মাসতিনেক আগে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে বিধ্বংসী দাবানলে মারা গেলেন ২৯ জন; বাড়িঘর, অফিস, দোকান, সরকারি সম্পত্তি মিলিয়ে ধ্বংস হয়েছে কমপক্ষে ১৬,০০০ কাঠামো। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেস-এর গবেষকরা হিসাব কষে দেখেছেন, মোট সম্পত্তি এবং মূলধনের প্রত্যক্ষ ক্ষতির পরিমাণ ১৬৪ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হওয়া সম্ভব। এর সঙ্গে বৃহত্তর অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব জুড়লে, ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২৫০-২৭৫ বিলিয়ন ডলারে, যা ক্যালিফোর্নিয়ার মতে ধনী রাজ্যের জিডিপি-র ৪%। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এই দাবানলের কারণ হিসাবে ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়ন, বৃষ্টির পরিমাণ হ্রাস, অথবা পরিবর্তিত বৃষ্টিপাতের প্যাটার্নকে কাঠগড়ায় তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। শুষ্ক এবং আর্দ্র আবহাওয়ার মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন, যাকে বলা হয় ‘হুইপল্যাশ’, তৈরি করেছে প্রচুর পরিমাণে শুষ্ক গাছপালা, যা সাহায্য করে আগুন জ্বালাতে।
ক্ষতিপূরণের টাকা আসবে বিমা থেকে। অনুমান, বিমাকৃত ক্ষতির পরিমাণ পৌঁছতে পারে ৭৫ বিলিয়ন ডলারে। সঙ্গত কারণেই বিমা সংস্থাগুলি ত্রস্ত। ২০১৬-র আগে কিন্তু দাবানল নিয়ে বিমা কোম্পানির অতটা চিন্তার কারণ ছিল না। সে খাতে ক্ষতিপূরণের চাপ ছিল কম। ২০১৬-তে কানাডার আলবার্টার ফোর্ট ম্যাকমারে দাবানলে বিমাশিল্পের ক্ষতি হয় ৩ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার, তৈরি হয় উত্তর আমেরিকার সর্বকালীন রেকর্ড। রেকর্ডটা ভাঙতে যদিও সময় লেগেছে মাত্র এক বছর— ২০১৭-র ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪.৬ বিলিয়ন ডলার।
লস অ্যাঞ্জেলেসের আগুন বিমা সংস্থাগুলির ব্যবসাকেও বদলে দিতে চলেছে অনেকটাই। বিশেষজ্ঞদের মতে বিমাশিল্পের উপর এর প্রভাব ১৯৯২-এর ‘হারিকেন অ্যান্ড্রু’র সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ক্যাটেগরি ৫-এর অ্যান্ড্রু-তে প্রাণহানি হয় ২৬ জনের, ১২৫,০০০-এরও বেশি বাড়ি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং বিমা কোম্পানির খরচ হয় ১৫.৫ বিলিয়ন ডলার। ঝড়টি বিমাশিল্পকে হতচকিত করে; এর ঝটকায় পাততাড়ি গোটায় অন্তত ১৬টি বিমা সংস্থার ব্যবসা। লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানলের অবশ্যম্ভাবী প্রভাবে বিমাক্ষেত্রে নির্ধারিত হবে নতুন প্রিমিয়াম, এই শিল্পকে এবং অর্থনীতিকে অক্সিজেন জোগাতে। যার চাপ পড়বে জনতার উপরেই। এমনিতেই হিসাব বলছে, ২০২০-২০২৩’এ আমেরিকায় বিমার খরচ বেড়েছে ৩৩%।
জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে শক্তিশালী ঝড় সৃষ্টি হয়, বাড়ে ঘূর্ণিঝড় এবং হারিকেনের মতো তীব্র ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবের সম্ভাবনাও। দুনিয়া জুড়েই বড় মাপের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সংখ্যা এবং তীব্রতা বেড়েছে সাম্প্রতিক অতীতে। আর সঙ্গে লাফিয়ে বেড়েছে বিমার ব্যয়। যেমন, ২০২৪-এ টেক্সাসের অস্টিনে ডাভ স্প্রিংস এলাকায় বন্যার জন্য বিমার প্রিমিয়াম ৪৫০ ডলার থেকে এক লাফে বেড়ে হয়েছে ১৮৯৩ ডলার। এ সবের ফলে বহু মানুষ সরে গিয়ে বসতি করছেন অন্যত্র। লুইজ়িয়ানায় বিমার খরচ এক বছরে বেড়েছে ৬৩%। মায়ামির সমুদ্রস্তর বাড়ার ফলে ফ্লরিডার ৪০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি এসেছে বিপদসীমার আওতায়।
এগুলো কিন্তু আরও বিস্তৃত একটা গল্পের অংশ মাত্র। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে হারিকেন, বন্যা, ঝড় এবং আগুন আমেরিকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট স্ট্রিট ফাউন্ডেশন-এর হিসাবে, আমেরিকায় ২.৩৯ কোটি সম্পত্তি ক্ষতিকারক তীব্র বাতাসের আওতায়, ৪৪ লক্ষ সম্পত্তি রয়েছে দাবানলের ঝুঁকিতে, এবং আরও ১.২ কোটি সম্পত্তি বন্যার সম্ভাবনায়।
ইউরোপও এর ব্যতিক্রম নয়। গত ২০ বছরে আবহাওয়া সম্পর্কিত বিমা-ক্ষতির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি— আনুমানিক ৬০০ বিলিয়ন ডলার— জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। ২০২৪-এই ‘হেঙ্ক’ নামক ঝড়ে অতি-বৃষ্টিপাতের ফলে ব্রিটেন বিপুল বিমাকৃত ক্ষতির সম্মুখীন হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা চার গুণ বেড়েছে বলে অনুমান। গত বছর ইউরোপ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিমাকৃত ক্ষতির কবলে পড়ে বন্যার কারণে। শুধুমাত্র ২০২৪ সালেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে আনুমানিক ক্ষতি ১৩৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার ছবিটাও একই রকমের। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা আর দাবানল ক্রমশ সম্ভাব্য এবং তীব্র হচ্ছে। ফলস্বরূপ বাড়ছে বিমা খরচ, কিছু ক্ষেত্রে যা হচ্ছে তিন গুণ পর্যন্ত। এমনকি উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলি হয়ে উঠছে বিমার অযোগ্যও। নিউ সাউথ ওয়েলস আর কুইন্সল্যান্ডের বন্যা কিংবা ভিক্টোরিয়ায় আগুনের প্রভাবে অস্ট্রেলিয়ায় গত এক বছরে বিমার খরচ বেড়েছে ১১%, যেখানে জিনিসের দাম বেড়েছে মাত্র ২.৪%।
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি তাই আজ প্রশ্নের মুখে। বিভিন্ন সংস্থার করা হিসাবের নির্যাস হল, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর ধাক্কায় ২০৭০ থেকে ২০৯০-এর মধ্যে দুনিয়ার মোট জিডিপি ৫০% ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে, যদি না রাজনৈতিক নেতারা কার্বনমুক্ত করে প্রকৃতি পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপ করেন। ওয়াশিংটন ডিসি-র কংগ্রেশনাল বাজেট অফিসের ২০২৫-এর এক ওয়ার্কিং পেপারে অনুমান করা হয়েছে, ২০২৪ সালের পরে তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকলেও ভবিষ্যতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ২১০০ সালে আমেরিকার জিডিপি কমবে ৪%। প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বের জিডিপি-তে ক্ষতির পরিমাণ ১২%। দুনিয়ার উষ্ণায়নের ফলে জার্মানিকেই ২০৫০ সাল নাগাদ গুনাগার দিতে হতে পারে ৯০০ বিলিয়ন ইউরো।
ভারত-সম্পর্কিত হিসাবটাও একই ধরনের। এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্কের গত বছরের রিপোর্ট অনুযায়ী উচ্চমাত্রার কার্বন নিঃসরণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৭০ সালের মধ্যে ভারতের জিডিপি-তে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ ২৪.৭%। পরিবেশের সঙ্কটের সমাধান না হলে ২০৪০-এর মধ্যে ৫ কোটি ভারতীয় ঢুকে পড়বেন দারিদ্রের আবর্তে, প্রান্তিক আবহাওয়ার জন্য ২০৩০ থেকে ২০৫০-এর মধ্যেই নাকি মৃত্যু হবে আড়াই লক্ষ ভারতীয়ের। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রচণ্ড তাপ এবং আর্দ্রতার কারণে শ্রমঘণ্টা নষ্ট হওয়ায় ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের জিডিপি-র ৪.৫% পর্যন্ত পড়তে পারে ঝুঁকির মুখে।
উন্নত দেশগুলির মতো বিমা-সংস্কৃতি বহুল প্রচলিত না হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিমার মূল্য কিন্তু বাড়ছে ভারতেও। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ২০১৯ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে নাকি প্রায় ৫৬ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের সমতুল ক্ষতি হয়েছে এ দেশে। জলবায়ু-সম্পর্কিত ঝুঁকির কারণে ভারতের জলবিদ্যুতের মতো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলিতে বিমার প্রিমিয়াম বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। এমনকি স্বাস্থ্যবিমার মূল্যও বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত রোগ বৃদ্ধির ফলে। আগামী ছ’বছরে নাকি স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়াম বাড়তে পারে ৫০%, গড়ে বছরে ৮-১০% করে।
তাই, জলবায়ু পরিবর্তন শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বিপদ নয়, তার অর্থনৈতিক বিপদের সম্ভাবনাও অমিত। কিন্তু প্রতিকার কোথায়? পৃথিবী তো ক্রমেই উষ্ণতর হয়। মানুষ এ গ্রহের তাপমাত্রাকে প্রাক্-শিল্পযুগের চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঊর্ধ্বে আটকে রাখার লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছে পৌঁছতে পারে না। একের পর এক কনফারেন্স অব পার্টিজ় (সিওপি) হয়ে চলে, চলতে থাকে বিস্তর বাদানুবাদ, দড়ি টানাটানি। জলবায়ুকে রক্ষা করতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে লাগাম টেনে বাড়াতে হবে অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার। এ জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়তে উদ্যোগ করতে হবে ধনী দেশগুলিকেই, কারণ তাদেরই রয়েছে খরচের ক্ষমতা। দরিদ্র দেশগুলিকে জোগাতে হবে বিপুল অর্থ। কিন্তু সার্বিক ভাবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাব সর্বত্র— তা সে চিন হোক, বা ইউরোপ, কিংবা অস্ট্রেলিয়া। আর আমেরিকার কথা না বলাই ভাল।
আসলে রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থেই চাঙ্গা করতে চান দেশের অর্থনীতিকে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে নয়, সে হল তাৎক্ষণিক অর্থনীতি। কারণ সাধারণ ভোটাররা চার-পাঁচ বছর পর পর ভোটের বাজারে নেতাদের তাৎক্ষণিক সাফল্যকেই প্রধান মূল্য দিয়ে থাকি।
রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)