Advertisement
E-Paper

কেন এই প্রত্যাবর্তন

মেয়েদের তুলনায় কাজের জগতে, রোজগারের অঙ্কে, পুরুষের অবস্থান আজ তেমন কিছু এগিয়ে নেই। খানিকটা সেই ক্ষোভ থেকেই সম্ভবত পুরুষরা সমর্থন করছেন এমন এক ব্যক্তিকে, যিনি মেয়েদের দাবিয়ে রাখার জন্য সুপরিচিত।

সমর্থন: আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটাররাও ট্রাম্পকে সম্পূর্ণ বিমুখ করেননি। ৬ নভেম্বর ২০২৪, পাম বিচ।

সমর্থন: আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটাররাও ট্রাম্পকে সম্পূর্ণ বিমুখ করেননি। ৬ নভেম্বর ২০২৪, পাম বিচ। ছবি: পিটিআই।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:৫২
Share
Save

গত বছর যে বিষয়গুলি নিয়ে সারা বিশ্বে লোকে উত্তেজিত তর্ক-বিতর্ক চালিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তার অন্যতম ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন। ‘ট্রাম্প কি ফের জিততে পারেন?’ এই প্রশ্ন নিয়ে তোলাপড়া শুরু হয়েছিল জুলাই মাস থেকে, আর নভেম্বরে ফল বেরোনোর পর থেকে চলছে আলোচনা, কী করে জিতলেন ট্রাম্প? সম্ভবত তার সবচেয়ে বড় কারণ ‘এলিট’ বা অভিজাত শ্রেণির প্রতি আমেরিকার অধিকাংশ মানুষের রাগ ও বিরক্তি। উচ্চবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত, উদার মনোভাবাপন্ন কিছু ব্যক্তি দেশের বাদবাকি মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির পথ তৈরি করে দেবে, সে ভরসা হারিয়ে ফেলেছেন আমেরিকার অধিকাংশ মানুষ। এই এলিট-বিরোধিতা আমেরিকার এ বারের নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এই ঝোঁক স্বল্পশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গদের মধ্যেই বেশি। তাঁদের ধারণা, অর্থনীতিতে নিশ্চয়ই কোনও একটা বড় সঙ্কট দেখা দিয়েছে, যার জন্য এশিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা লোকেদের তুলনায় তাঁদের রোজগার, সামাজিক অবস্থান নীচে নামছে। এর জন্য তাঁরা দায়ী করছেন অভিবাসন, বিশ্বায়ন, শিল্পে উচ্চ-প্রযুক্তি প্রয়োগের নীতিকে। এই সব নীতি যাঁরা সমর্থন করেন, তাঁদেরকেই ‘এলিট’ ভাবেন ট্রাম্প-সমর্থকরা।

ট্রাম্প অত্যন্ত ধনী, কিন্তু তাঁর হাবভাব পালিশ-করা নয়। তিনি কথাবার্তায় চৌকস নন, প্রায়ই বাক্যগুলো ঠিকমতো শেষ করেন না। কালোদের নিয়ে, মেয়েদের নিয়ে ভুলভাল রসিকতা করেন, নিজের অপকীর্তির বড়াই করেন, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাহাদুরি নেন। এ সব করে তিনি পরিশীলিত, সুমার্জিত ‘এলিট’-দের থেকে নিজের দূরত্বের সঙ্কেত পাঠান। এর ফলে অনেক নিম্নবিত্ত মেয়েও মনে করেছেন যে, কমলার চেয়ে ট্রাম্পই তাঁদের কাছের মানুষ। সুবেশা, সুভদ্র কমলা সব মেয়ের প্রতিনিধি হতে পারলেন না (যদিও ৫৫% মেয়ে তাঁকেই ভোট দিয়েছেন), ক্যালিফোর্নিয়ার এলিটদের প্রতিনিধি হয়েই রয়ে গেলেন।

জো বাইডেন এবং কমলার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় নালিশ অবশ্য অর্থনীতি নিয়ে। অধিকাংশ সমীক্ষায় ভোটাররা তাঁদের উপর অর্থনীতির দুর্বলতার দায় চাপিয়েছেন। তথ্য কিন্তু বলছে, আমেরিকার অর্থনীতি আদৌ দুর্বল নয়। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। কোভিডের আগে ২০২৪ সালের জিডিপি সম্পর্কে যা পূর্বানুমান করা হয়েছিল, এ বছরের জিডিপি তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। কর্মনিযুক্তির হার এ-যাবৎ সর্বোচ্চ হারের কাছাকাছি। উৎপাদন-কর্মী, এবং অন্য নিচুতলার কর্মীদের প্রকৃত মজুরি (অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধির হিসাব ধরে প্রাপ্ত মজুরি) বাইডেনের শাসনকালে ক্রমাগত বেড়েছে। তবে অভিযোগ কেন?

হয়তো আমেরিকার সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন যে, দীর্ঘমেয়াদে তাঁরা লাভবান হননি। সত্তরের দশকে শ্রমজীবী মানুষদের প্রকৃত মজুরির যা ক্রয়ক্ষমতা ছিল, নানা ওঠাপড়ার পরে ২০২০ সাল নাগাদ আবার সেখানেই এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ এর মধ্যে আমেরিকার মাথাপিছু জিডিপি হয়ে গিয়েছে দ্বিগুণ। ঐতিহাসিক ভাবে আমেরিকা এমন একটা দেশ, যেখানে প্রতি প্রজন্ম তার আগের প্রজন্মের চেয়ে উন্নতি করে এসেছে। মুষ্টিমেয় লোকের পৌষ মাস, বাকিদের সর্বনাশ— এই দাঁড়াল মুক্ত বাণিজ্যের ফল। একই কারণে ইউরোপেও অতি-দক্ষিণপন্থী দলগুলি নির্বাচনে জিতছে। এলিট সম্প্রদায় মানুষকে বুঝিয়েছিল যে, বাণিজ্য মুক্ত হলে গোড়ায় দেশের অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগতে পারে, কিন্তু শেষ অবধি ক্ষতির চেয়ে লাভ হবে বেশি। কথাটা ভুল নয়— সত্যিই বিশ্বায়িত অর্থনীতি থেকে দেশের সব স্তরে মানুষের লাভ হতে পারত। কিন্তু তার জন্য চেষ্টা করা হল না। যাঁদের চাকরি বিশ্বায়নের ফলে চলে গেল তাঁদের নতুন চাকরি, নতুন করে সুষ্ঠু, সুন্দর জীবন খুঁজে নিতে সাহায্য করা হল না, যেমন ডেনমার্কে হয়। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, পাশাপাশি রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক ভূমিকা সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে। কৃত্রিম মেধার ব্যবহার কাজের জগতে কী বিপুল সঙ্কট তৈরি করতে চলেছে, তার আভাসও পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। উদারবাদী ‘এলিট’ শ্রেণির উপর ভরসা হারিয়ে মানুষ তাই ঝুঁকছে রক্ষণশীল অতি-দক্ষিণপন্থীদের দিকে।

আমেরিকার নির্বাচনের আলোচনায় এলিট-বিদ্বেষের সঙ্গে বলতে হয় নারী-বিদ্বেষের কথাও। ট্রাম্প নিজে প্রায় ধারাবাহিক ভাবে মেয়েদের যৌন হয়রানি করেছেন। তিনি দাবিও করেন যে, সে হক তাঁর আছে, কারণ তিনি তারকা। নির্বাচিত হওয়ার পরে যাঁদের তিনি বড় বড় পদে বসাচ্ছেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ কম নয়। ইলন মাস্ক, যিনি ট্রাম্প প্রশাসনকে ‘দক্ষ’ করার দায়িত্ব পেয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে মহিলা সহকর্মীদের যৌন হেনস্থা, বিষাক্ত কর্মসংস্কৃতি তৈরির অভিযোগ দায়ের হয়েছে। ট্রাম্পের মনোনীত প্রতিরক্ষা সচিব পিটার হেগসেথ নিজের চাকরি বাঁচাতে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের রফা করেছিলেন আদালতের বাইরে, টাকার বিনিময়ে। ট্রাম্পের মনোনীত অ্যাটর্নি জেনারেল ম্যাট গেটজ় মেয়ে পাচারে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এঁদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে ট্রাম্প যেন বার্তা পাঠাচ্ছেন— মেয়েদের অসম্মান করেছেন তো কী এমন করেছেন? তাতে উল্লসিত সেই সব লোক, যারা মনে করে যে, মেয়েদের বড্ড বাড় বেড়েছে। আমেরিকার সমাজে এখন নারী-বিদ্বেষী নানা গোষ্ঠী দেখা যাচ্ছে। যেমন, অনিচ্ছায় সঙ্গীহীন (ইনভলান্টারি সেলিবেট, বা ‘ইন সেল’) পুরুষদের দাবি যে, মেয়েরা প্রত্যাখ্যান করলে তাঁদের ‘শাস্তি’ দিতে ধর্ষণ-হত্যাও করা চলে। আবার, মেয়েদের একাংশও সাবেক গিন্নি (‘ট্র্যাড ওয়াইফ’) হতে মেতে উঠেছেন। নানা সাংসারিক কাজের ভিডিয়ো, এমনকি বাথরুম পরিষ্কার করার ছবিও সমাজমাধ্যমে পোস্ট করছেন। এই রক্ষণশীল সাবেকিয়ানা ট্রাম্পকে জিততে সাহায্য করেছে।

সমাজের এই ঝোঁকের শিকড় অর্থনীতিতে। আমেরিকার নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর রোজগার বেড়েছে, তবে তার প্রধান কারণ, মেয়েরা কাজে যোগ দিচ্ছেন বেশি। যদিও নিচুতলার কাজগুলোতে এখনও পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের মজুরি ও পদমর্যাদা কম, তবু মেয়েদের রোজগার আগের তুলনায় বেড়েছে। সেই সঙ্গে, মেয়েরা পড়াশোনাতেও এগিয়ে যাচ্ছেন— হাই স্কুল শেষ করা, কলেজে ভর্তি হওয়া এবং কলেজ শেষ করা, এ সবের হার মেয়েদের মধ্যেই বেশি। মেয়েদের মধ্যে শৃঙ্খলা, গুছিয়ে কাজ করার ক্ষমতা বেশি দেখা যাচ্ছে। তুলনায় পুরুষদের রোজগার তেমন বাড়েনি। নিজেদের মনের ঝোঁক বা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা তাঁদের মধ্যে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই অক্ষমতাকে আজকাল ‘অসুখ’ বলে ধরা হচ্ছে। মোট কথা, মেয়েদের তুলনায় কাজের জগতে, রোজগারের অঙ্কে, পুরুষের অবস্থান আজ তেমন কিছু এগিয়ে নেই। খানিকটা সেই ক্ষোভ থেকেই সম্ভবত পুরুষরা সমর্থন করছেন এমন এক ব্যক্তিকে, যিনি মেয়েদের দাবিয়ে রাখার জন্য সুপরিচিত। হিস্প্যানিক, কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের একটা বড় অংশ এই কারণেই ট্রাম্পকে সমর্থন করেছেন।

এলিট-বিদ্বেষ, নারী-বিদ্বেষের পরে অবশ্যই বলতে হয় অভিবাসী-বিদ্বেষের কথা। এই মনোভাব হয়তো অকারণ নয়। ভেনেজ়ুয়েলা, নিকারাগুয়া, এল সালভাডোর, গুয়াতেমালা, ইকুয়েডর, মেক্সিকোতে মাদক মাফিয়ার লাগামহীন হিংসার ফলে হাজার-হাজার মানুষ পালিয়ে আসছেন আমেরিকায়। এত শরণার্থীর চাপ কে-ই বা নিতে চায়? ট্রাম্প মওকা বুঝে আমেরিকার সব অর্থনৈতিক সমস্যার দায় চাপিয়ে দিচ্ছেন অভিবাসীদের ঘাড়ে। তথ্য-পরিসংখ্যান অবশ্য বিশ্বের সর্বত্রই দেখাচ্ছে যে, কায়িক শ্রম, স্বল্প দক্ষতার কাজগুলোতে অভিবাসীদের নিয়োগ করলে দেশের নাগরিকদের মজুরি কমে যায় না। কিন্তু সর্বত্রই রাজনৈতিক নেতারা অভিবাসীদের দোষারোপ করেন, কারণ তা জনসমর্থন পাওয়ার সহজ ও কার্যকর উপায়।

ট্রাম্পকে যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁরা ট্রাম্পের কাছ থেকে খুব বড় কিছু আশা করছেন বলে মনে হয় না। তাঁরা ট্রাম্পকে পছন্দ করেন, কারণ তিনি উদার মানবপ্রেমের ফাঁকা বুলি না আওড়ে চাঁছাছোলা কথা বলেন। নিজের পুরুষালি ভাবটা জোরের সঙ্গে জাহির করেন। ট্রাম্প সমর্থকদের আশা, যে ধরনের লোকেদের দ্রুত উন্নতিতে তাঁদের চোখ টাটাচ্ছে— যেমন আমেরিকা-নিবাসী এক শ্রেণির ভারতীয়— ট্রাম্প তাঁদের ঊর্ধ্বগতিতে একটু রাশ টানবেন।অর্থনীতি বিভাগ, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Donald Trump Feminism

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}