Advertisement
২৩ অক্টোবর ২০২৪
P. Thankappan Nair

খালি পায়ের ইতিহাসবিদ

১৯৫৫ সালে কেরলের এর্নাকুলামের এক গ্রাম থেকে নায়ার পা রাখেন এই শহরে, উচ্চশিক্ষা আর চাকরির খোঁজে। তিনি পেশাগত জীবন শুরু করেন এক বেসরকারি সংস্থায় টাইপিস্টের কাজ দিয়ে।

P. Thankappan Nair

—ফাইল চিত্র।

জহর সরকার
শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২৪ ০৮:২৪
Share: Save:

পরমেশ্বরন থনকপ্পন নায়ার বা পি টি নায়ারের প্রধান পরিচিতি, তিনি ছিলেন ‘বেয়ারফুট হিস্টোরিয়ান অব ক্যালকাটা’ বা ‘কলকাতার খালি পায়ের ইতিহাসবিদ’। জন্মসূত্রে মালয়ালি এই ইতিহাসবিদ ৯১ বছর বয়সে কেরলের আলুভায় তাঁর নিজের বাড়িতে মঙ্গলবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। বছর ছয়েক আগে কলকাতার পাট চুকিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন জন্মভূমিতে। আমি হারালাম এক ৪৫ বছরের পুরনো পারিবারিক বন্ধু আর এক অতি প্রগাঢ় কলকাতাপ্রেমী গবেষককে, যিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এই শহরের ইতিহাস সন্ধানে। সেই ১৯৭৯ থেকে বেশ কয়েক দশক ধরে তিনি আমাকে গবেষণার কাজে সাহায্য করেছেন, আর কত নতুন তথ্যই না দিয়েছেন!

১৯৫৫ সালে কেরলের এর্নাকুলামের এক গ্রাম থেকে নায়ার পা রাখেন এই শহরে, উচ্চশিক্ষা আর চাকরির খোঁজে। তিনি পেশাগত জীবন শুরু করেন এক বেসরকারি সংস্থায় টাইপিস্টের কাজ দিয়ে। পরে বিভিন্ন সংবাদপত্রের দফতরেও কাজ করেন। কয়েক বছর পর ভাল মাইনের সরকারি চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তত দিনে তিনি কলকাতার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন; এই মহানগরীর ইতিহাস নিয়ে তাঁর কাজ আরম্ভ করে দিয়েছিলেন। ওই সরকারি পদে যোগ দিলে তাঁকে কলকাতা ছেড়ে যেতে হবে, তাই তিনি সে চাকরি ছেড়ে দিলেন। টাকার প্রলোভনকে দূরে ঠেলে দিয়ে বেছে নিলেন দারিদ্রের জীবনকে। এ রকম বুকের পাটা খুব কম লোকেরই থাকে। প্রকাশকরা অল্পই টাকা দিতেন তাঁকে— তাতেই তিনি সংসার চালিয়ে নিতেন। একটি প্রাচীন রেমিংটন টাইপরাইটার ছিল তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু, প্রাণাধিক প্রিয়।

পি টি পায়ে হেঁটে শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতেন— প্রতিটি রাস্তার, প্রতিটি গলির ইতিহাসের খোঁজে। তার পর তিনি লাইব্রেরি ও আর্কাইভের সংরক্ষিত নথিপত্রের সঙ্গে তা মেলাতেন সত্যতা যাচাই করার জন্য। আমরা যখনই ইতিহাসের খোঁজে এক সঙ্গে বেরিয়েছি, ওঁর সঙ্গে পায়ে হেঁটে পাল্লা দেওয়া আমার পক্ষে বেশ মুশকিলই হত। খুবই লজ্জা পেতাম, কেননা বয়সে তিনি আমার চেয়ে ১৯ বছরের বড়।

আমার মনে পড়ে, থিয়েটার রোডের উপর ইনস্টিটিউট অব হিস্টোরিক্যাল স্টাডিজ়-এ আমরা যখন যেতাম, সেখানে দেখা হত স্বনামধন্য ইতিহাসবিদদের সঙ্গে। এই সংস্থার সভাপতি ছিলেন নিশীথরঞ্জন রায়, আর ইতিহাস নিয়ে আড্ডায় থাকতেন হিতেশরঞ্জন সান্যাল, অনিরুদ্ধ রায়, প্রদীপ সিংহের মতো পণ্ডিতেরা। কোনও বিশেষ তার্কিক আলোচনা হলে পি টি-ও তার মধ্যে যোগ দিতেন। সেই সময় তারাপদ সাঁতরা ও আমি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সেই সব শুনতাম।

ওই সত্তর আর আশির দশকে আধুনিকতার নামে কলকাতায় পুরনো সব বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট ওঠা শুরু হল। কেউ যদি এখন জানতে ইচ্ছুক হন যে, আজকের বহুতল আবাসনগুলির স্থানে আগে কী ছিল, তাঁকে পি টি নায়ারের বই দেখতেই হবে।

পি টি-র আস্তানা ছিল কাঁসারিপাড়া লেনের বইবোঝাই একটি একচিলতে ঘর, যার মাঝে তিনি খেতেন ও শুতেন। বহু দুর্লভ গ্রন্থ তাঁর সংগ্রহে ছিল, যা একমাত্র তিনিই খুঁজে বার করতে পারতেন তাঁর বইয়ের পাহাড়ের মাঝে। ওঁর না ছিল ফোন, না মোবাইল। যদি কেউ দেখা করতে চাইতেন, তাঁকে বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করতে হত যত ক্ষণ না তিনি বাড়ি ফিরতেন। অথবা, কোনও প্রতিবেশীকে খবর দিয়ে রাখতে হত।

সকাল ন’টায় কিছু খেয়ে বাড়ি থেকে দু’কিলোমিটার পথ হেঁটে পৌঁছে যেতেন ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। সারা দিন সেখানেই বসে কাটাতেন বইয়ের সান্নিধ্যে, লাইব্রেরি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত। এই সুবৃহৎ গ্রন্থাগারের বিভিন্ন বিভাগের কোনখানে কোন বই আছে, তা-ও যেন ছিল তাঁর নখদর্পণে। তিনি যখন পুরনো বই থেকে লিখে যেতেন পাতার পর পাতা, তখন কোনও রকম বিঘ্ন ঘটার উপায় ছিল না। শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত আমাদের। কলকাতার ইংরেজ সমাজের ইতিহাসের চলমান অভিধান ছিলেন পি টি।

পি টি-র লেখার ধরনটি ছিল সাধারণ মানুষের জন্য। তিনি বলতেন, যাঁরা অ্যাকাডেমিক, তাঁরা একে অপরের জন্য জটিল ভাষায় লেখেন— তাঁদের লেখা সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। তাই তিনি নিজের মতো করে সরল ভাবে লিখেছেন। তাঁর ইংরেজি হয়তো উচ্চমানের ছিল না, কিন্তু তাঁর লেখায় অনেক তথ্য থাকত যা অন্যদের লেখায় থাকত না। বাঙালি পণ্ডিতেরা অনেক সময় পি টি নায়ারের বাংলা ভাষা না-জানা নিয়ে কিঞ্চিৎ বক্রোক্তি করতেন। তিনি মোটামুটি বাংলা বলতে পারতেন, তবে লিখতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর কাজের পরিধি ও গবেষণার বিষয় ছিল ইংরেজদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস, যা ইংরেজিতে লেখা। তাই বাঙালি গবেষকদের কাজের থেকে ওঁর কাজের ধরন ছিল আলাদা।

নায়ারের লেখা আনুমানিক ৭০টি গ্রন্থের মধ্যে বেশির ভাগই কলকাতার ইতিহাস বিষয়ে। ইংরেজদের সামাজিক জীবনসংক্রান্ত আলোচনায় পাওয়া যায় তাঁদের বন্ধুত্ব ও বিবাদের ইতিহাস। আর দেখা যায় উপনিবেশিতদের সম্পর্কে তাঁদের মনোভাব। উনি মাতৃভাষা মালয়ালমেও প্রচুর লেখালিখি করেছেন। তাঁর গ্রন্থগুলির মধ্যে আমি বিশেষ করে কলকাতার পথের ইতিহাসকে প্রাধান্য দিই ও খুবই নির্ভরযোগ্য মনে করি।

কলকাতা শহর তাঁকে কয়েক বার সম্মান জানিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাঁর আরও প্রাপ্য ছিল। কলকাতা পুরসভা ওঁর দুর্লভ গ্রন্থগুলি নিজস্ব গ্রন্থাগারের জন্য দু’লক্ষ টাকার বিনিময়ে ক্রয় করেছিল নায়ার কলকাতা ছেড়ে কেরলে যাওয়ার আগে। বছর তিনেক আগে আমার সঙ্গে ওঁর শেষ কথা হয় কেরল থেকেই। সেই সময়ে উনি বলেন, লেখালিখির কাজে খুব ব্যস্ত আছেন।

ব্যস্ত মানুষেরও আরামের প্রয়োজন থাকে। ঈশ্বর যেন এ বার ওঁর আত্মাকে আরাম ও শান্তি দেন। না হলে হয়তো স্বর্গে বসে পি টি আবার ঈশ্বরের ইতিহাস নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Kolkata Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE