Advertisement
০২ মে ২০২৪
জি২০-র মহাযজ্ঞ, আর এক সাংবাদিকের ডায়েরি
G20 Summit 2023

গৌরী সেন ও কণ্ঠরোধ

নিজের অতি স্বল্প অভিজ্ঞতা থেকে স্মরণ করার চেষ্টা করলাম পেনসিলভেনিয়ার পিটসবার্গ জি২০ সম্মেলনের কথা, যেখানে কভার করতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।

মায়াপুরী? জি২০ বৈঠক উপলক্ষে নির্মিত মহাড়ম্বরময় ভারতমণ্ডপম্, নয়াদিল্লি, ১০ সেপ্টেম্বর।

মায়াপুরী? জি২০ বৈঠক উপলক্ষে নির্মিত মহাড়ম্বরময় ভারতমণ্ডপম্, নয়াদিল্লি, ১০ সেপ্টেম্বর। ছবি: পিটিআই।

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৪:২০
Share: Save:

তার পর আমরা সবুজ প্লাস্টিকে মুড়ে দেওয়া দমবন্ধ ভারতকে রাজপথের ডাইনে ও বাঁয়ে রেখে, দু’বার বাহন বদল করে, অনেক ছিদ্রান্বেষণের শিকার হয়ে এক অপূর্ব মায়াপুরীতে পৌঁছলাম। নেহাতই এই গ্রহের প্রাণী, তাই অভ্যস্ত, বুঝতে বিশেষ ভুল হল না আমাদের। কিন্তু বঙ্কুবাবুর বন্ধু, ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং যদি এই মায়াপুরী আসতেন, তাঁর প্রত্যয় হত যে, এক এবং একমেবাদ্বিতীয়ম্ মুখমণ্ডলটি এই সবুজ গ্রহটিকে শাসন করছেন। যাঁর শ্মশ্রু শুভ্র, পক্ব কেশ, চিকন বসন, দৃষ্টি প্রখর।

জি২০’র বিশ্বযজ্ঞে স্লোগান, ফেস্টুন, কাট-আউট আর গ্লো-সাইনে শুধু একটিই মুখমণ্ডল। কখনও পূর্ণাবয়ব। প্রতি কিলোমিটারে অন্তত দু’শো থেকে আড়াইশোটি করে তাঁর ছবি। বায়ু তাঁকে বহন করছে। নদী-সিন্ধু সকল তাঁকেই ক্ষরণ করে চলেছে। ঔষধি বনস্পতি সকলই তিনি, রাত্রি, উষা, দেশের ধূলি, সূর্য এবং অধুনা চন্দ্র পর্যন্ত যাঁর করায়ত্ত।

আমরা, সঙ্গে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকরাও, সারিবদ্ধ শ্রমিকের মতো জি২০ শুরুর পূর্ব দিনে ঢুকে পড়লাম সেই মায়াপুরীতে মোদী প্রবাহে ভেসে। ঢুকে আমাদের রেটিনা বিস্ফারিত হল রং আর আলোর ধাঁধায়, ঝাড়বাতির বিভায়, আকারের প্রকাণ্ডতায়, বৈভবের আকাশ চুম্বনে। আমরা নাহয় তৃতীয় বিশ্বের পোকামাকড়, কিন্তু দেখলাম সঙ্গী চিনের সাংবাদিকের চোখে সন্দেহ, জাপানির অনুসন্ধিৎসা, আমেরিকার লেজেগোবরে ভাব, ফরাসির মুগ্ধতা এবং ব্রিটেনের ভ্রুকুঞ্চন পরিদৃশ্যমান। মাতা মেরির নামে শপথ করে তাঁরা বললেন, পিতামহের জন্মেও এই হস্তিসদৃশ বৃহদায়তন মিডিয়া সেন্টার তাঁরা দেখেননি। বিভিন্ন ভাষায় বিস্ময় প্রকাশ করে তাঁরা ভারতীয়দের কাছে বিস্তর খোঁজখবর নিলেন।

নিজের অতি স্বল্প অভিজ্ঞতা থেকে স্মরণ করার চেষ্টা করলাম পেনসিলভেনিয়ার পিটসবার্গ জি২০ সম্মেলনের কথা, যেখানে কভার করতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। দিল্লির শাস্ত্রী ভবনের মিডিয়া সেন্টারের মতো একটি ঘর ছিল আমাদের কাজের জন্য, আড়েবহরে তার চেয়ে সামান্য ছোটই হবে। যে ভবনটিতে হচ্ছিল, তার ঠিক লাগোয়া পার্কটিতে যেতাম ধূমপানের জন্য। শহর তো ছেড়ে দিন, বোঝার কোনও উপায় ছিল না, এই পাড়াতেই চলছে হাই ভোল্টেজ কূটনৈতিক বৈঠক। যুবক-যুবতীরা বেঞ্চে মগ্ন পারস্পরিক আশ্লেষে। ন্যাম, সার্ক, এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সম্মেলনের অনুষ্ঠানেও এ-হেন আড়ম্বর দেখিনি। গৌরী সেন এখানে সত্যিই তবে উদারহস্তে ঢেলেছেন চার হাজার কোটি! মনে পড়ল ইস্ট রিভারের পাশে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সম্মেলনের জন্য তৈরি করা মিডিয়াকক্ষের কথা। সে যে একেবারেই কেজো। ফলে তাক তো লাগবেই বিদেশি অতিথিদের।

কিন্তু কিছু ক্ষণ পরেই সবাই বুঝতে পারলেন, এই মায়াপুরীর একটি অতিশোভন দ্বিকক্ষের দু’টি প্রকোষ্ঠে তাঁদের আটকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, যাঁদের কাজ সংবাদ সংগ্রহ করে যাচাই করে তার পর তা পরিবেশন করা, কার্যক্ষেত্রে তাঁরা সেই ঘটনাস্থল ভারতমণ্ডপম্-এর ত্রিসীমানায় তো নেই-ই, আসলে নয়নশোভন, বিলাসবিভোর ঘরে বন্দি। যত ক্ষণ থাকবেন ওই প্রকাণ্ড কক্ষে, পেঁয়াজ রসুনেরও প্রবেশাধিকারহীন (বেচারা আফ্রিকা, ইউরোপ ও আরবের সাংবাদিকরা) নিরঙ্কুশ ও ঢালাও ‘সংস্কারী’ আহার এবং বহুবিধ ব্র্যান্ডেড জলেই তুষ্ট থাকতে হবে। নিরন্তর চার দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দেওয়ালজোড়া স্ক্রিনগুলিতে দেখে যেতে হবে জি২০-র প্রোমো এবং খাজুরাহো-অজমের-কেরল-হাম্পি-কানহা’র ভারত বিচিত্রা ভিডিয়ো।

বোমাটা ফাটল সন্ধ্যায়, যখন জো বাইডেন নামলেন। ভারতমণ্ডপম্-এ নাহয় কুড়ি দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন, কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গী সাংবাদিকদের লোককল্যাণ মার্গে প্রধানমন্ত্রীর বাসাতেও ঢুকতে দেওয়া হল না মোদী-বাইডেন বৈঠকে। তাঁরা বাসে বসে থাকলেন। কলম যে তরবারির থেকেও ধারালো তা এই শাসনকাল কবেই বুঝেছে! গত কয়েক বছরে বুঝিনি কি আমরাও? কিন্তু বেচারা আমেরিকান সংবাদমাধ্যম। তাদের একবারে শিক্ষা হয়নি। বাইডেনের বাসভবনে মোদীকে বেকায়দায় ফেলেছিল আমেরিকান সাংবাদিকদের মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রশ্ন। এ বারে তারই কি প্রতিশোধ নেওয়া হল, গুঞ্জন উঠল আমেরিকান সাংবাদিকদের মধ্যে। শুধু সাংবাদিকই নয়, হোয়াইট হাউসও যে চটিতং, তাও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সে দিন আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সালিভান। বলেছিলেন, “হোয়াইট হাউসে এমন কোনও অনুষ্ঠান হলে, প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের জন্য আলাদা সময় রাখেন।” সে দিন রাতেই প্রথম অসন্তোষের ছাপ দেখা গেল ভারত-আমেরিকার যৌথ বিবৃতিতে যেখানে দাগিয়ে দেওয়া হল সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, বহুত্ববাদ, সহিষ্ণুতা, স্বাধীন ধর্মাচরণের মতো অস্বস্তিকর বিষয়গুলি। সম্মেলনের মধ্যে আর কিছু বললেন না বাইডেন, তবে এ ব্যাপারে কূটনৈতিক শালীনতা বজায় রেখে মুখ খুললেন ভিয়েতনামে গিয়ে।

আলোড়ন দেখা গেল পরের দিন। মিডিয়া সেন্টারে দুপুরের পর হঠাৎ পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম-এ ঘোষণা, (যেমনটা পাড়ার বারোয়ারি অনুষ্ঠানে শোভন, বহুপাক্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে অতিবিরল)— ‘অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানানো হচ্ছে জি২০-র ঘোষণাপত্রে সিলমোহর পড়ে গিয়েছে (যেন অন্য কিছু হওয়ার ছিল) নয়াদিল্লির উদ্যোগে।’ এর পর টিম-মোদী তাল ঠুকে বলে গেল, এভারেস্ট-এর চূড়ায় ওঠা সম্ভব হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর বিচক্ষণ নেতৃত্বে। এর আগের বছর ইন্দোনেশিয়ার বালি সম্মেলনে যে সাহসটুকু (রাশিয়ার আক্রমণের কথা ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করে) দেখানো সম্ভব হয়েছিল, এ বার তা কেন করা গেল না— এই অতি বেয়াড়া প্রশ্নও ছোড়া হল। যে ভাবে ম্যালকম মার্শালের বিষাক্ত বাউন্সারে মাথা বাঁচাতেন সুনীল গাওস্কর, সে ভাবেই ‘ডাক’ করল টিম-মোদী। বলা হল, “ওটা ছিল বালি, এটা দিল্লি। ওটা ছিল অন্য সময়, এটা
অন্য সময়।”

তো সে যা-ই হোক, গ্যালন গ্যালন কফি খাওয়া সাংবাদিকদের জীবনে ওইটুকুই যা কূটনৈতিক চাঞ্চল্য সে দিন। দ্বিতীয় ও শেষ দিন ওই সেন্টারে আমাদের মধ্যে দিব্যি চলে এলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এর্দোগান। ছোট্ট একটু ঘরে ধৈর্য ধরে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন তাঁরা, মঞ্চে একা দাঁড়িয়ে, জলের বোতল হাতে নিয়ে। রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভারভ তাঁদের দূতাবাসে ব্রিফিং করলেন যা লাইভ স্ট্রিম করা হল। কোথাও কোনও জড়তা নেই তাঁদের।

কিন্তু ‘তোমার দেখা নাই রে তোমার দেখা নাই।’ জি২০-র ভাঙা হাটে, অর্থাৎ শেষে দিনের বারবেলায় যখন উদ্যোক্তারা গুটিয়ে নিচ্ছেন কফি মেশিন, হঠাৎ আশা জাগল। মিডিয়া সেন্টার সংলগ্ন এলাকা তল্লাশি ও কর্ডন করা শুরু করল প্রধানমন্ত্রীর স্পেশ্যাল প্রোটেকশন গ্রুপ (এসপিজি)। এল স্নিফার ডগ। বিস্ফোরকের তল্লাশি শুরু করেন এনএসজি কমান্ডোরা। মাঝামাঝি এলাকাটি ঘিরে ফেলে প্রধানমন্ত্রীর বসার জন্য নিয়ে আসা হল বিশেষ সোফা। সে এক হইহই কাণ্ড। কিছু সংবাদমাধ্যম আত্মহারা হয়ে বলতে লাগল, প্রধানমন্ত্রী সাংবাদমাধ্যমকে ধন্যবাদ দেবেন, এমনকি কথাও বলবেন তাঁদের সঙ্গে, যা তাঁকে ন’বছরের শাসনকালে কখনও করতে দেখা যায়নি।

আশায় আশায় বসে রইলেন বিশ দেশের সাংবাদিকরা। তিনি এলেন সন্ধ্যা পার হয়ে, হাত নাড়তে নাড়তে হেঁটে গেলেন, যেমনটা করে থাকেন গুজরাত বা রাজস্থানের জনসভায়।

এই ডায়েরি এখানেই শেষ। শুধু শেষপাতে পাঠকের জন্য জুড়ে দেওয়া যাক রবীন্দ্রনাথের ‘কণ্ঠরোধ’ নিবন্ধের কয়েকটি লাইন, যা তিনি ব্রিটিশ শাসিত ভারতে বসে লিখেছিলেন। আজ আবার কেন তাঁকেই স্মরণ করতে হচ্ছে, তার ব্যাখ্যায় যাওয়া নিষ্প্রয়োজন।

“যদি রজ্জুতে সর্পভ্রম ঘটিয়া থাকে তবে তাড়াতাড়ি ঘরের প্রদীপ নিবাইয়া দিয়া ভয়কে আরো পরিব্যাপ্ত করিয়া তুলিতেছ কেন। যে একমাত্র উপায়ে আমরা আত্মপ্রকাশ করিতে পারি, তোমাদের নিকট আপনাদের পরিচিত করিতে পারি, তাহা রোধ করিয়া ফল কী।

সিপাহিবিদ্রোহের পূর্বে হাতে হাতে যে রুটি বিলি হইয়াছিল তাহাতে একটি অক্ষরও লেখা ছিল না— সেই নির্বাক নিরক্ষর সংবাদপত্রই কি যথার্থ ভয়ংকর নহে।... সংবাদপত্র যতই অধিক এবং অবাধ হইবে, স্বাভাবিক নিয়ম-অনুসারে দেশ ততই আত্মগোপন করিতে পারিবে না। যদি কখনো কোনো ঘনান্ধকার অমাবস্যারাত্রে আমাদের অবলা ভারতভূমি দুরাশার দুঃসাহসে উন্মাদিনী হইয়া বিপ্লবাভিসারে যাত্রা করে তবে সিংহদ্বারে কুকুর না ডাকিতেও পারে, রাজার প্রহরী না জাগিতেও পারে, পুররক্ষক কোতোয়াল তাকে না চিনিতেও পারে, কিন্তু তাহার নিজেরই সর্বাঙ্গের কঙ্কণকিঙ্কিণিনূপুরকেয়ুর, তাহার বিচিত্র ভাষার বিচিত্র সংবাদপত্রগুলি কিছু-না-কিছু বাজিয়া উঠিবেই, নিষেধ মানিবে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

G20 Summit 2023 Narendra Modi Journalists
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE