দিল্লি নির্বাচনের প্রচারে দুর্নীতি নিয়ে বিস্তর কথা হয়েছিল। আম আদমি পার্টির সরকারের আবগারি ও অন্যান্য দুর্নীতির কথা বিজেপি প্রচার করে; আপ-ও পাল্টা পোস্টার ছাপিয়ে বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করে। অন্য দিকে, দু’পক্ষই পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতিতে নামে— প্রতিশ্রুতির তালিকা করতে বসলে লেখার শব্দসংখ্যায় কুলোবে না। ভোটের ফল দেখাল, বিজেপির প্রতিশ্রুতি ভোটারদের বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে।
ভোটদানের হারে স্পষ্ট যে, দিল্লির উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজের একটা বড় অংশ ভোটের দিন বুথমুখী হননি। স্পষ্টতই বিজেপির আশ্বাস আপ-এর মূল ভোটব্যাঙ্ক গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের মন ছুঁয়ে গেছে। একে অপরের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির প্রচার গৌণ, প্রতিশ্রুতির প্রচার মুখ্য হয়েছে। দুর্নীতি হয়, এবং তা প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে ওঠে, অথচ ভোটে তার প্রভাব পড়ে না— কেন এমন হয়?
এমন হতে পারে যে, উপরতলার রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতির খবর নীচের তলার সাধারণ ভোটারের কানে পুরোপুরি পৌঁছয় না। রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রের অভাব থাকলে, মিডিয়া যথেষ্ট কার্যকর না হলে এই সম্ভাবনা আরও বাড়ে। অন্য একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হল, দুর্নীতির সঙ্গে মানুষের আপস করে নেওয়ার মানসিকতা। যদি সরকারি সুযোগসুবিধা বা গণদ্রব্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনও দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা বা দল সহায়ক হয়, তবে ভোটাররা তাঁকে ভোট দিতে দ্বিধা করেন না।
অর্থনীতির পরিভাষায়, পরিবেশ দূষণের মতোই দুর্নীতি মানুষের কাছে ‘ব্যাড’ বা মন্দ দ্রব্য, কিন্তু ‘ডেলিভারি মেকানিজ়ম’ যদি ভাল হয়, তবে কিছুটা ব্যাড মানুষ সয়ে নেন। দুর্নীতি কাম্য নয়, কিন্তু কাজের গতি ত্বরান্বিত করতে বা সরকারি সুযোগসুবিধা পাওয়ার স্বার্থে, কাম্য দুর্নীতির স্তর অবধি দুর্নীতি মেনে নেওয়া ভোটারেরকৌশলগত সিদ্ধান্ত।
কতটা দুর্নীতি হচ্ছে, তার নৈর্ব্যক্তিক পরিমাপ সাধারণ মানুষের কাছে থাকা প্রায় অসম্ভব। ফলে, কতখানি দুর্নীতি হচ্ছে বলে মানুষ মনে করছেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বিশ্বব্যাপী ৬৬টি দেশে করা সমীক্ষার অঙ্গ হিসাবে ২০২৩ সালে ভারতের ৮টি রাজ্যে এক সমীক্ষা করা হয়। উত্তরদাতাদের কাছে দুর্নীতির মাত্রা সম্বন্ধে মতামত চাওয়া হয়— ভারতে দুর্নীতি নেই মনে করলে উত্তরদাতা ‘১’ বলবেন, এবং সর্বোচ্চ হারে দুর্নীতি আছে মনে করলে ‘১০’ বলবেন। দুর্নীতির মাত্রা এর মধ্যবর্তী কোনও একটি স্তরে আছে বলে মনে করলে ২ থেকে ৯-এর মধ্যে যে সংখ্যাটি মানানসই বলে মনে হবে, সেটি বলবেন উত্তরদাতা। দেখা গেল, এই সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সব উত্তরদাতার দেওয়া নম্বরের গড় ৭.৭। অর্থাৎ, মানুষ মনে করেন যে, দেশে দুর্নীতির প্রভাব ও বিস্তার যথেষ্ট। সর্বোচ্চ সংখ্যক উত্তরদাতা— সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৩১%— পুরোপুরি ১০ দিলেন; অর্থাৎ, তাঁদের মতে, ভারতে দুর্নীতি লাগামছাড়া। ১ থেকে ৫-এর মধ্যে নম্বর দিলেন মাত্র ১৬% উত্তরদাতা; ৬ থেকে ১০-এর মধ্যে দিলেন বাকি ৮৪%।
উপরতলার রাজনীতিক-প্রশাসক, ব্যবসায়ী, নিচুতলার (পঞ্চায়েত, মিউনিসিপ্যালিটি স্তরের) পুঁচকে নেতা-আমলা, নাগরিক সেবা প্রদানকারী (যেমন পুলিশ, সরকারি কর্মচারী), মিডিয়া মালিক ও সাংবাদিক— প্রত্যেকটি শ্রেণির মানুষ দুর্নীতিতে যুক্ত কি না, সে বিষয়ে উত্তরদাতাদের মত জানতে চাওয়া হয়। এই পাঁচটি শ্রেণির সবাই কম-বেশি দুর্নীতিতে যুক্ত বলে মতদাতারা মনে করেন— তবে, তাঁদের মধ্যে নাগরিক পরিষেবা প্রদানকারীরা সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিতে যুক্ত, এবং মিডিয়ামালিক ও সাংবাদিকরা সবচেয়ে সৎ বলে উত্তরদাতারা মনে করেন।
তথ্যগুলো প্রমাণ করে মানুষ দুর্নীতি সম্বন্ধে সচেতন। তথ্যের অভাব অসৎ রাজনীতিবিদদের ভোটে জেতার কারণ হতে পারে না। বরং কাটমানি খেলেও পাড়ার রাস্তার হাল-হকিকত, বাতিস্তম্ভের আলো, রেশনের জোগান, মানুষের হাতে সরাসরি নগদ টাকার ডেলিভারি ভোটারের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। রাজনৈতিক দলগুলোও ভোটারের মনের খবর রাখে। তাই রাজ্যে রাজ্যে জনমোহিনী রেউড়ির ছড়াছড়ি। পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ্মীর ভান্ডার, গুজরাতে নমো শ্রী, মধ্যপ্রদেশে লাডলী বহনা, ওড়িশায় সুভদ্রা যোজনা— তালিকা দীর্ঘায়িত করা অর্থহীন।
ঘটনা হল, অকুশলী ব্যবস্থায় দুর্নীতি কাজের গতি ত্বরান্বিত করতে পারে, কিন্তু ঘুষ দেওয়া-নেওয়া সমাজে প্রচলিত হয়ে গেলে, ঘুষ দিলে তবেই সরকারি পরিষেবা পাওয়া যাবে এ রকম সম্ভাবনা দেখা দেয়। সরকারি কাজের বরাত পাওয়ার ক্ষেত্রেও দক্ষ উৎপাদকের চেয়ে সর্বাধিক ঘুষ দিতে সক্ষম উৎপাদক প্রাধান্য পেতে পারে। আর এ ভাবে সামাজিক উন্নয়নের প্রকল্পগুলোতে না হয়ে দুর্নীতিগ্রস্তদের পক্ষে সুবিধাজনক প্রকল্পগুলোতে সম্পদের বণ্টন হলে গরিবরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
সরকারি সাহায্য পেতে গরিব মানুষকে তাঁদের আয়ের একটা বড় শতাংশ খরচ করতে হয়। গরিবদের ক্ষতি বেশি অথচ তাঁদের সমর্থনেই দুর্নীতিগ্রস্তদের করে খাওয়া— এ ধাঁধার উত্তর যে ‘ডেলিভারি মেকানিজ়ম’-এ, রাজনীতিবিদরা তা জানেন। তাই দুর্নীতিমুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ আসবে, না দুর্নীতিযুক্ত সমাজই আমাদের ভবিতব্য— সময়ই এর উত্তর দেবে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)