Advertisement
০২ মে ২০২৪
সমতা বিধানের পথ
Law Commission

দেশের সব নাগরিকের জন্য এক ছাঁচে ফেলা দেওয়ানি বিধি

মোদী সরকারের চলন থেকে একটা কথা পরিষ্কার— তারা প্রশাসনিক ‘শক থেরাপি’-তে বিশ্বাসী, ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর প্রতি তার আকর্ষণ অদম্য।

অভিন্ন দেওয়ানি আইন বিধি কি তবে লোকসভা নির্বাচনের আগেই কার্যকর

অভিন্ন দেওয়ানি আইন বিধি কি তবে লোকসভা নির্বাচনের আগেই কার্যকর প্রতীকী চিত্র।

শমীক সেন
শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:৪৯
Share: Save:

গত ২২ ফেব্রুয়ারি দিল্লি থেকে একটা ছোট প্রশাসনিক ঘোষণা করা হল— ২২তম আইন কমিশনের মেয়াদ বাড়ল প্রায় আঠারো মাস, ২০২৪ সালের ৩১ অগস্ট অবধি। অর্থাৎ, পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের পর পর্যন্ত। আইন কমিশন সরকার-নিযুক্ত সংস্থা, যার কাজ আইন সংস্কার ও নীতি সংক্রান্ত সুপারিশ করা। সচরাচর এই কমিশনের মেয়াদ হয় তিন বছর। ২২তম আইন কমিশন নিযুক্ত হয়েছিল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। কমিশন নিজের জন্য যে নীতি সংক্রান্ত লক্ষ্য স্থির করেছিল, তা হল, ভারতের সংবিধানে যে ডিরেক্টিভ প্রিন্সিপলস অব স্টেট পলিসি বা নির্দেশমূলক রাষ্ট্রীয় নীতি রয়েছে, তাকে আরও বেশি ব্যবহারিক ও কার্যকর করে তোলা। কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধির ঘোষণাটিকে যদি বিজেপির নেতা-কর্মীদের, এবং অতি অবশ্যই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবিধ হুঙ্কারের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা হয়, তা হলে তাতে যথেষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে, দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার যে প্রতিশ্রুতি বিজেপির ইস্তাহারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগেই তা পূর্ণ হতে চলেছে।

মোদী সরকারের চলন থেকে একটা কথা পরিষ্কার— তারা প্রশাসনিক ‘শক থেরাপি’-তে বিশ্বাসী, ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর প্রতি তার আকর্ষণ অদম্য। সেই স্ট্রাইক শুধু সামরিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। ডিমনিটাইজ়েশনের সিদ্ধান্তটিকে প্রচার করা হয়েছিল কালো টাকা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হিসাবে; তাড়াহুড়ো করে ব্যবহারিক গোলমালসমেত চালু করা জিএসটি ব্যবস্থাকে বলা হয়েছিল একাধিক পরোক্ষ করের উপর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। ৩৭০ ধারা বিলোপ, রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন-সহ যে প্রতিশ্রুতিগুলি বিজেপি দিয়েছিল, তার বেশির ভাগই পূরণ হয়ে গিয়েছে। অনুমান করা চলে, মোদীর বিজয়রথের পরবর্তী গন্তব্য সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার পথে হাঁটা— এবং, তার মাধ্যমে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৪-এ উল্লিখিত নির্দেশ পূরণ করা। আশঙ্কা, সেটাও হবে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক-এর ভঙ্গিতেই।

দেশের সব নাগরিকের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে সমস্যা কোথায়? ভারতে প্রায় দুই শতাব্দী প্রাচীন ধর্মনিরপেক্ষ, অভিন্ন ফৌজদারি আইন কাঠামো চালু রয়েছে। তা ছাড়াও একাধিক বার (যথেষ্ট বাধা আসা সত্ত্বেও) হিন্দু আইনের সমতাবিধানের প্রক্রিয়া হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১৯৫৫-৫৬ সালে মিতাক্ষর ও দায়ভাগ ধারার মধ্যে সমতাবিধানের মাধ্যমে হিন্দু পার্সোনাল ল সংক্রান্ত কোড বা বিধি তৈরি করা। এই ঘটনা নির্দেশ করে যে, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার মডেল ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ পরিসরের মধ্যে অলঙ্ঘ্য প্রাচীর তৈরিতে বিশ্বাসী নয়। বস্তুত, ধর্মীয় সংস্কার এবং ধর্মকে বিবিধ কুপ্রথা— বিশেষত জাতপাতব্যবস্থা— থেকে মুক্ত করার কথা সংবিধানেই উল্লিখিত, যেমন অনুচ্ছেদ ১৭ (অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে অধিকার), অনুচ্ছেদ ২৫ (২) (যাতে কোনও ধর্ম অনুসরণের কথা বলা, ধর্ম অনুসরণ করা বা ধর্মের প্রচার করার ব্যক্তি অধিকারকে সীমিত করার জন্য সংস্কারমুখী আইন তৈরির রাষ্ট্রীয় অধিকারের কথা রয়েছে) ইত্যাদি। একাধিক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে বলেছে।

সংবিধানে এমন উদাহরণ প্রচুর, যেখানে ধর্মীয় বিষয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বাধিকারে কাটছাঁট করা প্রয়োজন। কিন্তু, স্টেট অব বম্বে বনাম নরাসু আপ্পা মালি মামলার মতো বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদি পূর্ব দৃষ্টান্ত রয়েছে, যা এ ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। এই দৃষ্টান্তগুলির কারণে পার্সোনাল ল বা পারিবারিক আইনকে মৌলিক অধিকারের কষ্টিপাথরে বিচার করা যায়নি। তার সঙ্গে রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের করা ‘এসেনশিয়াল রিলিজিয়াস প্র্যাক্টিসেস টেস্ট’, যার মাধ্যমে বিচার করা হয় যে, কোন ধর্মীয় আচরণ সুপ্রিম কোর্টের বিচারের এক্তিয়ারে পড়ে, আর কোনটি পড়ে না। রয়েছে সংবিধানের ২৬ (খ) অনুচ্ছেদ, যাতে ধর্মীয় বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ধর্মকে সম্পূর্ণ স্বাধিকার দেওয়া হয়েছে— অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার পথে এটাও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, কারণ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কোনও ধর্মের অন্তর্গত পারিবারিক আইনের উপরে প্রভাব ফেলবেই।

কিন্তু, বেশ কিছু সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত বলছে যে, ধর্মীয় পরিসরে কোনও বৈষম্যমূলক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের অনীহা আগের তুলনায় তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কমেছে। তিন তালাক এবং শবরীমালা রায়ের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘এসেনশিয়াল রিলিজিয়াস প্র্যাক্টিসেস’-এর মাপকাঠিও আগের তুলনায় শিথিলতর হয়েছে। যদিও গোষ্ঠীর স্বাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার সাত দশক-প্রাচীন বিচারবিভাগীয় কক্ষপথ থেকে সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ সরে আসেনি।

ভারতের আইনসভায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত বিতর্কে আপত্তি উঠেছিল যে, এই বিধি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধিকার খর্ব করবে। সেই প্রসঙ্গে কে এম মুনশি বলেন, “আমাদের প্রথম এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল দেশে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। আমরা মনে করি যে, আমরা জাতীয় ঐক্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছি। কিন্তু, তা ছাড়া আরও অনেক বিষয়— এবং, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়— রয়েছে, যা আমাদের জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে ঘোরতর বিপদের কারণ হতে পারে, এবং এটি খুবই জরুরি যে, আমাদের সামগ্রিক জীবন, অর্থাৎ আমাদের জীবনের যে অংশটুকু ধর্মনিরপেক্ষ পরিসরের অন্তর্গত, তা যত দ্রুত সম্ভব এমন ভাবে ঐক্যবদ্ধ হোক, যাতে আমরা বলতে পারি যে, “আমরা শুধু মুখের কথায় নয়, যে ভাবে আমরা জীবনযাপন করি, আমাদের পারিবারিক আইন যে রকম, তাতে আমরা কাজেও একটি শক্তিশালী ও অভিন্ন জাতি হয়ে উঠেছি।” যদি শুধু এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তা হলে আমায় বলতেই হবে যে, বিরোধীরা ঠিক বলছেন না। আমি আশা করব যে, আমাদের বন্ধুরা একে সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচারের উদাহরণ হিসাবে দেখবেন না; এই ব্যবস্থার বোঝা সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর প্রবলতর হবে।”

তবে, উপর থেকে সমতাবিধান চাপিয়ে দেওয়ার এই প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে বিচারবিভাগীয় আপত্তিও নেহাত কম নয়। অধ্যাপক মহেন্দ্র পাল সিংহ ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে রক্ষার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন যে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে সর্বাগ্রগণ্য সাংবিধানিক লক্ষ্য হিসাবে দেখার প্রয়োজন নেই। আদৌ যদি কখনও এই লক্ষ্য পূরণ করা হয়, তবে তা সংবিধানের ৫১ক (ঙ) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত মৌলিক দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে— যেখানে ‘ধর্মীয়, ভাষাগত, আঞ্চলিক বা গোষ্ঠীগত বিভিন্নতার ঊর্ধ্বে উঠে ভারতের সব নাগরিকের মধ্যে সমন্বয় ও সৌভ্রাতৃত্ব’ স্থাপন করার প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে। ধর্ম সংস্কারের উদ্দেশ্যে রচিত আইন প্রসঙ্গে বিচারপতি আয়েঙ্গার ১৯৬২ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে যে কথাটি বলেছিলেন, তা এখনও বিস্মৃত নয়— “আমার মতে, ‘সামাজিক কল্যাণ ও সংস্কারমুখী আইন’, এই বাক্যাংশটি এই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়নি যে, আইনসভা সংস্কারের নামে কোনও ধর্মকে তার অস্তিত্ব বা পরিচিতি থেকেই বিচ্যুত করতে পারে।” সাম্প্রতিক কালে শবরীমালা মামলার রায়ে নিজের বিরুদ্ধবাদী মন্তব্যে বিচারপতি ইন্দু মলহোত্র বলেন যে, ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশে চলার ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগত স্বাধিকারের ধারণা ও সাংবিধানিক নৈতিকতায় নিহিত বহুত্ববাদের আদর্শটিকে রক্ষা করা প্রয়োজন।

নির্দিষ্ট সময় অন্তর আইনসভা ও আইনবিভাগের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ধর্মীয় প্রথার সংস্কার প্রয়োজন, তা নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু, ধর্মের নিজস্ব পরিচিতিকে রক্ষা করাও সমান প্রয়োজন। অভিন্নতার মাধ্যমে সমতাবিধান করার অর্থ কিন্তু সব কিছুকেই এক ছাঁচে ফেলে দেওয়া নয়। দেশের কোনও নাগরিকের সাংবিধানিক নিরাপত্তা বা নিশ্চয়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রথা যাতে বাধা না হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু অভিন্নতা রক্ষায় জোর দিতে গিয়ে ভারতের বহুত্ববাদী আত্মাটি যাতে খণ্ডিত না হয়, তা নিশ্চিত করাও একই রকম জরুরি। যদি সাংবিধানিক সুরক্ষাগুলি বজায় থাকে, এবং বৈষম্যমূলক বা মানুষের মৌলিক সম্মানের পরিপন্থী প্রথাগুলিকে ছেঁটে দেওয়া যায়, তা হলে সব ধর্ম ও ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নিজস্ব বিশিষ্টতা বজায় রাখার অধিকার দেওয়া প্রয়োজন। সবার ঘাড়ে একই ছাঁচে ফেলা— ছাঁচটি সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের— অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চাপিয়ে না দিলেই ভাল।

ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস

a

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Law Commission Uniform Civil Code Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE