Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
নতুন শিক্ষানীতিতে ‘দেশজ জ্ঞানচর্চা’র ভাবনা ও তার
National Education Union

ভুল হয়ে যাচ্ছে বিলকুল

শিক্ষার প্রাঙ্গণে ভারতকে হয়ে উঠতে হবে ‘বিশ্বগুরু’, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রোথিত হবে ভারতবর্ষের দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গভীরে।

An image of books

বিতর্ক এবং সমালোচনার ঝড় উঠেছে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া প্রস্তাব সরকারি স্তরে গৃহীত হওয়ার পরে। প্রতীকী ছবি।

শোভনলাল দত্তগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৩ ০৫:৪১
Share: Save:

নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া প্রস্তাব জনসমক্ষে আসার পর থেকেই যে বিতর্ক এবং সমালোচনার ঝড় উঠেছে সেটি আরও গতিপ্রাপ্ত হয়েছে সরকারি স্তরে সেটি গৃহীত হওয়ার পরে। শিক্ষার বেসরকারিকরণ, শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে, আঞ্চলিক ভিন্নতা এবং বিভিন্ন রাজ্যের নিজস্ব চাহিদার বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে একটি এককেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনে প্রয়াসী হওয়া— এ সবের পাশাপাশি অপর যে আপত্তিটি বিরোধীদের পক্ষ থেকে তোলা হচ্ছে সেটি মতাদর্শগত এবং ভিন্নমাত্রিক। বলা হচ্ছে, একটি সামূহিক, কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা গড়ে তোলার ভাবনার সঙ্গে যদি একত্রে পাঠ করা হয় এই দলিলের সেই অনুচ্ছেদগুলি যেখানে ঘোষণা করা হয়েছে যে, শিক্ষার প্রাঙ্গণে ভারতকে হয়ে উঠতে হবে ‘বিশ্বগুরু’, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রোথিত হবে ভারতবর্ষের দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গভীরে— সেখানেই লুকিয়ে আছে হিন্দুত্বের রাজনীতি, যেখানে ভারতীয়ত্ব এবং হিন্দুত্ব সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। অখণ্ড ভারতীয়ত্বের এই ভাবনা গুরুত্বহীন মনে করে প্রতীচ্যের জ্ঞানভান্ডারকে, আর প্রশ্রয় দেয় এক চূড়ান্ত, একরৈখিক বৌদ্ধিক সঙ্কীর্ণতাকে। এই সমালোচনায় শামিল হয়েছেন প্রায় গোটা বিরোধীপক্ষ, কিন্তু এর সবচেয়ে বেশি জোরালো সমর্থক হলেন বামপন্থীরা। কিন্তু এখানেই বোধ হয় একটা বড় রকমের গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

হিন্দু মৌলবাদীরা যে ন্যারেটিভটা প্রতিষ্ঠা করতে চান তার দু’টি দিক হিসাবের মধ্যে রাখা দরকার। এক: দেশজ ভাবনা, দেশজ জ্ঞানচর্চাকে মান্যতা দেওয়া । দুই: এই দেশজ ভাবনাকে সার্বভৌম গণ্য করে তাকে হিন্দুত্বের মোড়কে পরিবেশন করা। দু’টি বিষয় ভিন্নগোত্রীয়, এবং সেটি না বুঝলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন এবং হচ্ছেনও নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির পৃষ্ঠপোষকরা।

প্রথমটির প্রেক্ষাপট ইতিহাস, যার খোঁজ করার জন্য কিন্তু আদৌ এই নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির শরণাপন্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই। উপনিবেশবাদের কবলমুক্ত হয়েও উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই শিক্ষাব্যবস্থা আজও ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণার রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পায়নি। বিকল্প শিক্ষানীতি, বিকল্প শিক্ষাভাবনা, যার সঙ্গে এক জৈবিক সম্পর্ক থাকবে মানুষের নিত্য দিনের বাস্তবতার, যা সক্ষম হবে ইউরোপ নির্ভরতার নাগপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে, এমন ভাবনার শরিক হয়েছেন এ সব দেশের বহু শিক্ষাচিন্তক, কিংবদন্তি রচনা পেডাগজি অব দি অপ্রেসড-এর লেখক ব্রাজিলের পাওলো ফ্রেইরে থেকে শুরু করে অমর্ত্য সেন সবাই। প্রতীচ্যের দর্পণে নির্মিত হবে প্রাচ্যের শিক্ষাভাবনা, এই প্রকল্পের প্রতিস্পর্ধী চিন্তাকে বহুলাংশেই ব্যাপ্তি দিয়েছে উত্তর-উপনিবেশবাদী ভাবনার প্রসার। তারই সূত্র ধরে অ-পশ্চিমি দেশগুলির বহু শিক্ষাবিদ একত্রিত হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বৌদ্ধিক উপনিবেশবাদের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া, কিংবা এখনও অনাঘ্রাত দেশজ জ্ঞানভান্ডারের খোঁজে ব্রতী হয়ে তার পুনরুদ্ধারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, লাটিন আমেরিকার একাধিক দেশের অনেক বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী এই বিপুল কর্মযজ্ঞে শামিল হয়েছেন অবহেলিত এবং বিস্মৃত দেশজ জ্ঞানচর্চার ধারাকে যথোপযুক্ত মান্যতা দিয়ে স্বমর্যাদায় তাকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনে। এই দেশজ জ্ঞানচর্চাকে তাঁরা সম্পৃক্ত করছেন পশ্চিমের জ্ঞানভান্ডারের সঙ্গে, যদিও এই সেতুবন্ধনের কাজটা সহজসাধ্য নয়। পাঠ্যসূচিতে, বিশেষত কলাবিদ্যা এবং সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, অনেক দেশেই এমন উদ্যোগ করা হলেও ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা অনেক বেশি জটিল।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভারতের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে রক্ষণশীলতার প্রভাব এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের দাপট আজও প্রবল মাত্রায় বিদ্যমান। তার পরিণতিতে দেশজ জ্ঞানের ভাবনা কুসংস্কার এবং রক্ষণশীল তারই নামান্তর, এমন ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয়ে প্রগতিবাদী শিক্ষাবিদদের এক বড় অংশ এর বিপ্রতীপে দাঁড় করান বিজ্ঞানমনস্কতা এবং যৌক্তিকতার ভাবনাকে। একই যুক্তিতে এঁদের অনেকের কাছে বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, অরবিন্দ, গান্ধীর মতো আরও অনেকেই বহুলাংশে ব্রাত্য, কারণ এঁরা প্রকারান্তরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পৃষ্ঠপোষক। গোলমালটা এখানেই। প্রথম বিষয়টিকে স্বতন্ত্র ভাবে বিচার না করার কারণে দেশজ জ্ঞান=রক্ষণশীলতা=হিন্দুত্ব এই অভিজ্ঞান কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের পাতা ফাঁদকেই আরও শক্তপোক্ত করে তোলে ।

এখানেই দ্বিতীয় বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, যার বিস্তার দ্বিমুখী। এক: দেশজত্বের নামে হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা নির্মাণ করেন অতিকথাকে আশ্রয় করে এক সার্বভৌম হিন্দু অতীত, যা খারিজ করে দেয় অ-হিন্দু সাংস্কৃতিক ভাবনাকে। দুই: বিবেকানন্দ থেকে গান্ধী, অরবিন্দ থেকে সুভাষচন্দ্র সবাইকে এঁরা সনাতনী হিন্দু ভাবাদর্শের, বীরত্বের, আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চিহ্নিত করে নিজেদের শিবিরে অন্তর্ভুক্ত করেন। তার দৌলতে গান্ধী প্রতিষ্ঠিত হন সনাতনী ভারতীয় আদর্শের, সম্মার্জনী হস্তে পরিচ্ছন্নতার, সুভাষচন্দ্র শৌর্য-বীর্যের, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, বঙ্কিম হিন্দু ভারতীয়ত্বের প্রতীক হিসেবে। এই তথাকথিত আত্তীকরণের ভাবনাকে মান্যতা দিতে গেরুয়া শিবির এঁদের লেখালিখি থেকে স্থান-কাল-নিরপেক্ষ ভাবে বিচ্ছিন্ন কিছু অংশ তুলে নেয়, উপেক্ষা করে উদ্ধৃতির সামগ্রিক প্রেক্ষিত এবং গড়ে তোলে একটি নিটোল রাজনৈতিক ন্যারেটিভ, যেখানে সম্পূর্ণ অস্বীকৃত হয় গান্ধীর ভাবনায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির, বিবেকানন্দ-অরবিন্দ-সুভাষচন্দ্রের চিন্তায় অসাম্প্রদায়িক ভারত-ভাবনার বিষয়গুলি। বঙ্কিমচন্দ্রকে একটিমাত্র উপন্যাস অর্থাৎ আনন্দমঠ-এর ঘেরাটোপে আবদ্ধ করে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করা হয় তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকীর্তি থেকে।

এক দিকে এই বিপরীতমুখী ন্যারেটিভ নির্মাণের গুরুত্বকে বোঝা এবং অপর দিকে এর সঙ্গে দেশীয় জ্ঞানচর্চার কোনও বিরোধ নেই, এই ভাবনাকে মান্যতা দেওয়া— এই দ্বিমুখী দৃষ্টিভঙ্গির প্রবল অভাব পরিলক্ষিত হতে দেখি হিন্দুত্বের বাম-লিবারাল সমালোচকদের এক বড় অংশের মধ্যে। সদর্থক চিন্তার একমাত্র মাপকাঠি যদি হয় যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান, ভারতবর্ষের দেশজ জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সম্পদের এক বড় অংশই তা হলে আমাদের চর্চার বাইরে থেকে যাবে, যার পূর্ণ সুযোগ নেবেন নতুন শিক্ষানীতির প্রবক্তারা।

আবার এর বিপরীতে যাঁদের অবস্থান, তাঁদের নিয়েও সমস্যা আছে। হিন্দুত্বের ভাবনাকে এতটুকু আমল না দিয়ে যাঁরা শিক্ষাব্যবস্থাকে উপনিবেশবাদী ধ্যানধারণা থেকে শৃঙ্খলমুক্ত করে উত্তর-ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশজ জ্ঞানচর্চার গুরুত্বকে চিহ্নিত করতে সচেষ্ট, তাঁদের অনেকে (যেমন, গোয়ানিবাসী ক্লদ আলভারেজ়) আবার এতই পশ্চিমবিদ্বেষী যে, প্রাচ্যের জ্ঞানসম্পদকে সার্বভৌম প্রতিপন্ন করতে গিয়ে তাঁদের ভাবনাও শেষ পর্যন্ত পরোক্ষে নতুন শিক্ষানীতিকেই মান্যতা দেয়। অর্থাৎ, দেশজ জ্ঞানচর্চার গুরুত্বকে অস্বীকার করা বা খারিজ করা যেমন একটি ভুল, অপর দিকে দেশজ ভাবনাকে সার্বভৌম গণ্য করা তেমনই আর একটি ভুল। উভয় ক্ষেত্রেই লাভবান হচ্ছেন নতুন শিক্ষানীতির প্রণেতারা।

উভয় পক্ষকেই তাই বুঝতে হবে যে, একমাত্র জ্ঞানই হল সার্বভৌম। প্রাচ্যের জ্ঞানসম্পদকে উপেক্ষা করে, দেশজ জ্ঞানচর্চার ভাবনাকে খাটো করে দেখে যেমন আমাদের সমৃদ্ধিহানি হয়েছে, পশ্চিমের জ্ঞানভান্ডারকে বিজাতীয় আখ্যা দিয়ে একই ভাবে আমরা বৌদ্ধিক দৈন্যের শিকার হই। কারণ, দেশজ ধ্যানধারণাই সার্বভৌম, এমন ভাবনাকে আশ্রয় করেই ভারতীয় সংস্কৃতি এবং হিন্দু সংস্কৃতি সমার্থক— এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠা পায়। যথার্থ জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে তাই প্রয়োজন, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের বৌদ্ধিক সম্পদের যা কিছু ইতিবাচক, তার যথার্থ স্বীকৃতি ও মেলবন্ধন। যা কিছু নেতিবাচক, অসহিষ্ণু ও ঘৃণ্য— তার বর্জন। বিজ্ঞানমনস্কতা এবং যুক্তিবাদকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে, কিন্তু যা কিছু বিজ্ঞানমনস্ক নয়, তাকে খারিজ করা আবশ্যিক, এই ভাবনা যেমন ভুল, পশ্চিমের বিজ্ঞান ও বস্তুবাদী চিন্তা অপ্রাসঙ্গিক, ভারতের দেশজ জ্ঞানচর্চার পরিপন্থী, এই দৃষ্টিভঙ্গি তেমনই এক ভুল। এই ভুল সম্পর্কে সচেতন না হলে, এবং এই ভুল না শোধরালে তার মাসুল আমাদের গুনতে হবে আরও অনেক দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE