E-Paper

শিশুর প্রাণ বাঁচাতে দায়বদ্ধ

স্বাস্থ্যের সামাজিক নির্ধারকগুলির প্রতি উপেক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং তজ্জনিত সমস্যার ক্রমাগত বৃদ্ধি বিপুল বিপন্নতা তৈরি করছে। সর্বোপরি, দু’দেশেই সুস্বাস্থ্য ও সামগ্রিক উন্নয়নের নাগাল পাচ্ছেন না অগণিত মানুষ।

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০২৫ ০৬:২১
Share
Save

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক সংগঠন, ইন্টারন্যাশনাল পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন সম্প্রতি একটি সম্মেলন করল মেক্সিকো সিটিতে (৯-১১ মে)। এই সম্মেলন থেকে ভারতের ৬ জন এবং পাকিস্তানের ৫ জন চিকিৎসক যৌথ ভাবে একটি বিবৃতি দেন। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল তা প্রকাশ করেছে ২৮ মে। এই বিবৃতিতে একই সঙ্গে নিন্দা করা হয়েছে ভারতের পহেলগামে নিরীহ ভ্রমণকারীদের সন্ত্রাসবাদী হত্যা, এবং বালুচিস্তানে যাত্রিবাহী ট্রেন হাইজ্যাক করা, দুটো ঘটনারই। এই চিকিৎসকরা স্মরণ করিয়েছেন যে, ভারত এবং পাকিস্তান দু’টি দেশেই জনস্বাস্থ্যের সঙ্কট তীব্র।

স্বাস্থ্যের সামাজিক নির্ধারকগুলির প্রতি উপেক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং তজ্জনিত সমস্যার ক্রমাগত বৃদ্ধি বিপুল বিপন্নতা তৈরি করছে। সর্বোপরি, দু’দেশেই সুস্বাস্থ্য ও সামগ্রিক উন্নয়নের নাগাল পাচ্ছেন না অগণিত মানুষ। ন্যায় করতে হলে নানা গোষ্ঠীর মধ্যে ফারাক কমিয়ে আনতে হবে। এ সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু’টি দেশ সামরিক এবং পারমাণবিক অস্ত্রের খাতে ব্যয় বাড়িয়েই চলেছে।

একটি গোটা প্রজন্ম ইতিহাসের বিকৃত ব্যাখ্যা, ভ্রান্ত মূল্যবোধ, নজিরহীন উগ্র জাতীয়তার বোধ নিয়ে বড় হচ্ছে। জ্বালানি জোগাচ্ছে চলচ্চিত্র, সমাজমাধ্যম। এই শিশুচিকিৎসকরা বলেছেন, “স্বাস্থ্যপরিষেবার সঙ্গে যুক্ত পেশাজীবী মানুষ হিসাবে আমরা অবশ্যই দীর্ঘ সংঘর্ষের বিপদ, এবং তার ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়া নিয়ে কথা তুলব। এই দু’টি দেশেরই শিশুমৃত্যুর হার কাছাকাছি দেশগুলোর থেকে অনেক বেশি। শিশুচিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা পেশাদার হিসাবে আমরা সংঘর্ষ এবং এর পরিণতির বিরুদ্ধে মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ তুলছি।”

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের বর্তমান পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের এই অবস্থান নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। তবে চিকিৎসকদের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নতুন নয়। যুদ্ধবিরোধী হিসাবে সুপরিচিত জার্মান চিকিৎসক রুডলফ ভিরচাউ বলেছিলেন, চিকিৎসা-বিজ্ঞান একটি সমাজবিজ্ঞান, এবং রাজনীতি একটি প্রসারিত চেহারায় চিকিৎসাব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই না। সমাজবিজ্ঞান হিসাবে, মানুষের বিজ্ঞান হিসাবে, সামাজিক সমস্যাকে চিহ্নিত করা, এবং সেগুলোর সমাধানের চেষ্টা করতে চিকিৎসা-বিজ্ঞান দায়বদ্ধ।

স্পেনে জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী, স্বৈরতন্ত্রী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য (১৯৩৬-১৯৩৯) একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী (‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড’) তৈরি হয়েছিল। নোবেলজয়ী লেখক আর্নস্ট হেমিংওয়ে-সহ বহু লেখক, শিল্পী, কৃতবিদ্য মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের তরফে নেহরু, মুলক রাজ আনন্দ ও কৃষ্ণ মেননের উদ্যোগে অ্যাম্বুল্যান্স পাঠানো হয়েছিল। এমনই বৃহৎ ছিল ফ্যাসিবাদ-বিরোধী প্রতিরোধের এই আন্তর্জাতিক বর্ণালি। হেলেন গ্রাহাম স্পেনের গৃহযুদ্ধ বিষয়ে তাঁর বইয়ে (দ্য স্প্যানিশ সিভিল ওয়র: আ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাকশন) বলেছেন, স্পেনের এই ফ্যাসিবাদী অভ্যুত্থানের তুলনা করা চলে ইটালিতে মুসোলিনির অভ্যুত্থান (১৯২২) এবং জার্মানিতে হিটলারের অভ্যুত্থানের (১৯৩৩) সঙ্গে। একই রকমের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটেছিল স্পেনেও। ছিয়াশিটি দেশ এবং উপনিবেশ থেকে মুক্তিকামী মানুষ এই ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন ডাক্তাররাও। মেডিক্যাল হিস্ট্রি জার্নালে (২০২২) প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, পোল্যান্ড থেকে আগত চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল ৫৬, জার্মানি থেকে ৩৯, আমেরিকা থেকে ৩৬, হাঙ্গেরি থেকে ২৬, ফ্রান্স ২৫ এবং রোমানিয়া ২৫। কানাডা থেকে এসেছিলেন সুবিখ্যাত চেস্ট সার্জন নর্মান বেথুন।

গত বছর নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ (অক্টোবর ৯, ২০২৪) প্রকাশিত হয়েছে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন, যেখানে পঁয়ষট্টি জন ডাক্তার, নার্স এবং প্যারামেডিক বর্ণনা করেছেন, তাঁরা গাজ়ায় কী দেখেছেন। যুদ্ধের নৃশংস পরিণতি তুলে ধরে তাঁরা বলেছেন, এই শিশুঘাতী যুদ্ধ তাঁরা চান না।

ইতিহাস আমাদের স্মরণ করায়, ২০০২ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ প্রকাশিত হয়েছিল শামিম-উর-রহমান এবং গণপতি মুদুর-এর লেখা প্রবন্ধ, যাতে বলা হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের চিকিৎসকরা যৌথ ভাবে পারমাণবিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচার করছেন। নানা দেশের চিকিৎসক এবং তাঁদের সংগঠনের যুদ্ধ-বিরোধী অবস্থান নিরলস, সুদৃঢ়। ১৯৮৫ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিজ়িশিয়ানস ফর দ্য প্রিভেনশন অব নিউক্লিয়ার ওয়র’। আর একটি সংগঠন ‘ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার্স’: যেখানেই যুদ্ধ বা সংঘর্ষে মানুষ আক্রান্ত, সেখানেই তার সদস্যরা পৌঁছে যান চিকিৎসার সরঞ্জাম, ত্রাণসামগ্রী নিয়ে। ১৯৯৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করার সময়ে সংগঠনের মুখপাত্র জেমস অরবিনস্কি বলেছিলেন, “মানবতাবাদী কাজ কেবল বদান্যতা কিংবা দয়াদাক্ষিণ্য নয়। এর লক্ষ্য হল প্রচণ্ড অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে স্বাভাবিকতার একটি পরিসর তৈরি করা।” ২০১৮ সালের অগস্টে ইয়েমেন-এর গৃহযুদ্ধে ‘ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার্স’-এর হাসপাতালগুলি আক্রান্ত হয়।

প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই চিকিৎসকরা যুদ্ধের বিরোধিতা করে চলেছেন। ভারত ও পাকিস্তানের ১১ জন শিশুচিকিৎসক সেই কাজটাই করলেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Disease Medical Health

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।