Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Bangladesh Liberation War

গ্রামের কবরে শুয়ে ওঁরা

হিলি সীমান্ত থেকে প্রায় ৫৭ কিমি দূরে, গঙ্গারামপুর থানার হামজাপুর গ্রাম এখনও ধরে রেখেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। গ্রামের দুই কবরখানায় শুয়ে আছেন বাংলাদেশের একুশ জন মুক্তিযোদ্ধা।

—ফাইল চিত্র।

পুনম মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:১৫
Share: Save:

দিনাজপুরের কথা বলতেই মনে পড়ে পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট সংলগ্ন হিলির কথা। ’৭১-এর ভারত-পাক যুদ্ধের স্মারক হিসাবে হিলিতে এখনও একটি যুদ্ধের ট্যাঙ্ক রাখা আছে। ২৫ মার্চে সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বহু বাঙালি পাড়ি জমিয়েছিলেন দিনাজপুরে, মুক্তিযুদ্ধের সময় দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বহু শরণার্থী শিবির গড়ে ওঠে।

হিলি সীমান্ত থেকে প্রায় ৫৭ কিমি দূরে, গঙ্গারামপুর থানার হামজাপুর গ্রাম এখনও ধরে রেখেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। গ্রামের দুই কবরখানায় শুয়ে আছেন বাংলাদেশের একুশ জন মুক্তিযোদ্ধা। কোনও সরকারি সাহায্য ছাড়াই, গ্রামবাসীদের আর্থিক সহায়তায় কবরস্থান দু’টির রক্ষণাবেক্ষণ হয়। একটিতে ষোলোটি, অন্যটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচটি কবর। আগাছায় ঢাকা, দেওয়ালে নোনা ধরার ছাপ। ফ্যাকাসে দেওয়ালে লেখা মুক্তিযোদ্ধাদের নাম (ছবি)। গ্রামবাসীরাই মূলত বৎসরান্তে এক বার আগাছা পরিষ্কার করেন, পাঁচিলে শহিদদের নাম লিখে রেখেছেন তাঁরাই। একটু হাঁটলেই দ্বিতীয় কবরস্থান, বাঁশবাগানের পাতার স্তূপে ঢাকা। ধূসর দেওয়ালে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম স্পষ্ট পড়া যায় না।

কবরখানা দেখাতে গিয়ে জর্জিস মিঞা, ফজলুল হক, ক্যাপ্টেন ঈদ্রিসের কথা বলেন তোরাপ মিঞা। তোরাপের সঙ্গে আলাপ ট্রেনে, সেই সূত্রেই জানতে পারি দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অজানা কথা। হামজাপুরের পার্শ্ববর্তী তরঙ্গপুর, বাণগড়, চম্পাতুলিতে গড়ে উঠেছিল শরণার্থী ক্যাম্প। মুক্তিবাহিনীর ৭ নম্বর সেক্টরের একটি অংশ ছিল হামজাপুর গ্রামে। দিনাজপুরের দক্ষিণাঞ্চল— বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা ছিল এই সেক্টরের অধীনে। সেক্টর কম্যান্ডার মেজর নাজমুল হক দুর্ঘটনায় নিহত হলে দায়িত্ব নেন মেজর কাজি নুরজ্জামান। ন’টি সাব-সেক্টরের একটি ছিল হামজাপুরে, দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন ঈদ্রিস আলি। যুদ্ধের সময় প্রায় দেড়শো মুক্তিযোদ্ধা তাঁর ক্যাম্পভুক্ত হয়েছিলেন, তাঁর নেতৃত্বে শরণার্থী শিবিরগুলি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বেছে একটি বাহিনী গড়ে তোলা হয়। তোরাপ মিঞার বাবা জর্জিস মিঞা তাঁর বাড়ির বৈঠকখানায় মুক্তিফৌজের অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন। গ্রামের আরও অনেক পরিবার তাঁদের বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর সরঞ্জাম লুকিয়ে রাখতেন।

হামজাপুরের পাশে পুনর্ভবা নদী। গ্রামটি মূল রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে, গাছগাছালিতে ঘেরা ছিল বলে পাকিস্তানি সেনা বহু দিন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের অবস্থান বুঝতে পারেনি। ক্যাম্পটি গড়ে ওঠে বাদুল্লা সরকারের জমিতে। পূর্ব পাকিস্তানের সীমানার কাছে একটি গাছ থেকে পাক সেনা হামজাপুরের উপর নজরদারি চালাত, এতে ক্যাম্পের কাজ বিঘ্নিত হচ্ছিল। মুক্তিবাহিনীর সদস্য আব্দুর রহমান গাছটি মর্টার দিয়ে উড়িয়ে দেন। বাহিনীর মনোবল এতে বেড়ে যায়। পরে হামজাপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভারতীয় সেনার তরফে চামড়ার বুট, পোশাকের ব্যবস্থা হয়। সাত জন দর্জিকে নিয়োগ করা হয়েছিল পোশাক তৈরির কাজে। এই সেক্টরটির নাম হয় টাইগার বাহিনী।

কবরখানার কাছে আলাপ মনসুর আলি মিঞার সঙ্গে। একাত্তরে মনসুর বছর চোদ্দো-পনেরোর কিশোর, ক্যাম্পে সহযোগী হিসাবে কাজ করতেন। এখানেই তাঁর পরিচয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। আনোয়ার তাঁকে তাঁর মায়ের গল্প শোনাতেন। যে দিন শেষ বারের মতো যুদ্ধে যান, মনসুরের হাত ধরে বলেছিলেন তাঁর জন্য দোয়া করতে। ভোরে চিৎকার শুনে ক্যাম্পে ছুটে যান মনসুর; একটা লিচুগাছের নীচে শোয়ানো ছিল আনোয়ারের দেহ, গুলি তাঁর বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে। তখনও প্রাণ ছিল, মনসুরের হাত ধরে আনোয়ার বলেছিলেন, মায়ের সঙ্গে আর তাঁর দেখা হবে না। আনোয়ারের কবর আছে পুনর্ভবা নদীর ধারে কবরস্থানে, আছে ক্যাপ্টেন ঈদ্রিসের কবরও। আছেন ফজলুর রহমান— সীমান্তের কাছে খান সেনাদের একটি বাঙ্কারের কুড়ি জন সদস্যের প্রায় সবাইকে মেরে, তাদের অস্ত্র সংগ্রহ করে ফিরে আসার সময় এক খানসেনার গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়। হামজাপুর ক্যাম্পের তিনিই প্রথম শহিদ।

মুক্তিফৌজের নবনির্বাচিত সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতে তরঙ্গপুরে একটি বড় ক্যাম্প গড়ে ওঠে, ভারতীয় সেনা সেখানে বাংলাদেশি ছেলেদের ট্রেনিং দিত। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস থেকে পদত্যাগকারী সৈনিক আজিজ, শরণার্থী শিবির থেকে ছেলে বেছে তাদের বাহিনীতে যোগদানের কাজে সাহায্য করতেন। হামজাপুরে অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প গড়ে ওঠে, ছিলেন এক জন ডাক্তার ও কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী। যুদ্ধ-ফেরত আহতদের প্রথমে হামজাপুরের অস্থায়ী ক্যাম্পে চিকিৎসা করা হত; অবস্থা আশঙ্কার হলে কর্ণজোড়ায় মুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে যাওয়া হত। গোড়ায় মুক্তিফৌজের সেনারা বিনা বেতনে কাজ করলেও, পরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের তরফে সামান্য বেতনের ব্যবস্থা হয়।

’৭১-এর সেপ্টেম্বরে তাজউদ্দিন আহমেদ হামজাপুর ক্যাম্প পরিদর্শনে এসেছিলেন। গঙ্গারামপুর ও আশপাশের অঞ্চলে ‘খান বাঙালি পালা’ নামক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক খনের গান একদা খুব জনপ্রিয় ছিল। আজ সবই অতীত। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারও এই কবরগুলির অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত কি না, গ্রামবাসীরা জানেন না। এক না-বলা ইতিহাসের সাক্ষী এই গ্রাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE