে আছে। তবে এ সব চোখ-ধাঁধানো উন্নতির পাশাপাশি সমাজের কাঠামোয় মৌলিক পরিবর্তনও রোখা গেল না। ‘কমরেড’ শব্দটি হারিয়ে যাওয়া এক সাম্যময়, সম-মর্যাদায় উজ্জ্বল সমাজ গড়ার স্বপ্ন ক্রমশ বিলীন হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আজ চিনের তরুণ প্রজন্ম সমাজমাধ্যমে ‘কমরেড’ কথাটি ব্যবহার করছে বাড়তে-থাকা অসাম্যকে তুলে ধরতে। সম্পদ-বণ্টনের নকশার সমালোচনাই সেখানে বেশি। চিনে সম্পদ-বণ্টনে অসাম্য দ্রুত বেড়েছে। অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি এবং তাঁর সহ-লেখকরা একটি গবেষণাপত্রে (২০১৯) দেখিয়েছেন, চিনের ধনীতম ১০ শতাংশের হাতে রয়েছে দেশের ৬৭ শতাংশ সম্পদ। ১৯৭৮ সালে তাঁদের হাতে ছিল জাতীয় আয়ের ২৭ শতাংশ, ২০১৫ সালে তা ৪১ শতাংশ।
দেং শিয়াওপিং বলেছিলেন যে চিনের অর্থনীতির মোট আয়তন যদি ছোট হয়, তা হলে চিন বরাবর দরিদ্রই থাকবে। মোট আয়তন বড় হলে আরও বেশি মানুষের ভাগে আরও বেশি সম্পদ আসবে। আজ চিনের অর্থনীতির আয়তন যেখানে পৌঁছেছে, তা ঈর্ষণীয়। কিন্তু তার ভাগবাঁটোয়ারাতে আমেরিকা বা ইউরোপের ধনী দেশগুলির মতোই অসাম্যের নকশা চিন দেশেও দেখা যাচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে ‘কমরেড’ সম্বোধন আরও কিছু দিন হয়তো উচ্চারিত হবে। কিন্তু তা যেমন সমাজের দিকে ইঙ্গিত করত, তা ফিরে পাওয়া যাবে কি?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)