E-Paper

কয়লা থেকে রোদ-হাওয়ায়

ভারতের পুনর্নবীকরণযোগ্য, স্বচ্ছ শক্তির ক্ষেত্রে এক নীরব পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সৌরশক্তি আর বায়ুশক্তির উৎপাদন এখন আর আগের মতো ব্যয়সাধ্য নেই।

সৌম্য সরকার

শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০২৫ ০৮:২৬

ভারতের স্বাধীনতার পর সাত দশক ধরে শক্তির প্রয়োজন নীরবে জুগিয়েছে কয়লা। জ্বালানি আমদানি করার প্রয়োজনকে অনেকটাই সামাল দিয়ে এসেছে ভারতে কয়লার প্রাচুর্য। কিন্তু বিশ্ব বদলাচ্ছে, পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ুর। যা ছিল কয়লার আশীর্বাদ, তা দেখা দিচ্ছে সঙ্কট হয়ে— ভারত এখন উষ্ণায়ন সৃষ্টিকারী গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়।

অথচ, শক্তি উৎপাদনের প্রয়োজন বেড়েই চলেছে। একের পর এক তাপপ্রবাহ যেমন বিদ্যুতের চাহিদা বাড়াচ্ছে, তেমনই নদীগুলিতে জল কমিয়ে আনছে। ফলে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিকে শীতল করার জলের অভাব তীব্র হচ্ছে। ঘন ঘন প্রবল বন্যায় ধ্বংস হচ্ছে কয়লা আসা-যাওয়ার প্রধান রাস্তাগুলো। এক সময়ে জলবিদ্যুৎকে ভাবা হয়েছিল কয়লার বিকল্প, স্বচ্ছ শক্তির উৎস। এখন হিমবাহগুলি ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে, বর্ষাও আর আগের মতো নিয়মিত আসে না। আমাদের শক্তির পরিকাঠামো তৈরি হয়েছিল জলবায়ুর স্থিতিশীলতা ধরে নিয়ে। আজকের অস্থির আবহাওয়ার মোকাবিলার প্রস্তুতি তার নেই।

তবে ভারতের পুনর্নবীকরণযোগ্য, স্বচ্ছ শক্তির ক্ষেত্রে এক নীরব পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সৌরশক্তি আর বায়ুশক্তির উৎপাদন এখন আর আগের মতো ব্যয়সাধ্য নেই। সারা ভারতেই তা সুলভ হয়েছে। বাড়ির ছাদে সৌরবিদ্যুৎ সরঞ্জাম থেকে একটি এলাকার জন্য একটি ‘মিনি গ্রিড’ বা শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা যেন অনেক বেশি মানুষের পছন্দ-নির্ভর, গণতান্ত্রিক। বাসিন্দারা তাঁদের রুচি অনুসারে বেছে নিতে পারেন আগামী দিনের শক্তির উৎস। ২০২৭ সালের মধ্যে ১৮০ গিগাওয়াট পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়েছিল ভারত, এখনই সেই মাইলফলক পেরিয়ে গিয়েছে। নয়া জাতীয় বিদ্যুৎ নীতির (২০২৪-২০৩২) পরবর্তী লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট উৎপাদন।

তবু আজও ভারতের শক্তির চাহিদার ৭০ শতাংশ মেটাচ্ছে কয়লা। স্বচ্ছ শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা, আর বাস্তব উৎপাদন, এ দুটোর মধ্যে ফারাক ঘোচানো যাবে কী করে, সে প্রশ্নই এখন এসেছে ভারতের শক্তি নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনার কেন্দ্রে। ‘নিরাপত্তা’ বলতে বোঝানো হয় তিনটি বিষয়— শক্তির উৎসকে হতে হবে নির্ভরযোগ্য, সুলভ এবং সুস্থায়ী। এ থেকেই বোঝা যায় যে, কয়লার কবল থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের স্বাগত জানাতে হবে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিকে। কয়লায় বিনিয়োগ চালিয়ে গেলে এমন সম্পদ তৈরি হবে, যা আগামী দিনে মূল্যহীন হয়ে পড়বে। বাতিল চিন্তার সৌধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। বিশ্ব এগিয়ে যাবে স্বচ্ছ শক্তির দিকে। পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি কেবল খরচই বাঁচাবে না, প্রচুর নতুন কাজ তৈরি করবে, ফুসফুসকে সুরক্ষা দিয়ে চিকিৎসার খরচ কমাবে, বিশ্বের জ্বালানি বাজারের ওঠাপড়া থেকে সুরক্ষিত রাখবে অর্থনীতিকে।

কিন্তু পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ কি কয়লার উপর নির্ভরতা থেকে সহজে সরতে চাইবে? এ রাজ্য বহু প্রজন্ম ধরে কয়লাকে আঁকড়ে রয়েছে। রানিগঞ্জের খনি থেকে আসানসোলের শিল্পাঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি নির্মিত হয়েছে কয়লা উত্তোলন আর তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনকে ঘিরে। তার ফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি— ধোঁয়াশা-ভরা আকাশে ঝাপসা সূর্য, দূষণে ঘোলাটে জল, জনস্বাস্থ্য নিয়ে নানা উদ্বেগ। কিন্তু কয়লা থেকে খুব দ্রুত সরবে না রাজ্যের নজর, বীরভূমের ডেউচা-পাঁচামি প্রকল্প তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন পর্ষদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বীরভূমের কয়লা ব্লক কাজ শুরু করলে বছরে চার কোটি টন কয়লা মিলবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য, যা পশ্চিমবঙ্গকে জ্বালানির ক্ষেত্রে স্বনির্ভর করবে। যার অর্থ, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান বিশ্বের বিপরীতমুখী। একই সঙ্গে কয়লার বিকল্প জ্বালানির অধিক ব্যবহারের কথা বলা হবে, আবার নতুন নতুন জমি খুঁড়ে কয়লার সন্ধান করা হবে, এ কি বিশ্বাসযোগ্য?

বর্তমানে গুজরাত তার মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের ২২ শতাংশ পায় সৌরবিদ্যুৎ এবং বায়ুবিদ্যুৎ থেকে, তামিলনাড়ু পায় ২৬ শতাংশ, কর্নাটক ৩৭ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গ সেখানে মোট বিদ্যুৎ খরচের ১০ শতাংশও পুনর্নবীকরণযোগ্য উৎস থেকে পাচ্ছে না। এক অসরকারি গবেষণা দেখিয়েছে, বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিকে বাদ দিলেও পশ্চিমবঙ্গে পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ক্ষমতা রয়েছে, তার মাত্র ৮ শতাংশ বাস্তবে কাজে লাগানো হচ্ছে। এক সময়ে সারা ভারতের মননে নতুন চিন্তার আবাহন করেছিল যে রাজ্য, আজ তা পিছিয়ে পড়ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন দ্বিগুণ করার যে লক্ষ্য নিয়েছে জাতীয় নীতি, কী ভাবে তার ধারেকাছে যাবে পশ্চিমবঙ্গ, তার কোনও দিশাই দেখা যাচ্ছে না। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সৌর, বায়ুবিদ্যুতে দ্রুত সরে যাচ্ছে অন্য রাজ্য, অন্য দেশ। পশ্চিমবঙ্গ যেন তার মূক দর্শক।

অথচ, যত দেরি হবে, তত কয়লা থেকে স্বচ্ছ জ্বালানিতে উত্তরণ হয়ে উঠবে আরও খরচসাপেক্ষ। উৎপাদন-সহ নানা ব্যবস্থা তাতে আরও বেশি ব্যাহত হবে। দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষের কাছে স্বচ্ছ জ্বালানির সুবিধে পৌঁছে দেওয়া আরও কঠিন হবে। সক্রিয় হওয়ার এই হল সময়। কয়লাকে আঁকড়ে না থেকে স্বচ্ছ জ্বালানির সঙ্গে নতুন সাহচর্যের কাহিনি রচনা করতে হবে রাজ্যকে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

coal Power Supply

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy