কমলালয়: কলকাতার পথে ইউনেস্কো-র স্বীকৃতি মিছিলে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা, ১ সেপ্টেম্বর। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
বেলা বারোটা বেজে গ্যাচে। ভাদ্দর মাসের অসহ্য গরম, হেটো ব্যাপারীরা বাড়ি ফেরার জন্য ছুটচে। মৌতাতি বুড়োরা টিভির সামনে বসে। কলকেতা শহর আজ বড়ই গুলজার। জোড়াসাঁকো, নুড়িঘাটা হয়ে রেড রোড, ধম্মতলা আসার বড় রাস্তা বন্ধ। শহরের দুর্গাপুজোকে বিশ্ব-ঐতিহ্য ঘোষণা করা হয়েচে, ফলে ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানিয়ে আজ মিছিল। কেরাঞ্চি গাড়ি, কেঁদো ওয়েলার, কালো ধোঁয়া ছাড়া বাদুড়ঝোলা বাস, আরামের এসি বাস, বাবুদের গাড়ি সব ওই রাস্তায় বন্দ। ইশকুলের বাচ্চা, ছেলেবুড়ো, জোয়ানমদ্দ সব আজ ১৫ ভাদ্রের গরমে মিছিলে বেরিয়েচে। কেউ কেউ ‘খেলা হবে’ স্লোগান দিচ্চে। খাস কলকেতায় তালগাছ বিশেষ নেই, পাঁজিতে বাংলা ভাদ্দর-আশ্বিনের খবর রাকে না এই শহর। আজকাল সুধু গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল গোচের বুড়ো নেতারা মাঝে মাঝে বেআদপি করলে পিঠে ভাদ্দর মাসের তাল পড়বে বলে হুঙ্কার দ্যান। বৈশাখ জষ্টির আম-কাঁটালের চেয়ে ভাদ্দর মাসের তাল ও মিছিলে মজেচে এই কলিকাতা কমলালয়। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইয়ের নামটা ঝেড়ে দিলাম বলে হাসাহাসি কোরবেন না। হুতোম থেকে ভবানীচরণ, কমলাকান্ত দেবশর্মা সব পূর্বজের রক্ত মিশে আচে এই ভুতুম পেঁচার ছায়াশরীরে।
সে যাক, রাস্তার ধারে নিমখাসা রকমের নতুন দোতলা বাস। দু’চার জন পুজোকত্তা ছাড়া বিশেষ লোক নেই। গাদাগাদি ভিড়ে কত্তাদের কাঁধে চেপে আসচে একের পর এক কিসিমের মা দুগ্গা। মাইকে পুজোর গান... কোতাও যেন বাজল তোমার আলোর বেণু কোতাও বা কুমার শানুর ঢাকের তালে কোমর দোলে। এ দিকে রোদ বিষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেগুলি ভিজে ন্যাতা। কিন্তু রেড রোড অবধি না গিয়ে উপায় নেই। ওখানেই আসল অনুষ্ঠান। মুখ্যমন্ত্রী থেকে নেতানেত্রী, ইউনেস্কোর কত্তা, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সবাই ওখানেই ভাষণ দেবেন। ছেলেগুলিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইশকুল বাস সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে।
মিছিল করার জন্যই আজ ইশকুল, আপিস ছুটি। অন্য সময় মিছিল করলে বিবি মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, বাবু প্রতীকুর রহমান প্রমুখ নেতানেত্রীর উপর পুলিশ লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আজ সরকারি মাহাত্ম্যে সে সব নেই। আগে ইউনিয়ন জ্যাকের মহিমা ছিল অপার। এখন বিলিতি ইউনেস্কো দেবতার। ইউনিয়ন জ্যাকের সেই সব দিনে মা দুগ্গার চালচিত্রে এক শিংওয়ালা ঘোড়ার মতো ইউনিকর্ন আঁকা হত। এ বার চালচিত্রে ইউনেস্কো দেবতাকে কী ভাবে রাখা যায়, ভাবতে ভাবতে কুমোরটুলির পটুয়ারা ক্লান্ত হয়ে গেচেন।
ও দিকে মিছিলের একটা স্কুলপড়ুয়া এট্টু ক্লান্ত হয়ে পোস্তার তারাসুন্দরী পার্কে বসতে গেল। সেখানে আলো-হাওয়া-জলের সরকারি ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সরকারি হিসেবের তো মাতামুন্ডু নেই। একের পর এক পড়ুয়ার মিছিল, তিল ধারণের জায়গা নেই। পার্কে বটগাছের কোটরে কে এক জন ভরদুপুরে কেঁদে উটলো। একটা লোক বলল, “তুমি কাঁদছ শোভা? এ তো কার্নিভাল।” ওরা বহুকাল আগে এ শহরে থাকত। হারবার্ট সরকার ও তার মা-বাবা। নারীকণ্ঠ কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিল, “কার্নিভাল তো অ্যাদ্দিন পুজোর পর, রেড রোডে হত গো। এ বার ভাদ্রের দুপুরেও?” হারবার্টের বাবা উত্তর দিলে না।
সরকার বাহাদুরের ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগে ঠা-ঠা পোড়া ভাদ্রের এই মিছিল মা দুগ্গার জন্য নয়, ইউনেস্কোর বিলিতি গডদের জন্য। অ্যাদ্দিনে বিভিন্ন নথিপত্র দেকে তাঁদের মালুম হয়েচে, পুজোর চার দিন পুরো কলকাতাই পিতিমে, লাইটিং-এ অস্থায়ী শিল্পপ্রদর্শনী। বিলিতি দেবতারা সকলেই মান্যিগণ্যি, জানা জিনিসে তাঁদের স্বীকৃতি আসতে আসতে কালপ্রবাহ বয়ে যায়। কুম্ভমেলা, বৈদিক স্তোত্রপাঠ সবাইকেই হেরিটেজ স্বীকৃতি দিয়েচেন ওঁরা। কিন্তু ইয়েস, নো, থ্যাঙ্ক ইউ, ভেরি গুডের পাল্টা সৌজন্যের মিছিল সুদু এখানেই।
বলিউডের দেব-গন্ধর্বরা অবশ্য এই কলকেতার পুজোকে ঢের আগে নতমস্তকে স্বীকৃতি দিয়েচেন। হাল আমলে পরিণীতা ছবিতে সইফ-বিদ্যা বালনের দুগ্গা পুজো, কাহানি ছবিতেও শহরের পুজো ঘুরেফিরে এসেচে। পার্বতী, চন্দ্রমুখী যে দেবদাসের বিরহে পুজোর মণ্ডপে দোল আনে আনে দোল গেয়ে নেচেছিল, তা বাবু সঞ্জয় লীলা ভন্সালী অবশ্যই জানতেন।
ইউনেস্কোর বিদেশি দেবদেবীদের স্বীকৃতি পাওয়ার আনন্দে এই শহর সিনেমার সেই দিশি দেবদেবীদের ভুলে গেল?
কলকেতার আজকের দুগ্গা পুজোয় সিনেমার ওই দেবদেবীরাই এ শহরের নবো মুন্সি, ছিরে বেণে। তার আগে মহৎ সিনেমা অনেক হয়েচে, দুগ্গা পুজোও হয়েচে। কিন্তু কোনওটাই এ শহরকে তুলে ধরেনি। জয় বাবা ফেলুনাথ-এ কাশীর বনেদি বাড়ির পুজো, শক্তি সামন্তের অনুসন্ধান-এ অমিতাভ, আমজাদ খান ঢাক পেটায় দার্জিলিঙের চা বাগানের পুজোয়। হাল আমলের ঝিনুক, সোনাদারাও কলকেতার পুজো ছেড়ে দুর্গেশগড়ে চলে যায়। এ বার স্বীকৃতি এসেচে, সবাই বোধ হয় শহরেই থাকবে। ফেলুদা আর সোনাদা এক সঙ্গে নাকি পুজো দেখতেও বেরোবে।
কিন্তু পুজোর জাঁকজমক কি আর আগের মতো আচে? সে কালের কলকেতায় বলত, মা এসে গয়না পরেন জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁর বাড়ি, ভোজন করেন কুমারটুলির অভয় মিত্রের বাড়ি আর রাত জেগে বাইনাচ দেকেন স’বাজারের রাজবাড়িতে। অ্যাকন সর্বত্র বারোয়ারির ধুম, গত বার বসুজ মহাশয় শ্রীভূমিতে মায়ের জন্য গগনবিহারী এক ‘বুর্জ খলিফা’ বানিয়েছিলেন, মা যেতে গিয়েও সেখানে ঢুকতে পারলেন না। দমদম এটিসির প্রতিবাদ, বিমান দুর্ঘটনার ভয়ে বুর্জ খলিফা পুজোর মাঝপথেই বন্ধ। তার আগের বার একই কাণ্ড ঘটিয়েছিল দক্ষিণের দেশপ্রিয় পার্ক। বিশাল দুগ্গা, আমোদমাতাল জনতা ভিড় করে হাজির। ভিড়ের ভয়ে সে বার পুজো পণ্ড। অত ভয় পেলে চলে? নদে জেলার শান্তিপুরে এক বার পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে বারোইয়ারি পুজো হয়। সাত বচ্ছর ধরে তার উজ্জুগ হয়, প্রতিমেখানি ষাট হাত উঁচু হয়েছিল, শেষে প্রত্যেক পুতুল কেটে কেটে বিসর্জ্জন করতে হয়। কিন্তু এখন কলকেতার স্বভাব অন্য রকম। যা কিছু বড়, তাকে ছেঁটে ছোট করে দেওয়া।
যাগগে, এখন আর সে কাল নাই। বাঙ্গালি বড় মানুষদের মধ্যে অনেকে সভ্য হয়েচেন। গোলাপ জল দিয়ে জলশৌচ, ঢাকাই কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে পরা উঠে গিয়েচে। কিন্তু এ বারেও বারোইয়ারির বীরকৃষ্ণ দাঁ, রাজডাঙার অশান্ত ঘোষ, নিউ আলিপুরের রূপ বিশ্বেস সবাই এলাকা, ক্লাব নির্বিশেষ ষাট হাজার টাকা অনুদান পাবেন। ইলেকটিরিসিটি ফ্রি। পুজোর পর এই ইলেকটিরিকওয়ালারা নীলকর সায়েবদের মতো গলায় গামছা দিয়ে বকেয়া দাদন নেবে কি না, পরের পশ্ন। একন তো কালীপুজো, ভাইফোঁটা অবধি উৎসব হোক! কলকেতার স্বভাবই এই।
এ বার মা ভেবেচেন, নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘ হয়ে নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘে যাবেন। তৃতীয় পাণ্ডবের ক্লাব তাঁর পুজোয় বেশ জাঁক কত্তো। সমাজমাধ্যম বলচে, এই পুজোর মণ্ডপেই নাকি অর্পিতা-পার্থ পরিচয়।
কলকেতায় একন যে কত পুজো! পাঠক! বাড়ির পুজো, বনেদি ক্লাবের পুজো শীতকালের সূর্য্যের মতো অস্ত গেল। ভবানীপুরের সঙ্ঘশ্রী, সঙ্ঘমিত্র, মুক্তদল, ফরওয়ার্ড ক্লাবের কেউ খপর রাখলে না। মেঘান্তের রৌদ্রের মতো থিমপুজোর প্রতাপ বেড়ে উঠল। বোসপুকুরে মুক্ত রাহার ভাঁড়ের মণ্ডপ, বেহালায় বিশ্বতোষ সুতারের থিম, উত্তরের নেবুতলায় ট্রেন দুর্ঘটনার প্রতীক, দক্ষিণের বাদামতলায় বাংলার গ্রাম। আবার তেলেঙ্গাবাগানে তন্ত্রমূর্তি, পাশের করবাগানে সাবেক খড়ের ঘর। থিমপুজোর এই হুজুকে গা ভাসালে না শুধু ম্যান্ডেভিলার দুইডালিয়া ক্লাব। মন্ত্রীবাবুটি সদ্য গত হয়েচেন, মা সেখানে এক দিন ঢুঁ মারবেন ভেবেচেন।
এখন নতুন বাবু কলকেতার পুজোর দিনক্ষণ দিনে দিনে বেড়ে যায়। আগেও বাবু-বিবিরা বোধনের আগে দ্বিতীয়া, তৃতীয়া থেকে মণ্ডপে মণ্ডপে বোঁ চরকি পাক খেতেন, এ বার প্রায় এক মাসের পুজো। তিথি-নক্ষত্র-মঘা-অশ্লেষা-রোদ-বিষ্টি বিসর্জন দিয়ে ভাদ্র মাসের মিছিলেই সে দিন মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, আজ থেকে পুজো শুরু হয়ে গ্যালো। পুজো বিষয়ে এই শহরে তাঁর প্রতাপ প্রায় মহারানি ভিক্টোরিয়ার মতো, এক দিনে আট-দশটা পুজো উদ্বোধন করেন। আবার স্মার্ত রঘুনন্দনের মতো পরাক্রমী বিধানদাতা। তিনি দ্বিতীয়া বা তৃতীয়ায় মণ্ডপের ফিতে কাটলেই বোধন। অতঃপর সপ্তমীর সকালে কলাবৌ স্নানের জন্য অপেক্ষা নিষ্প্রয়োজন।
এত পরিবর্তন, তবু শহর রয়ে গেল সেই তিমিরেই। শহরে পুজোর অন্যতম টান ইয়ার দোস্ত মোসাহেবদের সঙ্গে একত্র মদ্যপান। মাতাল হলে কি হাজার স্কোয়ারফুট ফ্ল্যাটবাড়ির রাজাবাহাদুর, কি প্যালার বাপ গোবরা প্রায় এক মূর্তিই ধরে থাকেন। বাবুঘাটে জলপুলিশ, আলোর ভিড়, ফলে বাবুরা আর পিতিমেকে ঢাকিশুদ্ধ বিসর্জন দিতে পারেন না। কলকেতা জানে, ভাদ্রের তালপাকা গরমে শুরুর কার্নিভালই সব নয়। আশ্বিনে বিসর্জনের পর ফের দুন্দুভি বেজে ওঠে ডিমডিম রবে, রেড রোডে উৎসব হবে।